
ড. এম মনির উদ্দিন: কৃষি উন্নয়নশীল বাংলাদেশের মুল চালিকাশক্তি। কৃষি প্রধান বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ৭০ শতাংশ অর্থ্যাৎ ১২ কোটি মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কৃষির সাথে সংশ্লিষ্ট। বিশ্বে জনসংখ্যার বিবেচনায় বাংলাদেশের অবস্থান অষ্টম এবং এশিয়ার মধ্যে পঞ্চম। তাই দেশের উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় কৃষির ভুমিকা খুবই গুরুত্বপুর্ন। দেশের মোট দেশীয় উৎপাদনের (জিডিপি) প্রায় ১৬ শতাংশ এবং মোট শ্রমশক্তির প্রায় ৪৭ শতাংশ কৃষি নির্ভর। দেশে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা এবং জমির পরিমান দিন দিন কমে যাওয়া, এমন এক প্রেক্ষাপটে দেশের কৃষির উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে রাসয়নিক সার ও পেস্টিসাইড। কৃষিতে বরাদ্দ দেয়া বাজেটের সিংহভাগ ভুর্তকিতে ব্যয় করা হয় এবং মোট ভুর্তকির ৭৫ শতাংশের বেশী ব্যয় হয় শুধু রাসয়নিক সার ব্যবস্থাপনায়।
সকল ধরনের ফসলের স্বাভাবিক জীবনচক্র চালানোর জন্য ১৭টি পুষ্টি উপাদানের প্রয়োজন হয় যেখানে বিগত কয়েক দশকে দেশের জমিতে মুলত নাইট্রোজেন, ফসফরাস এবং পটাশিয়াম নামে ৩টি সার প্রয়োগ করা হয়েছে। দেশে রাসায়নিক সারের চাহিদা প্রায় ৭০ লাখ টন। এর মধ্যে ইউরিয়া সারের পরিমান ৩৫ লাখ টন এবং অন্যান্য সার মিলে ৩৫ লাখ টন। রাসায়নিক সারে ভুর্তকি প্রদানের ফলে দেশের ৯৮ শতাংশ জমিতে বর্তমানে প্রধান রাসায়নিকগুলো সার ব্যবহার করা হয়। ফসল উৎপাদনে অনেকাংশে রাসাসয়নিক সার ও পেস্টিসাইড ব্যবহারের কারনে একদিকে যেমন কৃষকের উৎপাদন খরচ বাড়ছে সেইসাথে কমে যাচ্ছে জমির উৎপাদনশীলতা যার অন্যতম প্রধান কারন মাটির জৈব পদার্থ কমে যাওয়া। এরূপ প্রেক্ষাপটে জলবায়ুর পরিবর্তন, ফলন হ্রাস, প্রাকৃতিক দুর্যোগ বেড়ে যাওয়া প্রভৃতির কারনে ভবিষ্যতে খাদ্য নিরাপত্তার বলয় অনেকটাই চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়ে পড়ছে।
আমাদের কৃষি জমির হারানো স্বাস্থ্য ফিরিয়ে আনার জন্য এবং ভবিষ্যতে ক্রমবর্ধমান মানুষের খাদ্য চাহিদা মেটাতে জমিতে জৈব সার প্রয়োগের কোন বিকল্প নেই। মাটির উর্বরতা কমে যাওয়া, ফসলের ফলন কমে যাওয়া, রানায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহার বৃদ্ধি এবং ভারসাম্যহীন ব্যবহারের বর্তমান অবস্থায় মাটিতে জৈব পদার্থের পরিমান বৃদ্ধি করে মাটির স্বাস্থ্য উন্নত করার জন্য জৈব সারের ব্যবহার জরুরী হয়ে পড়েছে। আদর্শ উর্বর জমিতে মাটির শতকরা ৫ ভাগ জৈব পদার্থ থাকা দরকার অথচ আমাদের দেশের মাটিতে জৈব পদার্থের পরিমান কমতে কমতে ২ শতাংশ এমনকি কোথাও কোথাও তা ১ শতাংশের নীচে চলে এসেছে। জমিতে রাসায়নিক সারের কার্যকারিতা বাড়ানোর জন্য মাটিতে কমপক্ষে ৩ শতাংশ হারে জৈব পদার্থ থাকা দরকার।
টেকসই কৃষির জন্য পরিবেশগত উপাদানগুলোর সুরক্ষা এবং কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির মধ্যে স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য শুধুমাত্র রাসায়নিক সারের ব্যবহারই নয়, জৈব সারের ব্যবহারকেও ভারসাম্যপুর্ন উপায়ে নিশ্চিত করা প্রয়োজন। ১৯৭০ এর দশকের পুর্বে কৃষিতে শস্যের বহুমুখীতা ছিলো যার ফলে জমিতে প্রাকৃতিকভাবে জৈব পদার্থ যুক্ত হতো। সেইসাথে কৃষকেরা বিভিন্ন ফসলের চাষে গোবরসহ অন্যান্য আবর্জনা সার প্রচুর পরিমানে ব্যবহার করতে পারতো এবং এতে মাটির জৈব পদার্থের পরিমানে ভারসাম্যতা বজায় থাকতো।
বর্তমানে দেশে আবাদী জমি কমে যাওয়া সেইসাথে ক্রমবর্ধমান মানুষের খাদ্য নিশ্চিত করতে জমির ফসলের নিবিড়তা বৃদ্ধি পেয়েছে। এমতাবস্থায় জমিতে প্রতিটি ফসল চাষ করতে গিয়ে ইউরিয়া, ফসফেট ও পটাশ প্রচুর পরিমানে ব্যবহার করতে হচ্ছে। প্রয়োগকৃত ইউরিয়া সারের ৬৫-৭০ ভাগ পরিবেশে মিশে গিয়ে পরিবেশকে দুষিত করছে। ফসলের ফলন বাড়ানোর জন্য ফসফেট ও পটাশ সারের উপর নির্ভরতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। অধিকন্ত রাসয়নিক সার একচেটিয়া ব্যবহারের কারনে মাটির উপকারী অনুজীব দ্রুত কমে যাচ্ছে। এর কারনে গাছ মাটি থেকে প্রয়োজনীয় পুষ্টি গ্রহন করতে পারছে না এমনকি সার বেশী পরিমানে ব্যবহার করেও কাজ করছে না। সেইসাথে মাটিতে বিভিন্ন অণুপুষ্টির পরিমান কমে যাওয়ায় যে সকল ফসল বা খাদ্য উৎপাদিত হচ্ছে তাতে স্বাভাবিকভাবেই মানবদেহের জন্য প্রয়োজনীয় অণুপুষ্টি পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে, মানুষের অপুষ্টি দিন দিন বাড়ছে।
মাটিতে প্রয়োজনীয় পরিমানে জৈব পদার্থ থাকলে মাটির জন্য উপকারী অনুজীবের সংখ্যা দ্রুত বেড়ে যায় এবং তাদের কার্যকলাপের মাধ্যমে গাছের জন্য প্রয়োজনীয় ১৭টি প্রধান ও গৌন পুষ্টি উপাদানের প্রাপ্যতা বেড়ে যায়। এ বিবেচনায় দেশের ফসল উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি মাটি উর্বর ও উৎপাদনক্ষম রাখতে কম্পোস্টিং খুবই প্রয়োজন। বাংলাদেশের মাটির উর্বরতা দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে রাসয়নিক সার বিশেষ করে ধান উৎপাদনের জন্য উদ্ভিদের পুষ্টির প্রধান উৎস হিসেবে নাইট্রোজেন সার ব্যবহারের কারনে। রাসয়নিক সারের উচ্চমাত্রার কারনে বিশেষ করে অজৈব নাইট্রোজেন সার-মাটির অম্লীয়করণ, কাঠামোগত ক্ষতি, পানি ধারন ক্ষমতা হ্্রাস, মাটিতে অনুজীবের সংখ্যা কমে যাওয়া বা তাদের কাজের উপর প্রভাব ফেলে। সেজন্য জমির উর্বরতা বৃদ্ধি করা, মাটির কাঠামোগত উন্নয়ন এবং উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করার জন্য মাটিতে সবুজ সারের মতো বিকল্প উপায় গ্রহন করা প্রয়োজন।
বাংলাদেশে মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি এবং ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য, বিশেষ করে ধান-ভিত্তিক ফসল পদ্ধতিতে Sesbania aculeata (স্থানীয় ধৈঞ্চা) এবং Sesbania rostrata (আফ্রিকান ধৈঞ্চা) এর মাধ্যমে জমিতে সবুজ সার প্রয়োগ একটি গুরুত্বপুর্ন পদ্ধতি। এই পদ্ধতি রাসয়নিক সারের একটি টেকসই বিকল্প হিসেবে কাজ করে, যা মাটির জৈব পদার্থ এবং নাইট্রোজেনের পরিমান পুরন করতে সাহায্য করে।
বাংলাদেশে Sesbania প্রজাতির সংক্ষিপ্তসারঃ
১. Sesbania aculeata (দেশি ধৈঞ্চা)
- এই প্রজাতিটি স্থানীয় এবং বাংলাদেশে সবুজ সারের জন্য ব্যাপকভাবে ব্যবহার হয়।
- এটি দ্রুত বৃদ্ধি, রসালো প্রকৃতির এবং লবনাক্ত, খরাপ্রবণ, চরাঞ্চল, জলাবদ্ধ জমিসহ বিভিন্ন ধরনের মাটির জন্য সহনশীল জাত।
২. Sesbania rostrata (আফ্রিকান ধৈঞ্চা)
- বাংলাদেশে ১৯৮৬ সালে এই প্রজাতিটি প্রবর্তিত হয়। এটি দ্রুত বর্ধনশীল, অত্যন্ত রসালো নরম এবং শক্তিশালী প্রজাতি। ঝবংনধহরধ ধপঁষবধঃধ এর তুলনায় নাইট্রোজেনের পরিমান বেশী এবং বায়ুমন্ডলীয় নাইট্রোজেন ফিক্স করার ব্যতিক্রমী ক্ষমতা রয়েছে যা প্রতি হেক্টরে ৪৩৫ কেজি ইউরিয়া সার যুক্ত করতে পারে।
- Sesbania rostrata অনেক দেশে সবুজ সার তথা নাইট্রোজেন সংযুক্তকারী ফসল হিসেবে ব্যাপকভাবে চাষ করা হয়। দ্রুত বর্ধনশীল এই প্রজাতি গাঢ় সবুজ বর্নের যাতে ১.২% নাইট্রোজেন থাকে, যেখানে স্থানীয় ধৈঞ্চায় পাওয়া যায় ০.৬২%। Sesbania rostrata ৫০ দিনে জমিতে হেক্টরপ্রতি ৪৩৫ কেজি ইউরিয়া সার যুক্ত করতে পারে। এই প্রজাতির সম্প্রসারনে প্রধান বাঁধা হলো প্রয়োজনীয় বীজের অভাব। এর বীজ উৎপাদনের জন্য এপ্রিল-মে মাসে বীজ বপন করতে হয় এবং অক্টোবর-নভেম্বর মাসে ফসল কেঁটে বীজ পাওয়া যায় যার জন্য ৭-৮ মাস সময় প্রয়োজন হয়। সুতরাং, এটির মাঠে বীজের জন্য চাষ করলে কৃষকের প্রধান একটি ফসল বাদ দিতে হয় যা মোটেই গ্রহনযোগ্য নয়। তবে, এই গাছের কান্ড বা ডালপালা থেকে সহজেই গাছ হয় যা আমনের জমিতে পার্সিং করলে এই গাছে প্রচুর পাখি বসে পোকামাকড় দমনে সাহায্য করার পাশাপাশি ফসলের কোন ক্ষতি ছাড়াই মান সম্পন্ন বীজ পাওয়া যায়। এভাবে Sesbania rostrata এর বীজের উৎপাদন বাড়ানো যায়।
সবুজ সার হিসেবে Sesbania ব্যবহারের সুবিধা-
১. মাটিকে নাইট্রোজেন সমৃদ্ধ করে
শিম জাতীয় উদ্ভিদ হিসেবে, Sesbania-এর উভয় প্রজাতিই মুল এবং কান্ডের নোডিউলে বায়ুমন্ডলীয় নাইট্রোজেন ফিক্স করে। প্রচুর পরিমান জৈব পদার্থ মাটিতে যুক্ত হওয়ায় উল্লেখযোগ্য পরিমানে নাইট্রোজেন যুক্ত হয়, যা কৃত্রিম নাইট্রোজেন সারের প্রয়োজনীয়তা হ্রাস করে। গবেষণায় দেখা গেছে যে, Sesbania সবুজ সার ব্যবহারে রাসয়নিক সার প্রয়োগ ২৫% বা তার বেশী কমাতে পর্যাপ্ত নাইট্রোজেন সরবরাহ করতে পারে।
২. মাটির স্বাস্থ্য উন্নত করে
Sesbania জৈব বস্তুর পচন প্রচুর পরিমানে জৈব পদার্থ যোগ করে, যা মাটির গঠন, পানিধারন ক্ষমতা বাড়ায় এবং মাটিতে বায়ু চলাচল উন্নত করে। Sesbania aculeata-এর মাধ্যমে প্রতি বিঘা জমিতে ৩-৪ টন গ্রীন বায়োমাস যুক্ত হয় যেখানে ঝবংনধহরধ ৎড়ংঃৎধঃধ প্রতি বিঘা জমিতে ৬-৭ টন গ্রীন বায়োমান যুক্ত করতে পারে। সবুজ সার মাটির পুষ্টির ভারসাম্য বজায় রাখতেও সাহায্য করে এবং সবুজসারহীন জমির তুলনায় একটি ইতিবাচক পুষ্টির ভারসাম্য প্রদান করে।
৩. ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি করে
মাটির উর্বরতা বৃদ্ধির ফলে পরবর্তী ফসলের উৎপাদন বেশি হয়। বাংলাদেশে গবেষণায় দেখা গেছে যে, রোপা আমন ধান রোপনের আগে Sesbania ব্যবহার করলে শস্যের উৎপাদন উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি হয়।
৪. ক্ষয়প্রাপ্ত জমি পুনরুদ্ধার ও আগাছা দমন
Sesbania লবনাক্ত, খরাপ্রবণ এবং চরের জমির ক্ষয়রোধ করে জমিকে ফসল উৎপাদনের উপযোগী করে তোলে। Sesbania এর দ্রুত ও ঘন বৃদ্ধির কারনে জমিতে আগাছা জন্মাতে পারে না। ফলে, জমির আগাছা দমনে অতিরিক্ত শ্রমিক বা আগাছানাশক ব্যবহারের প্রয়োজন হয় না।
ফসল পদ্ধতি
Sesbania সাধারনত ধান-ভিত্তিক ফসল পদ্ধতিতে ব্যবহার করা হয়। সাধারনত, বোরো ধান কাঁটার পর রোপা আমন লাগানোর আগ পর্যন্ত ৫০-৯০ দিন জমি পতিত থাকে যখন Sesbania চাষ করলে ৪০-৬০ দিন বয়সের গাছ মাটিতে মিশিয়ে দেয়া হয়।
পরিবেশ রক্ষা করার সাথে সাথে খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য Sesbania এর সাহায্যে সবুজ সারকরন একটি গুরুত্বপুর্ন পদক্ষেপ। সবুজ সারের মাধ্যমে জমিতে প্রচুর পরিমানে বিভিন্ন মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট যুক্ত হয় যা পরবর্তীতে ফসলের মধ্যে এ সকল মাইক্রোনিউট্রিয়েন্টের পরিমান বাড়াতে সাহায্য করে এবং মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট সমৃদ্ধ খাদ্য গ্রহনের মাধ্যমে মানুষের দৈহিক পুষ্টিমান উন্নয়নে সহায়ক হবে। তাই, জমির স্বাস্থ্য রক্ষায় এবং ফসলের উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর জন্য ধান-ভিত্তিক ফসল চক্রে ধৈঞ্চার মাধ্যমে জমিতে প্রচুর পরিমানে জৈব পদার্থ যুক্ত করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহন জরুরী।
-লেখকঃ প্রজেক্ট কো-অর্ডিনেটর, গেইন বাংলাদেশ
























