ড. এম মনির উদ্দিন: কৃষি উন্নয়নশীল বাংলাদেশের মুল চালিকাশক্তি। কৃষি প্রধান বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ৭০ শতাংশ অর্থ্যাৎ ১২ কোটি মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কৃষির সাথে সংশ্লিষ্ট। বিশ্বে জনসংখ্যার বিবেচনায় বাংলাদেশের অবস্থান অষ্টম এবং এশিয়ার মধ্যে পঞ্চম। তাই দেশের উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় কৃষির ভুমিকা খুবই গুরুত্বপুর্ন। দেশের মোট দেশীয় উৎপাদনের (জিডিপি) প্রায় ১৬ শতাংশ এবং মোট শ্রমশক্তির প্রায় ৪৭ শতাংশ কৃষি নির্ভর। দেশে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা এবং জমির পরিমান দিন দিন কমে যাওয়া, এমন এক প্রেক্ষাপটে দেশের কৃষির উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে রাসয়নিক সার ও পেস্টিসাইড। কৃষিতে বরাদ্দ দেয়া বাজেটের সিংহভাগ ভুর্তকিতে ব্যয় করা হয় এবং মোট ভুর্তকির ৭৫ শতাংশের বেশী ব্যয় হয় শুধু রাসয়নিক সার ব্যবস্থাপনায়।

সমীরণ বিশ্বাস:
গবেষণামূলক বিশ্লেষণ: ধান বাংলাদেশের প্রধান খাদ্যশস্য। এদেশের কৃষি অর্থনীতি ও খাদ্য নিরাপত্তা বহুলাংশে ধানের উৎপাদনের উপর নির্ভরশীল। ধানের জীবনচক্রে ফুল ফোটার সময় (Flowering Stage) হলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর ধাপ। এই সময়ে সামান্য অবহেলাও কৃষকের সারা বছরের পরিশ্রমকে ব্যর্থ করতে পারে। কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠানসমূহের পরীক্ষণ এবং মাঠ পর্যায়ের কৃষকদের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায়, এই সময়ে সঠিক ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে পারলে ফলনের পরিমাণ ও মান উভয়ই বৃদ্ধি পায়।

Chinmay Prasun Biswas

             It is frequently said that at present we are staying in the age of fourth industrial revolution though the matter is not at all clear to almost all.  It is simply a popular dialogue. However, no question about it but it is beyond doubt that not industry but agriculture feeds world people. There are thousands of food processing industries in this world but agriculture provides their raw materials. There is a close relationship between agriculture and festival all over the world. Away from Bangladesh, many agricultural festivals are observed in different countries of Asia.

বাকৃবি প্রতিনিধি:বাংলাদেশের হাওর অঞ্চলসমূহে দীর্ঘদিন ধরে মৌসুমি বন্যা, যাতায়াতের সীমাবদ্ধতা ও অবকাঠামোগত ঘাটতির কারণে সুবিধাবঞ্চিত এলাকা হিসেবে পরিচিত। হাওরের অধিকাংশ মানুষ এককালীন কৃষির ওপর নির্ভরশীল, ফলে তাদের আয় সবসময় অনিশ্চিত থেকে যায়। তবে সাম্প্রতিক সময়ে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কারণে এই অঞ্চলে পর্যটনের প্রসার ঘটছে, যা নতুন অর্থনৈতিক সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করেছে। কিন্তু নিরাপদ ও স্বাস্থ্যকর খাবারের অভাব এ সম্ভাবনার পূর্ণ ব্যবহারকে বাধাগ্রস্ত করছে।

প্রফেসর আবু নোমান ফারুক আহম্মেদ ও সমীরণ বিশ্বাস: বর্তমান বিশ্বে স্বাস্থ্য সচেতনতা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে, এবং এর সঙ্গে সঙ্গে নিরাপদ খাদ্যের গুরুত্বও বহুগুণে বেড়েছে। খাদ্য শুধু পেট ভরানোর উপকরণ নয়, এটি আমাদের শরীরের গঠন, রোগ প্রতিরোধ এবং মানসিক সুস্থতার সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কিত। কিন্তু দূষিত, ভেজাল ও রাসায়নিকযুক্ত খাদ্য আমাদের সুস্থ জীবনযাত্রার পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশসহ অনেক উন্নয়নশীল দেশে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এখন সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে। তাই, নিরাপদ খাদ্য গ্রহণের অভ্যাস গড়ে তোলা এবং সচেতনতা বৃদ্ধি করা সুস্থ জীবনের জন্য অপরিহার্য।

কৃষিবিদ ডক্টর এস এম রাজিউর রহমান,জাতীয় পরামর্শক, বিশ্বব্যাংক গ্রুপ/ইকো-সিকিউরিটি
বাংলাদেশে প্রাণিসম্পদ খাত একটি যুগান্তকারী পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। একসময় দেশীয় চাহিদার যোগান মেটানোই ছিল বড় চ্যালেঞ্জ, আজ সেটি রপ্তানিমুখী শিল্পের দিকে ঝুঁকছে। এই দ্রুতগতির যাত্রায় একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন সামনে এসেছেপ্রাণিসম্পদ ব্যবস্থাপনার জন্য কি একজন ‘ভেটেরিনারি ডাক্তার’ এবং একজন ‘এনিমেল হাজবেন্ড্রি (AH) গ্র্যাজুয়েট’ উভয়ই প্রয়োজন, নাকি একটি একক ডিগ্রিই যথেষ্ট? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট, আন্তর্জাতিক উদাহরণ এবং বিশেষায়িত দক্ষতার প্রয়োজনীয়তা গভীরভাবে বিবেচনা করা জরুরি।

কেন আলাদা ডিগ্রি জরুরি?

মূলত, ভেটেরিনারি বিজ্ঞান (DVM) এবং এনিমেল হাজবেন্ড্রি (AH) দুটি ভিন্ন ধরনের বিশেষজ্ঞতা তৈরি করে। ১৯৬১ সালে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (BAU) প্রতিষ্ঠার সময় থেকেই এই বিভাজনটি ছিল সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার অংশ। DVM গ্র্যাজুয়েটরা মূলত প্রাণীস্বাস্থ্য, রোগ নির্ণয়, চিকিৎসা, সার্জারি ও জনস্বাস্থ্যের মতো ক্লিনিক্যাল বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করে। অন্যদিকে, AH গ্র্যাজুয়েটদের ফোকাস থাকে প্রাণি উৎপাদন ব্যবস্থাপনা, প্রাণি খাদ্য ও পুষ্টি, জেনেটিক উন্নয়ন, খামার পরিকল্পনা, এবং ভ্যালুচেইন ও মার্কেট ডেভেলপমেন্টের ওপর।

এই দুটি পেশার উদ্দেশ্য এক হলেও, তাদের কাজের ক্ষেত্র সম্পূর্ণ আলাদা। আন্তর্জাতিকভাবে এই বিভাজনটি একটি স্বীকৃত মডেল। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানি ও নেদারল্যান্ডসের মতো উন্নত দেশগুলোতে এনিমেল সায়েন্সকে কৃষি অনুষদের একটি স্বতন্ত্র ডিসিপ্লিন হিসেবে দেখা হয়, যেখানে ভেটেরিনারি মেডিসিন থাকে আলাদা ভেটেরিনারি কলেজ বা অনুষদের অধীনে। এখানকার এনিমেল সায়েন্স গ্র্যাজুয়েটরা নিউট্রিশনিস্ট, ব্রিডিং স্পেশালিস্ট বা ফার্ম ম্যানেজার হিসেবে কাজ করেন। ভেটেরিনারি চিকিৎসকরা ক্লিনিক্যাল ও জনস্বাস্থ্য-সংক্রান্ত দায়িত্ব পালন করেন। এমনকি বিশ্বব্যাংক, OIE (World Organization for Animal Health, বর্তমানে WOAH) এবং জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (FAO)-এর নীতিগত নথিতেও প্রাণিসম্পদ উন্নয়নকে দুটি সমান গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভে ভাগ করা হয়েছে—উৎপাদন এবং স্বাস্থ্য।

বাংলাদেশে OIE/WOAH ২০১১ সালে প্রথম PVS (Performance of Veterinary Services) ইভ্যালুয়েশন করে এবং পরে ২০১৫ সালের PVS Gap Analysis রিপোর্ট ও সাম্প্রতিক UNIDO–LDDP 2023 মূল্যায়নে ভেটেরিনারি সার্ভিস, প্রশিক্ষণ ও শিক্ষা ব্যবস্থার শক্তি ও দুর্বলতা চিহ্নিত করে। বাংলাদেশে ভেটেরিনারি সার্ভিস, শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা এখনো অনেকাংশে  নিরাময়মূলক (Curative) এবং উৎপাদনমুখী (Production–oriented) । কিন্তু আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী দীর্ঘমেয়াদী স্থায়িত্ব (long-term sustainability) নিশ্চিত করতে হলে বিশেষায়িত জনশক্তি (manpower), শক্তিশালী শিক্ষা ব্যবস্থা, One Health ভিত্তিক জনস্বাস্থ্য সেবা, এবং আধুনিক আইন ও অবকাঠামো উন্নয়ন অপরিহার্য।

OIE/WOAH-এর পিভিএস মূল্যায়ন ও গ্যাপ অ্যানালাইসিসের (২০১৫ ও ২০১৯) ফলাফল স্পষ্টভাবে দেখিয়েছে যে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরকে আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে উন্নীত করতে হলে প্রাণি উৎপাদন ও প্রাণিস্বাস্থ্য—উভয় ক্ষেত্রেই স্বতন্ত্র ও শক্তিশালী প্রশাসনিক কাঠামো থাকা আবশ্যক। একটি কম্বাইন্ড ডিগ্রি এই দুটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভের ভারসাম্য নষ্ট করবে এবং পেশাদারদের মধ্যে বিশেষজ্ঞ দক্ষতার ঘাটতি তৈরি করবে। একটি দেশের খাদ্যনিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য যেমন উৎপাদন বৃদ্ধি জরুরি, তেমনি জনস্বাস্থ্য ও রোগ প্রতিরোধের জন্য প্রাণীর স্বাস্থ্য সুরক্ষা অপরিহার্য।

প্রাণিপালন ও প্রাণিচিকিৎসা: বিশেষীকরণই টেকসই উন্নয়নের চাবিকাঠি

বর্তমানে আমাদের অনেকেই উভয় ধরনের ডিগ্রিকে (অর্থাৎ DVM এবং Animal Husbandry/Animal Science) একত্র করার কথা চিন্তা করছে, যদিও দেশের একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এ ধরনের কম্বাইন্ড ডিগ্রী দেয়া হচ্ছে। এর ফলে মাঠপর্যায়ে তাৎক্ষণিক কিছু বাস্তব সমস্যার সমাধান দিতে পারলেও (যেমন– সাধারণ রোগের চিকিৎসা, জরুরি ভেটেরিনারি সেবা প্রদান, আবার খামার ব্যবস্থাপনা, খাদ্য ও প্রজনন সংক্রান্ত প্রযুক্তিগত পরামর্শও দিতে পারছে); বিশেষায়িত কারিগরি সেবার অভাব থেকে যাচ্ছে।

বিশদভাবে দেখতে গেলে এটি একধরনের অস্থায়ী সমাধান হিসেবে কাজ করছে। মূল সমস্যাটি হলো, এ ধরনের কম্বাইনড ডিগ্রির কোর্স কাঠামোতে না আছে পূর্ণাঙ্গ ভেটেরিনারি কোর্স (DVM-এর মতো), আবার না আছে পুরোপুরি প্রাণি উৎপাদন ভিত্তিক বা এনিমেল হাজবেন্ড্রি–কেন্দ্রিক পড়াশোনা (B.Sc. A.H.-এর মতো) । অর্থাৎ একজন শিক্ষার্থী না পুরোপুরি ভেটেরিনারি চিকিৎসক হয়ে উঠছে, না পুরোপুরি উৎপাদন বিশেষজ্ঞ হয়ে উঠছে। কারণ সত্তর শতাংশ ভেটেরিনারি বিষয় ও ত্রিশ শতাংশ উৎপাদন বিষয়ক কোর্স কারিকুলাম অধ্যায়নের ফলে পরিপূর্ণ জ্ঞান অর্জন করা সম্ভব না, যা আন্তর্জাতিক মানের ভেটেরিনারি চিকিৎসা কিংবা আধুনিক প্রাণিসম্পদ উৎপাদন গবেষণার জন্য যথেষ্ট নয়। আন্তর্জাতিক মান অনুসারে (যেমন ইউরোপ, আমেরিকা, ভারত ও পাকিস্তান) বাংলাদেশে ভেটেরিনারি এডুকেশনে Practical training ও specialization tracks সীমিত। UNIDO 2023 রিপোর্ট অনুযায়ী, Food Safety ও Veterinary Public Health (VPH)-সংক্রান্ত বিশেষায়িত প্রশিক্ষণ ও একাডেমিক কোর্স মডিউল জরুরি, কারণ দেশে slaughterhouse, meat & milk safety, drug residue, এবং AMR বড় সমস্যা। অতএব, এ উদ্যোগ সাময়িকভাবে মাঠপর্যায়ের কিছু সমস্যার সমাধান দিলেও দীর্ঘমেয়াদে দেশের জন্য বড় ধরনের সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়াবে।দেশে বিশেষায়িত জ্ঞানের দক্ষ জনশক্তির অভাব হবে—আমরা উচ্চতর ভেটেরিনারি বিশেষজ্ঞও পাব না, আবার দক্ষ প্রাণি উৎপাদন বিশেষজ্ঞও পাব না। ফলত, নীতিনির্ধারণ, গবেষণা, উচ্চমানের খামার ব্যবস্থাপনা কিংবা আন্তর্জাতিক বাজারের সাথে প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ পিছিয়ে পড়বে। এর পাশাপাশি, বিশেষায়িত জ্ঞানের ঘাটতির কারণে কৃষক ও শিল্প উদ্যোক্তাদের অনেক সময় বিদেশি প্রযুক্তি, পরামর্শক বা টেকনিক্যাল পারসনের উপর নির্ভর হতে হবে, যা অর্থনৈতিক ও পেশাগত উভয় ক্ষেত্রেই দেশের জন্য ক্ষতিকর।

সুতরাং, টেকসই প্রাণিসম্পদ উন্নয়নের জন্য জরুরি হলো ডিগ্রিগুলোকে আলাদা রাখা, যাতে একজন শিক্ষার্থী নির্দিষ্ট ক্ষেত্র—ভেটেরিনারি সায়েন্স বা এনিমেল হাজবেন্ড্রি—যেটিই বেছে নিক না কেন, সেখানে গভীর ও বিশেষায়িত দক্ষতা অর্জন করতে পারে এবং দীর্ঘমেয়াদে দেশের জন্য সত্যিকারের বিশেষজ্ঞে পরিণত হয়।

একক ডিগ্রির ঝুঁকি ও টেক্সাস এ&এম মডেলের প্রস্তাবনা

বাংলাদেশে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (BAU) পাঠ্যক্রম অনুযায়ী, বিএসসি এনিমেল হাজবেন্ড্রি (বিএসসি এএইচ) ডিগ্রির জন্য মোট ১৯২ ক্রেডিট কোর্স প্রদান করা হয়, যার মধ্যে ১০.৫৬% এনিমেল হেলথ-সম্পর্কিত কোর্স রয়েছে। অন্যদিকে, ডিভিএম ডিগ্রির জন্য মোট ১৯৯ ক্রেডিট আওয়ার নির্ধারণ করা হয়েছে, যার মধ্যে ১২.৩০% এনিমেল প্রোডাকশন-সম্পর্কিত। এর বিপরীতে, বিএসসি ভেটেরিনারি সায়েন্স এবং এএইচ (সম্মান) ডিগ্রিতে ২১১ ক্রেডিট কোর্সের মধ্যে ৩০% এনিমেল প্রোডাকশন কোর্স অন্তর্ভুক্ত।

এই ডেটা বিশ্লেষণ থেকে বোঝা যায় যে, একটি যৌথ বা কম্বাইন্ড ডিগ্রি, যেমন বিএসসি ভেটেরিনারি সায়েন্স এবং এএইচ, মূলত ভেটেরিনারি হেলথ ফোকাস। যা একটি পূর্ণাঙ্গ প্রোডাকশন-ভিত্তিক ডিগ্রির (বিএসসি এএইচ) তুলনায় সম্পূর্ণ ভিন্ন। এতে করে এনিমেল প্রোডাকশন-এর উপর একটি স্বতন্ত্র ডিগ্রি বিদ্যমান রাখার কোন বিকল্প নেই।

শুধুমাত্র কম্বাইনড পদ্ধতিটি দেশে টেকসই প্রাণিসম্পদ উন্নয়নে বিশেষজ্ঞ জ্ঞানের ঘাটতি তৈরি করবে; গবেষণা, একাডেমিক এবং মাঠ পর্যায় বিশৃঙ্খলা তৈরি হবে। একটি একক বা কম্বাইন্ড ডিগ্রি (যেমন BVSc & AH) প্রবর্তন করলে দুটি ক্ষেত্রেই দক্ষতার গভীরতা নষ্ট হওয়ার ঝুঁকি থাকবে, যা বৈশ্বিক মানদণ্ডের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে না। ফলে শ্রমবাজারে কর্মসংস্থানের স্পষ্টতা যেমন কমে যাবে, তেমনি আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে স্বীকৃতি পাওয়াও কঠিন হতে পারে।

এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় টেক্সাস এ&এম ইউনিভার্সিটির মডেলটি বাংলাদেশের জন্য একটি কার্যকর সমাধান হতে পারে। এই মডেল অনুযায়ী, একটি বিএসসি (অনার্স) ইন এনিমেল সায়েন্স প্রোগ্রামে দুটি ট্র্যাক বা ধারা চালু করা যেতে পারে—

১. এনিমেল প্রোডাকশন ও অ্যাগ্রিবিজনেস ট্র্যাক

এই ট্র্যাকের শিক্ষার্থীরা প্রাণী খাদ্য ও পুষ্টি, জেনেটিক্স, উৎপাদন ব্যবস্থাপনা, ভ্যালু-চেইন, মার্কেট ডেভেলপমেন্ট ও উদ্যোক্তা হওয়ার বিষয়গুলোতে বিশেষায়িত জ্ঞান অর্জন করবে। তারা ভবিষ্যতে ফিড মিল, ব্রিডিং সেন্টার, ফার্ম ম্যানেজার বা সরকারি-বেসরকারি প্রোডাকশন অফিসার হিসেবে কাজ করতে পারবে।

২. প্রি-ভেটেরিনারি মেডিসিন ট্র্যাক

যারা ভবিষ্যতে DVM ডিগ্রি অর্জন করে ভেটেরিনারি চিকিৎসক হতে চায়, তারা এই ট্র্যাকটি বেছে নিতে পারবে। এখানে তারা জীববিজ্ঞান, রসায়ন, বায়োকেমিস্ট্রি, অ্যানাটমির মতো প্রিরেকোয়েস্ট কোর্সগুলো সম্পন্ন করবে, যা তাদের DVM প্রোগ্রামে ভর্তির জন্য যোগ্য করে তুলবে। এই দ্বৈত ট্র্যাক সিস্টেমের মাধ্যমে প্রতিটি শিক্ষার্থী তাদের আগ্রহ ও লক্ষ্য অনুযায়ী সুনির্দিষ্ট পথে এগিয়ে যেতে পারবে। এটি একদিকে যেমন উৎপাদন ব্যবস্থাপনার জন্য দক্ষ জনবল তৈরি করবে, অন্যদিকে প্রাণীচিকিৎসা বিজ্ঞানের জন্যও উপযুক্ত ভিত্তি গড়ে তুলবে।

প্রশাসনিক কাঠামো: আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতার আলোকে

আন্তর্জাতিক প্রাণী স্বাস্থ্য সংস্থা (OIE) বা World Organization for Animal Health (WOAH)-এর সুপারিশ অনুসারে, বাংলাদেশের প্রাণিসম্পদ খাতকে শক্তিশালী করতে প্রশাসনিকভাবে দুটি স্বতন্ত্র কিন্তু সমন্বিত ইউনিট বা অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে।

  1. i) স্বাতন্ত্র্য প্রাণিসম্পদ উৎপাদন ও সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (Directorate of Animal Production & Extension)

এই অধিদপ্তরটি মূলত এনিমেল হাজবেন্ড্রি (Animal Husbandry/Animal Science/Animal Production) গ্র্যাজুয়েটদের নেতৃত্বে পরিচালিত হবে। এর প্রধান কাজগুলো হবে:

  • প্রাণী পুষ্টি ও খাদ্য ব্যবস্থাপনা: গবাদি-প্রাণি, পোল্ট্রির জন্য মানসম্মত খাদ্য (feed and fodder) নিশ্চিতকরণ এবং নতুন প্রযুক্তি প্রয়োগ।
  • বংশবৃদ্ধি ও জেনেটিক উন্নয়ন: উন্নত জাতের প্রাণী প্রজনন ও জেনেটিক গবেষণার মাধ্যমে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি।
  • খামার ব্যবস্থাপনা: আধুনিক খামার প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনার জন্য প্রযুক্তিগত সহায়তা এবং প্রশিক্ষণ প্রদান।
  • ভ্যালু-চেইন উন্নয়ন: দুধ, মাংস, ডিম ও অন্যান্য প্রাণিজ পণ্যের প্রক্রিয়াজাতকরণ, বাজারজাতকরণ এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের সহায়তা।
  • সম্প্রসারণ সেবা: মাঠ পর্যায়ে কৃষকদের কাছে উৎপাদন-ভিত্তিক জ্ঞান ও প্রযুক্তি পৌঁছে দেওয়া।
  • পর্যবেক্ষণ এবং পরিদর্শন: বিশ্বমান (Global Standard) অনুযায়ী ভালো প্রাণিপালন অনুশীলন (GAHP) প্রোটোকলের পর্যবেক্ষণ এবং পরিদর্শন।
  1. ii) স্বাতন্ত্র্য প্রাণী স্বাস্থ্য ও ভেটেরিনারি সার্ভিসেস অধিদপ্তর (Directorate of Animal Health & Veterinary Services)

এই অধিদপ্তরটি ভেটেরিনারি মেডিসিন (DVM) গ্র্যাজুয়েটদের নেতৃত্বে পরিচালিত হবে। এর মূল দায়িত্বগুলো হবে:

  • রোগ নিয়ন্ত্রণ ও চিকিৎসা: প্রাণির রোগ নির্ণয়, চিকিৎসা, সার্জারি ও জরুরি স্বাস্থ্যসেবা প্রদান।
  • টিকা কর্মসূচি: সংক্রামক রোগ প্রতিরোধে নিয়মিত টিকাদান কার্যক্রম পরিচালনা।
  • জনস্বাস্থ্য ও বায়োসিকিউরিটি: জুনোটিক রোগ (প্রাণী থেকে মানুষের মধ্যে ছড়ানো রোগ) নিয়ন্ত্রণ,  এবং খামারে বায়োসিকিউরিটি নিশ্চিত করা।
  • ল্যাবরেটরি সার্ভিস: রোগ শনাক্তকরণের জন্য আধুনিক ল্যাবরেটরি কার্যক্রম পরিচালনা।
  • নীতি ও নিয়ন্ত্রণ: ওষুধ, ভ্যাকসিন, প্রাণিজ ও অন্যান্য ভেটেরিনারি পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণ ও সংশ্লিষ্ট নীতি প্রণয়ন।

iii) সমন্বয় ব্যবস্থা: ওয়ান হেলথ ও পলিসি ইউনিট (One Health & Policy Unit)

এই দুটি অধিদপ্তরের মধ্যে কার্যকর সমন্বয় নিশ্চিত করার জন্য একটি শক্তিশালী সমন্বয় সেল (One Health Unit) থাকবে। এই ইউনিটটি বাধ্যতামূলকভাবে উভয় অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের পাশাপাশি স্বাস্থ্য ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত হবে। এর মূল কাজ হবে:

  • যৌথ নীতি প্রণয়ন: এমন নীতি তৈরি করা, যা প্রাণি উৎপাদন ও স্বাস্থ্য উভয় ক্ষেত্রেই ভারসাম্য বজায় রাখে।
  • রোগ নজরদারি: রোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণের জন্য দুটি অধিদপ্তরের মধ্যে তথ্য আদান-প্রদান নিশ্চিত করা।
  • সংকটকালীন সাড়া: যেকোনো জরুরি স্বাস্থ্য বা উৎপাদন সংকট মোকাবিলায় সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা তৈরি করা।

এই প্রশাসনিক কাঠামো প্রাণিপালন ও প্রাণিচিকিৎসা—দুটি পেশারই বিশেষায়িত জ্ঞান ও দক্ষতাকে কাজে লাগাতে পারবে এবং বাংলাদেশের প্রাণিসম্পদ খাতের টেকসই উন্নয়নে কার্যকর ভূমিকা পালন করবে।

উপসংহার

বাংলাদেশের টেকসই প্রাণিসম্পদ উন্নয়নের জন্য DVM ও AH এই দুটি ডিগ্রিকে আলাদা ও স্বতন্ত্র রাখাই সবচেয়ে যৌক্তিক ও কার্যকর মডেল। এ দুটি পেশা একে অপরের পরিপূরক। প্রশাসনের ক্ষেত্রেও এনিমেল প্রোডাকশন এবং ভেটেরিনারি সার্ভিসেসের জন্য দুটি আলাদা ইউনিট/অধিদপ্তর গঠন করা যেতে পারে, যারা ‘ওয়ান হেলথ’ নীতিমালার আওতায় একে অপরের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করবে।

ডিগ্রিগুলোকে মিশ্রিত করার পরিবর্তে, তাদের স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে পেশাগত মান, দক্ষতা এবং ক্যারিয়ারের পথ নির্দিষ্ট করা গেলেই কেবল দেশের প্রাণিসম্পদ খাত একটি টেকসই ও প্রতিযোগিতামূলক শিল্পে পরিণত হবে।

[লেখক এই প্রবন্ধটি লিখেছেন তার নিজস্ব মতামত, ডেস্ক রিভিউ এবং বিভিন্ন দেশসহ আন্তর্জাতিক ও জাতীয় সংস্থার সাথে কাজ করার মাধ্যমে অর্জিত অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে। এই প্রবন্ধের মাধ্যমে কাউকে আঘাত করা লেখকের উদ্দেশ্য নয়,তাই অনিচ্ছাকৃত ভুল ক্ষমাযোগ্য। এটি প্রাণিসম্পদ উন্নয়ন ক্ষেত্রে কর্মরত নীতিনির্ধারক ও বিশেষজ্ঞদের চিন্তার গভীরতা প্রসারিত করতে সহায়ক হতেও পারে।]