পোলিও মুক্ত পৃথিবীর স্বপ্ন: রোটারির অসাধারণ লড়াই

রোটারিয়ান ড. মো. হেমায়েতুল ইসলাম আরিফ
ভূমিকা: একটি বিশেষ দিনের কথা
প্রতি বছর ২৪ অক্টোবর পুরা বিশ্বে 'বিশ্ব পোলিও দিবস' পালন করা হয়। এই দিনটি শুধু ক্যালেন্ডারে একটা তারিখ নয়। এই দিনটি আমরা পোলিও নামক ভয়ঙ্কর রোগটির কথা স্মরণ করি, যারা এটির বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন তাদের শ্রদ্ধা করি এবং একটি পোলিওমুক্ত পৃথিবীর জন্য আমাদের শপথ নিই। এই লড়াইয়ের সবচেয়ে বড় সৈনিক হল 'রোটারি ইন্টারন্যাশনাল' নামের একটি সংগঠন। ২০২৫ সালের লড়াইটি এখনও বাকি। এই লেখাটি আপনাকে বলবে পোলিও দিবস কী, পোলিওর ভ্যাকসিন কিভাবে আবিষ্কার হল, পৃথিবী এখন কতটা নিরাপদ, বাংলাদেশের সাফল্য এবং এই পুরো যুদ্ধ থেকে আমরা কি শিখলাম। বিশ্ব পোলিও দিবস আসতে চলেছে। আমরা এখনও পর্যন্ত অনেক দূর এগিয়েছি, কিন্তু শেষ

১. বিশ্ব পোলিও দিবস কেন গুরুত্বপূর্ণ?

বিশ্ব পোলিও দিবস শুরু করেছিল রোটারি সংগঠনটি। এই দিনটি ডা. জোনাস সাল্কের জন্মদিন, যিনি প্রথম পোলিওর ভ্যাকসিন বানিয়েছিলেন। এই দিনটি পালন আমরা কয়েকটি কারণে করি:

  • সবার জানার জন্য:আজকাল অনেক তরুণ-তরুণীরাই পোলিওর ভয়াবহতা সম্পর্কে জানে না। এই দিনটি সবাইকে এই রোগের বিষয়ে সচেতন করে এবং টিকা নেওয়ার গুরুত্ব বোঝায়।
  • টাকা সংগ্রহ সরকারের মনোযোগ আনার জন্য:এই দিনে রোটারি এবং অন্যান্য সংস্থা পোলিও নির্মূলের জন্য প্রচুর টাকা সংগ্রহ করে। বিল গেটসের সংস্থা এই টাকার সাথে আরও টাকা দিয়ে সাহায্য করে। সরকারকেও এই দিনে পোলিও বিষয়ে সচেতন করা হয়।
  • সাফল্য উদযাপনের জন্য:যেখানে ১৯৮৮ সালে বছরে ৩৫০,০০০ জন পোলিওতে আক্রান্ত হত। আজ মাত্র কয়েক ডজন মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হয়। এই বিশাল সাফল্য উদযাপন করার দিন এটি।
  • নায়কদের শ্রদ্ধা করার জন্য:লক্ষ লক্ষ ডাক্তার, নার্স ও স্বেচ্ছাসেবক অনেক কষ্ট করে দূরদূরান্তের গ্রামে-পাহাড়ে গিয়ে শিশুদের টিকা দিয়েছেন। এই দিনটি তাদের জন্য।

২. পোলিও রোগটি কি এবং ভ্যাকসিন কারা বানালেন?

পোলিও একটি ভয়ঙ্কর ভাইরাস সংক্রামক রোগ, যা বেশি করে ছোট বাচ্চাদের হয়। এই ভাইরাস শরীরে ঢুকে স্নায়ুকে নষ্ট করে দেয়। এর ফলে হাত-পা অবশ হয়ে যায়, মানুষ পঙ্গু হয়ে যায়, এমনকি মৃত্যুও হতে পারে। আগে এই রোগে সারা বিশ্বে আতঙ্কে থাকত।

এই রোগ ঠেকানোর জন্য দুজন ডাক্তার অসাধারণ আবিষ্কার করেছিলেন:

  • ডা. জোনাস সাল্ক:তিনি প্রথম পোলিওর ভ্যাকসিন বানান। তার ভ্যাকসিনটি ছিল একটি 'মৃত ভাইরাস' দিয়ে, যা ইনজেকশনের মাধ্যমে দিতে হত। এই ভ্যাকসিন আবিষ্কারের খবর শুনে সারা বিশ্বে খুশির বন্যা বয়ে গিয়েছিল। সবচেয়ে বড় কথা, তিনি এই ভ্যাকসিনের পেটেন্ট নেননি যাতে সবার কাছে এটি সহজে পৌঁছাতে পারে।
  • ডা. আলবার্ট সাবিন:তিনি একটি ভিন্ন ধরণের ভ্যাকসিন বানালেন, যাকে 'ওরাল পোলিও ভ্যাকসিন' বা 'ওপিভি' বলে। এটি ছিল মুখে খাওয়ার মতো পানির ফোঁটা। এই ভ্যাকসিন সস্তা, দেয়া সহজ এবং এটি শরীরে দ্রুত immunity তৈরি করে। এই ভ্যাকসিনের জন্যই আজ আমরা পৃথিবী থেকে পোলিও প্রায় উড়িয়ে দিতে পেরেছি।

৩. রোটারি সংগঠনের অসাধারণ ভূমিকা

পোলিও নির্মূলের গল্প মানেই রোটারির গল্প। এই সাধারণ মানুষের সংগঠনটি কিভাবে পৃথিবী বদলে দিল:

  • শুরুটা:১৯৭৯ সালে রোটারি ফিলিপাইনে ৬০ লাখ শিশুকে টিকা দিয়ে দেখিয়ে দিল যে বড় পরিসরে টিকাদান সম্ভব। তারপর ১৯৮৫ সালে তারা সিদ্ধান্ত নিল সমগ্র পৃথিবীর শিশুকে পোলিও থেকে বাঁচাবে। তারা ১২ কোটি ডলার সংগ্রহ করার লক্ষ্য নিয়েছিল, যা একটি বিশাল অঙ্ক ছিল।
  • অন্য সংস্থাগুলোকে জড়ানো:রোটারির এই উদ্যোগ দেখে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ইউনিসেফ-এর মতো বড় সংস্থাগুলো এগিয়ে এল। ১৯৮৮ সালে তারা মিলে 'গ্লোবাল পোলিও ইরাডিকেশন ইনিশিয়েটিভ' বা জিপিইআই গড়ে তুলল।
  • টাকা সংগ্রহ স্বেচ্ছাসেবক:আজ পর্যন্ত রোটারি পোলিওর কাজে ২১০ কোটি ডলারেরও বেশি টাকা দান করেছে। এর সদস্যরা নিজেরা টাকা দিয়েছেন, অন্যদের কাছ থেকে সংগ্রহ করেছেন এবং টিকা দানের দিনে সরাসরি হেল্প করেছেন।
  • সরকারের সাথে কথা বলা:রোটারির সদস্যরা সারা পৃথিবি জুড়ে সরকারি অফিসে গিয়ে পোলিওর জন্য টাকা ও সাহায্য চেয়েছেন। তাদের এই চেষ্টাকেই 'পোলিও কূটনীতি' বলা হয়।

৪. পৃথিবী কি এখন পোলিওমুক্ত?

পুরোপুরি নয়, কিন্তু আমরা তার খুব কাছাকাছি।

  • আসল পোলিও ভাইরাস:পোলিও ভাইরাসের তিনটি ধরনের। এর মধ্যে দুটিকেই আমরা সম্পূর্ণ নির্মূল করে ফেলেছি। মাত্র একটি ধরন (ওয়াইল্ড পোলিওভাইরাস টাইপ ১) এখনও টিকে আছে, এবং সেটিও শুধু পাকিস্তান আফগানিস্তানে বছরে মাত্র কয়েকটি সংক্রমন পরিলক্ষিত হয়।
  • নতুন সমস্যা: বর্তমানে নতুনএকটা সমস্যা দেখা গেছে, তা হলো 'টিকা থেকে হওয়া পোলিও'। মুখে খাওয়ার ওপিভি ভ্যাকসিনের ভাইরাসটি খুবই দুর্বল। কিন্তু যদি কোনো এলাকায় অনেক শিশুই টিকা না নেয়, তাহলে এই দুর্বল ভাইরাসটি সেখানে ছড়িয়ে পড়ে এবং শক্তিশালী হয়ে উঠে। এটাকে 'সিভিডিপিভি' বলে। এই নতুন সমস্যার সমাধান করতে বিজ্ঞানীরা আরও উন্নত ও নিরাপদ ভ্যাকসিন বানিয়েছেন।

৫. বাংলাদেশের সাফল্যের গল্প

বাংলাদেশ এক সময় পোলিও আক্রান্ত দেশ ছিল। কিন্তু অত্যন্ত সংগঠিতভাবে কাজ করে ২০০০ সালের শেষ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বাংলাদেশকে পোলিও  মুক্ত পলিও দেশ হিসেবে ঘোষনা করে। ২০১৪ সালে পুরা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলকে পোলিওমুক্ত ঘোষণা করা হয়, যার বাংলাদেশও একটি অংশ।

বাংলাদেশের সাফল্যের রহস্য:

  • সরকারের শক্তিশালী ইচ্ছা:সরকার পোলিও নির্মূলকে জাতীয় অগ্রাধিকার দিয়েছিল।
  • সবাই মিলে কাজ করা:সরকার, রোটারি, ইউনিসেফ, ডব্লিউএইচও – সবাই এক হয়ে কাজ করেছে।
  • প্রতিটি শিশুর কাছে পৌঁছানো:স্বাস্থ্যকর্মী ও রোটারি স্বেচ্ছাসেবকেরা নৌকা নিয়ে হাওর-বাঁওড়ে, পাহাড়ে – সব জায়গায় গিয়ে প্রতিটি শিশুকে টিকার ফোঁটা খাওয়ানোর ব্যবস্থা করেছেন।
  • সম্প্রদায়ের বিশ্বাস অর্জন:মানুষকে বুঝিয়ে, গল্প বলে, তাদেরকে বিশ্বাস করানোর মাধ্যমে টিকা কার্যক্রম সফল করা হয়েছে।

এখন বাংলাদেশ পোলিওমুক্ত হলেও সতর্কতা জারি আছে। যেকোনো সময় ভাইরাস ফিরে আসতে পারে, তাই নিয়মিত টিকাদান এবং নজরদারি চলছে।

৬. পোলিও যুদ্ধ থেকে আমাদের শেখা

পোলিও নির্মূলের এই লড়াই শুধু একটি রোগকে হারানোর গল্প নয়। এটি আমাদের অনেক বড় বড় শিক্ষা দিয়েছে:

  • একতাই বল:কোনো দেশ বা সংস্থা একা এই সাফল্য অর্জন করতে পারত না। রোটারির মতো সাধারণ মানুষের সংগঠন, সরকার এবং বড় আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো যখন এক হয়ে কাজ করেছে, তখনই সফলতা এসেছে।
  • স্থানীয় মানুষকে নিয়ে কাজ:শুধু ডাক্তার আর ওষুধ দিলেই হয় না, গ্রামের মানুষ, ধর্মীয় নেতা, স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবকদের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক তৈরি করতে হয়। তাদের বিশ্বাস অর্জন করাই আসল কাজ।
  • নতুন উদ্ভাবন:পোলিওর কাজে আমরা শিখলাম কিভাবে ভ্যাকসিন ঠান্ডা (কুল চেইন) রাখতে হয়, কিভাবে দূরদূরান্তে ভ্যাকসিন পৌঁছাতে হয়, কিভাবে রোগের উপর নজর রাখতে হয়। এই জ্ঞান এখন অন্যান্য রোগ নিয়ন্ত্রণেও কাজে লাগছে।
  • কখনও হাল ছাড়া নয়:এই কাজে যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, ভুল খবর/রিউমার – সব বাধাই এসেছে। কিন্তু রোটারি ও তার সহযোগীরা কখনও থামেনি। তারা ধৈর্য্য ধরে কাজ করে গেছে।
  • একটি কাজ অনেক কাজে লাগে:পোলিও নির্মূলে যে স্বাস্থ্যকর্মী, যে system গড়ে উঠেছে, তা দিয়ে এখন ভিটামিন 'এ' ও কৃ্মি ঔষধ বিতরণ, measles-এর টিকা দেওয়া – সব কাজই করা হচ্ছে।

উপসংহার: শেষ লক্ষ্যের দিকে

২০২৫ সালের বিশ্ব পোলিও দিবস আমাদের মনে করিয়ে দেবে যে আমরা শেষ ধাপে পৌঁছে গেছি। পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে যে কয়েকটি কেস আছে, সেগুলো থেকেও মুক্তি পেতে হবে। এখন থেমে গেলে সব efforts-ই বিফলে যাবে।

রোটারির এই সংগ্রাম প্রমাণ করে যে সাধারণ মানুষের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা পৃথিবী বদলে দিতে পারে। যেদিন পৃথিবীর শেষ পোলিও রোগিটি নির্মূল রিপোর্ট হবে, সেদিন শুধু একটি রোগের জয় নয়, হবে মানুষের অদম্য ইচ্ছাশক্তির জয়। আমরা একটি নিরাপদ, স্বাস্থ্যবান ও একসূত্রে বাঁধা পৃথিবী গড়ে তুলব – এই হোক আমাদের অঙ্গীকার।

-লেখক: পাস্ট প্রেসিডেন্ট, রোটারি ক্লাব অব রাজশাহী সেন্ট্রাল ও কো- কোঅর্ডিননেটর, পাবলিক ইমেজ কমিটি, রিপসা, ডি-৬৪, বাংলাদেশ