মাটি ও ফসল সুরক্ষায় জৈব সারের গুরুত্ব

সমীরণ বিশ্বাস:মাটি ও ফসলের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় জৈব সারের গুরুত্ব অপরিসীম। আধুনিক কৃষিতে উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে অতিরিক্ত রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহার মাটির উর্বরতা হ্রাস করছে এবং পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করছে। মাটির জীবাণু, কেঁচোসহ প্রাকৃতিক উপাদানগুলো ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, ফলে মাটির গুণগত মান কমে যাচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে জৈব সার ব্যবহারই হতে পারে টেকসই কৃষির অন্যতম সমাধান। জৈব সার প্রাকৃতিক উপাদান যেমন গোবর, কম্পোস্ট, জৈব বর্জ্য ও সবুজ সার থেকে তৈরি হয়, যা মাটিতে প্রয়োজনীয় পুষ্টি সরবরাহ করে এবং মাটির গঠন উন্নত করে। এটি মাটির জৈব পদার্থের পরিমাণ বাড়িয়ে জলধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে, ফলে খরা বা অতিবৃষ্টিতেও ফসলের উৎপাদন তুলনামূলক স্থিতিশীল থাকে। একই সঙ্গে জৈব সার ব্যবহারে ফসলের গুণমান উন্নত হয় ও মানবস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর রাসায়নিক অবশিষ্টাংশের ঝুঁকি কমে। অতএব, মাটি ও ফসলের দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্য রক্ষায় জৈব সার ব্যবহারের কোনো বিকল্প নেই। টেকসই কৃষি ও নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনের জন্য কৃষকদের জৈব সার ব্যবহারে উৎসাহিত করা এবং প্রশিক্ষণ প্রদান এখন সময়ের দাবি।

জৈব সারের ব্যবহার ও টেকসই কৃষি:

বাংলাদেশের কৃষি খাত গত কয়েক দশকে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে। উৎপাদন বেড়েছে, খাদ্য ঘাটতি কমেছে এবং কৃষি অর্থনীতি আরও শক্ত ভিত্তি লাভ করেছে। তবে এই উন্নয়ন মূলত রাসায়নিক সার ও কীটনাশক নির্ভর হওয়ায় দীর্ঘমেয়াদে মাটির স্বাভাবিক গঠন ও উর্বরতা নষ্ট হচ্ছে। অতিরিক্ত রাসায়নিক ব্যবহারে উপকারী অনুজীব ধ্বংস হচ্ছে, পানির মান নষ্ট হচ্ছে এবং ফসলের পুষ্টিগুণ কমে যাচ্ছে। ফলে কৃষির উৎপাদনশীলতা কিছু সময়ের জন্য বাড়লেও, টেকসই উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটে জৈব সার ব্যবহারের গুরুত্ব দিন দিন বাড়ছে। জৈব সার প্রাকৃতিক উপাদান যেমন গবাদিপশুর গোবর, ফসলের অবশিষ্টাংশ, পচা পাতা ও কম্পোস্ট থেকে তৈরি হয়। এটি মাটির জৈব পদার্থ বৃদ্ধি করে, জল ধারণক্ষমতা উন্নত করে এবং পরিবেশ দূষণ রোধে সহায়তা করে। পাশাপাশি জৈব সার ব্যবহারে উৎপাদিত ফসল হয় নিরাপদ, পুষ্টিকর ও পরিবেশবান্ধব। টেকসই কৃষি নিশ্চিত করতে রাসায়নিক সারের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে জৈব সারের ব্যবহার বাড়ানো জরুরি। এর জন্য কৃষকদের সচেতনতা বৃদ্ধি, স্থানীয় পর্যায়ে জৈব সার উৎপাদন কেন্দ্র গড়ে তোলা এবং সরকার ও বেসরকারি খাতে সহযোগিতা বাড়ানো প্রয়োজন। সঠিক পরিকল্পনা ও প্রয়োগের মাধ্যমে জৈব সারভিত্তিক কৃষি বাংলাদেশকে একটি পরিবেশবান্ধব, নিরাপদ ও টেকসই কৃষি ব্যবস্থার পথে এগিয়ে নিতে পারে।

রাসায়নিক নির্ভরতার ফলাফল:

গত কয়েক দশকে বাংলাদেশের কৃষিক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি ঘটেছে। আধুনিক প্রযুক্তি, উচ্চফলনশীল জাতের বীজ, এবং রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহারে উৎপাদন বেড়েছে বহুগুণ। কিন্তু এই অগ্রগতির আড়ালে লুকিয়ে আছে এক গুরুতর উদ্বেগ—অতিরিক্ত রাসায়নিক উপকরণনির্ভরতা। গত পাঁচ বছরে কৃষি খাতে প্রবৃদ্ধি বাড়লেও এর বেশিরভাগই এসেছে রাসায়নিক সার, কীটনাশক ও হরমোননির্ভর চাষাবাদের মাধ্যমে। এর ফলে কৃষি উৎপাদন সাময়িকভাবে বাড়লেও মাটির প্রাকৃতিক গঠন ধীরে ধীরে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। অতিরিক্ত ইউরিয়া, টিএসপি, এমওপি বা অন্যান্য রাসায়নিক সার ব্যবহারে মাটির জৈব উপাদান ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। উপকারী অনুজীব বা মাটির ক্ষুদ্র জীবগুলো মরে যাচ্ছে, যা মাটির উর্বরতা বজায় রাখতে অপরিহার্য। ফলে মাটির পানি ধারণক্ষমতা ও প্রাকৃতিক পুনরুজ্জীবন ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। একসময় যে জমিতে সহজেই ভালো ফলন হতো, এখন সেখানে একই ফলনের জন্য দ্বিগুণ বা তারও বেশি রাসায়নিক ব্যবহার করতে হচ্ছে। এতে উৎপাদন খরচ বাড়ছে এবং কৃষক আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। শুধু মাটি নয়, অতিরিক্ত রাসায়নিক ব্যবহারের প্রভাব পড়ছে পরিবেশ ও মানবস্বাস্থ্যের ওপরও। কীটনাশক ও রাসায়নিক সার মিশ্রিত পানি নদী ও খালের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ছে, যা মাছ ও অন্যান্য জীববৈচিত্র্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। একইসঙ্গে খাদ্যশস্যে রাসায়নিক অবশিষ্টাংশ থেকে যাচ্ছে, যা মানুষের শরীরে দীর্ঘমেয়াদে বিভিন্ন রোগ সৃষ্টি করছে, যেমন কিডনি ও লিভারের সমস্যা, ক্যানসার এবং হরমোনজনিত জটিলতা। এই প্রবণতা কৃষির টেকসই উন্নয়ন ও খাদ্যনিরাপত্তার জন্য বড় হুমকি হয়ে উঠেছে। টেকসই কৃষি নিশ্চিত করতে হলে এখনই রাসায়নিক নির্ভরতা কমিয়ে জৈব ও প্রাকৃতিক কৃষি পদ্ধতির দিকে ফিরে যাওয়া জরুরি। এতে মাটির স্বাস্থ্য রক্ষা পাবে, কৃষক লাভবান হবে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্ম নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাদ্য পাবে।

জৈব সারের গুরুত্ব:

জৈব সার হলো এমন একটি প্রাকৃতিক সার, যা উদ্ভিদ ও প্রাণীর পচনশীল অংশ, যেমন গোবর, ছাই, পাতা, ফসলের অবশিষ্টাংশ, এবং বিভিন্ন জৈব পদার্থ থেকে তৈরি হয়। এটি রাসায়নিক সার ব্যবহারের একটি পরিবেশবান্ধব বিকল্প হিসেবে কৃষিক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। জৈব সার ব্যবহারে মাটির গুণগত মান উন্নত হয়, কারণ এটি মাটির ভৌত, রাসায়নিক ও জৈবিক বৈশিষ্ট্যে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। প্রথমত, জৈব সার মাটির গঠনকে ঝুরঝুরে ও বায়ুসঞ্চালনযোগ্য করে তোলে, ফলে উদ্ভিদের শিকড় সহজে বৃদ্ধি পায়। এটি মাটিতে পানির ধারণক্ষমতা বৃদ্ধি করে, যা খরা পরিস্থিতিতেও ফসলের বৃদ্ধি টিকিয়ে রাখতে সাহায্য করে। দ্বিতীয়ত, জৈব সার ধীরে ধীরে পুষ্টি সরবরাহ করে, ফলে মাটিতে পুষ্টির ভারসাম্য বজায় থাকে এবং দীর্ঘমেয়াদে মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি পায়। এছাড়া, জৈব সার মাটিতে জীবাণু ও অণুজীবের কার্যক্রমকে সক্রিয় করে তোলে, যা মাটির জৈবিক জীবনকে সমৃদ্ধ করে। এই অণুজীবগুলো মাটির জৈব পদার্থ ভেঙে উদ্ভিদের জন্য সহজলভ্য পুষ্টি তৈরি করে। ফলে মাটির জীববৈচিত্র্য বৃদ্ধি পায়, যা টেকসই কৃষির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অন্যদিকে, জৈব সার ব্যবহারে ফসল হয় অধিক পুষ্টিকর, সুস্বাদু ও বিষমুক্ত, যা মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। বাজারে জৈব পণ্যের চাহিদা ক্রমশ বাড়ছে, ফলে কৃষকরা অর্থনৈতিকভাবেও লাভবান হচ্ছেন। সারসংক্ষেপে বলা যায়, জৈব সার শুধু মাটির উর্বরতা রক্ষা করে না, বরং পরিবেশ সংরক্ষণ, স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও টেকসই কৃষি ব্যবস্থার ভিত্তি স্থাপন করে। তাই মাটির স্বাস্থ্য ও ফসলের গুণগত মান বজায় রাখতে জৈব সার ব্যবহারের গুরুত্ব অনস্বীকার্য।বাংলাদেশে জৈব সার ব্যবহার চিত্র: দেশে জৈব সারের বার্ষিক চাহিদা ৬০-৬৫ লাখ টন। এর মধ্যে ৭৫ শতাংশের বেশি কাঁচামাল দেশেই পাওয়া যায়। অর্থাৎ, কার্যকর উদ্যোগ নিলে অভ্যন্তরীণভাবে পুরো চাহিদা পূরণ সম্ভব। এতে প্রাণিসম্পদ খাতের উন্নয়ন, গ্রামীণ অর্থনীতির চাঙ্গা হওয়া, এবং পরিবেশবান্ধব কৃষি নিশ্চিত করা যাবে।

নীতিগত উদ্যোগ ও ভর্তুকি:

বর্তমানে কৃষি খাতে বরাদ্দের ৭০ শতাংশই ভর্তুকিতে ব্যয় হয়, যার ৮০ শতাংশ রাসায়নিক সারে। সরকার এখন রাসায়নিক সারের ব্যবহার ৩২-৩৫ শতাংশ কমিয়ে জৈব সারের ব্যবহার বাড়ানোর লক্ষ্যে কাজ করছে। বিশেষজ্ঞরা জৈব সার ব্যবহারে ভর্তুকি ও প্রণোদনা দেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন, যাতে কৃষকরা সহজে এটি গ্রহণ করতে পারেন।

জৈব সার ব্যবহারে চ্যালেঞ্জ ও করণীয়:

জৈব সার ব্যবহারের গুরুত্ব আজ সর্বজনবিদিত হলেও এর প্রয়োগে কিছু চ্যালেঞ্জ বিদ্যমান। প্রধান চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে রয়েছে—জৈব সার উৎপাদনের ধীরগতি, কৃষকদের মধ্যে পর্যাপ্ত সচেতনতার অভাব, এবং বাজারে জৈব সার সহজলভ্য না থাকা। অনেক কৃষক এখনো রাসায়নিক সারের দ্রুত ফলপ্রদ প্রভাবের কারণে জৈব সার ব্যবহারে আগ্রহী নন। এছাড়া, উৎপাদন ও সংরক্ষণ প্রক্রিয়ায় প্রযুক্তিগত ঘাটতি এবং মানসম্মত জৈব সারের অভাবও বড় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে।

এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলায় প্রয়োজন সমন্বিত উদ্যোগ। সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে কৃষকদের প্রশিক্ষণ ও সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে, যাতে তারা জৈব সারের দীর্ঘমেয়াদি উপকারিতা সম্পর্কে জানেন। স্থানীয় পর্যায়ে জৈব সার উৎপাদন কেন্দ্র স্থাপন করা হলে তা সহজলভ্য হবে এবং পরিবহন ব্যয়ও কমবে। পাশাপাশি বাজারে জৈব সারের মূল্য সহনীয় রাখার উদ্যোগ নিতে হবে, যাতে কৃষকেরা সহজে এটি ব্যবহার করতে পারেন। গবেষণা ও প্রযুক্তিগত সহায়তা বাড়িয়ে উৎপাদন প্রক্রিয়া আরও কার্যকর ও সময়সাশ্রয়ী করা জরুরি।

বাংলাদেশের কৃষি খাতের টেকসই ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে হলে জৈব সারের ব্যবহার বৃদ্ধি অপরিহার্য। এটি শুধু মাটি ও ফসলের স্বাস্থ্য রক্ষায় নয়, বরং মানবস্বাস্থ্য, পরিবেশ সংরক্ষণ এবং খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এখনই সময় রাসায়নিক নির্ভরতা কমিয়ে পরিবেশবান্ধব ও টেকসই কৃষির পথে এগিয়ে যাওয়ার।

লেখক: কৃষি ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ , ঢাকা।