ভূমিকা:
প্রতি বছর ঈদুল আজহায় আনন্দের সাথে কোরবানি শেষে হাজার কোটি টাকার চামড়া রাতারাতি মূল্যহীন হয়ে পড়ে। গরীব-মধ্যবিত্ত কৃষক ও সাধারণ মানুষ তাদের পশুর চামড়ার ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হয়। এই ধস নামা বাজারের পেছনে শক্তিশালী চামড়া সিন্ডিকেটের একচ্ছত্র আধিপত্য ও কারসাজি প্রধান কারণ। এই দুষ্টচক্র ভাঙতে হলে সৎ ও সামাজিক দায়িত্বশীল উদ্যোক্তা তৈরির কোনো বিকল্প নেই। আর এই লক্ষ্য অর্জনে দেশের বিপুল সংখ্যক মাদ্রাসা ও ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হতে পারে এক যুগান্তকারী মডেল, কেননা কোরবানির চামড়া সংগ্রহ ও বিক্রয় ইতিমধ্যেই অনেক মাদ্রাসার আয়ের অন্যতম উৎস।
সিন্ডিকেটের কারসাজি: বাজারের অস্থিরতার মূল কারণ
- অবৈধ একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ: কয়েকটি প্রভাবশালী গোষ্ঠী চামড়া ক্রয়-বিক্রয়ের পুরো প্রক্রিয়া (সংগ্রহকারী থেকে ট্যানারি পর্যন্ত) নিয়ন্ত্রণ করে। তারা ষড়যন্ত্রপূর্বক ক্রয়মূল্য কৃত্রিমভাবে হঠাৎ নামিয়ে দেয়।
- জাল সংবাদ ও মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ: কোরবানির আগেই "বিশ্ববাজারে চামড়ার চাহিদা কমেছে", "গুণগত মান খারাপ", "মজুদভাণ্ডার ভর্তি" ইত্যাদি মিথ্যা সংবাদ ছড়িয়ে ভোক্তা (পশু মালিক) মনোবল ভেঙে দেওয়া হয়।
- মধ্যস্বত্বভোগীদের জাল: অসংখ্য মধ্যস্বত্বভোগী (আড়তদার, ফড়িয়া) চামড়ার মূল্য থেকে বিশাল অংশ কেটে রাখে, ফলে প্রান্তিক বিক্রেতা পায় না ন্যায্যমূল্য।
- অসংগঠিত বিক্রেতা: সাধারণ মানুষ চামড়া সংরক্ষণ, বাজারজাতকরণ ও দরকষাকষিতে অজ্ঞ ও অসংগঠিত, যা তাদের সিন্ডিকেটের শিকারে পরিণত করে।
মাদ্রাসা কেন হতে পারে সমাধানের অংশ?
১. প্রতিষ্ঠিত নেটওয়ার্ক ও আস্থা:
মাদ্রাসাগুলো স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সাথে গভীরভাবে সম্পৃক্ত এবং তাদের উপর ব্যাপক আস্থা ও গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। ইতিমধ্যেই হাজার হাজার মাদ্রাসা তাদের শিক্ষার্থী ও স্থানীয় সম্প্রদায়ের কোরবানির চামড়া সংগ্রহ করে থাকে। এটি একটি প্রাক-প্রতিষ্ঠিত, বিশ্বস্ত ও বিশাল সংগ্রহ নেটওয়ার্ক।
২. অর্থনৈতিক প্রেরণা ও স্থায়িত্ব:
অনেক মাদ্রাসার জন্য কোরবানির চামড়া বিক্রয় বার্ষিক আয়ের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ। এটি তাদের শিক্ষা ও পরিচালনা ব্যয় মেটাতে সাহায্য করে। তাই চামড়ার ন্যায্যমূল্য পাওয়ায় তাদের সরাসরি আর্থিক স্বার্থ জড়িত।
৩. সামাজিক দায়বদ্ধতা:
ইসলামে সম্পদের ন্যায্য বণ্টন ও জুলুম প্রতিরোধের তাগিদ রয়েছে। মাদ্রাসাগুলো নিজেদের ধর্মীয় অবস্থান থেকে কৃষক ও সাধারণ মানুষের প্রতি জুলুম রোধ এবং ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করার নৈতিক দায়িত্ব পালন করতে পারে।
৪. কর্মসংস্থানের সুযোগ: মাদ্রাসা ভিত্তিক চামড়া শিল্প গড়ে উঠলে সংশ্লিষ্ট মাদ্রাসার শিক্ষার্থী ও স্থানীয় যুবকদের জন্য প্রশিক্ষণ, সংগ্রহ, প্রাথমিক প্রক্রিয়াজাতকরণ, বিপণন ইত্যাদি ক্ষেত্রে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে।
মাদ্রাসা ভিত্তিক সৎ উদ্যোক্তা ও শিল্প গড়ে তোলার রোডম্যাপ
১. প্রশিক্ষণ ও সক্ষমতা বৃদ্ধি:
* মাদ্রাসা শিক্ষক, পরিচালনা পর্ষদের সদস্য ও আগ্রহী শিক্ষার্থীদের চামড়া ব্যবসায়ের আধুনিক পদ্ধতি, মান নিয়ন্ত্রণ, সংরক্ষণ কৌশল, বাজার ব্যবস্থাপনা, হিসাবরক্ষণ এবং উদ্যোক্তা উন্নয়নে বিশেষ প্রশিক্ষণ দেওয়া প্রয়োজন।
* সরকারি সংস্থা (যেমন: বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশন-বিসিক), লেদারগুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (LFMEAB), এবং বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলো যৌথভাবে এই প্রশিক্ষণ দিতে পারে।
২. আর্থিক ও প্রযুক্তিগত সহায়তা:
* মাদ্রাসাগুলোকে সহজ শর্তে ঋণ প্রদান করতে হবে যাতে তারা প্রাথমিক সংগ্রহ কেন্দ্র, হিমাগার (চামড়া নষ্ট রোধে), শুকানোর যন্ত্রপাতি এবং প্রাথমিক প্রক্রিয়াজাতকরণ ইউনিট (নমুনকরন, লবণাক্তকরণ) স্থাপন করতে পারে।
* আধুনিক সংরক্ষণ প্রযুক্তি (কেমিক্যাল ট্রিটমেন্ট) সরবরাহ করতে হবে।
৩. সহযোগিতামূলক ব্যবসায় মডেল গঠন:
* একক মাদ্রাসার পরিবর্তে জেলাভিত্তিক বা অঞ্চলভিত্তিক মাদ্রাসা সমবায় সমিতি গঠন করা যেতে পারে। এই সমিতি একসাথে বড় আকারে চামড়া সংগ্রহ করবে, প্রক্রিয়াজাত করবে এবং সরাসরি বড় ক্রেতা (ট্যানারি বা এক্সপোর্ট হাউজ) এর সাথে দর কষাকষি করবে। এতে সংগ্রহ ক্ষমতা ও দরদপ্তর করার ক্ষমতা বাড়বে।
* এই সমিতি ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করবে – স্থানীয় বাজারমূল্যের একটি ন্যায্য ও স্থিতিশীল হার (সরকার বা সমিতি নির্ধারিত) পশু মালিককে দিবে।
৪. সরাসরি বাজার সংযোগ ও ব্র্যান্ডিং:
* সমবায় সমিতিগুলো সরাসরি ট্যানারি মালিকদের সাথে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি (Long Term Agreement - LTA) করতে পারে, সিন্ডিকেটের মধ্যস্বত্ব এড়িয়ে।
* "ইসলামিক ইকোনমি মডেল" বা "ন্যায্য বাণিজ্য চামড়া (Fair Trade Hide)" এর মতো নীতিমালা অনুসরণ করে একটি ব্র্যান্ড আইডেন্টিটি তৈরি করা যেতে পারে, যা দেশি-বিদেশি ক্রেতাদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা ও প্রিমিয়াম মূল্য পেতে সাহায্য করবে।
৫. সরকারি নীতিগত সহায়তা ও তদারকি:
* সরকারকে সিন্ডিকেটবিরোধী কঠোর অভিযান চালাতে হবে এবং চামড়া বাজারে স্বচ্ছতা ও প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করতে হবে।
* মাদ্রাসা ভিত্তিক এই উদ্যোগগুলোকে ট্যাক্স ছাড়, ভর্তুকি, প্রশিক্ষণ সহায়তা দিয়ে উৎসাহিত করতে হবে।
* কোরবানির সময় ন্যূনতম ক্রয়মূল্য (MSP) ঘোষণা এবং তা কঠোরভাবে বাস্তবায়নের ব্যবস্থা করতে হবে।
* মাদ্রাসা সমবায় সমিতিগুলোর জন্য ডেডিকেটেড ট্রেডিং প্ল্যাটফর্ম বা হেল্পডেস্ক তৈরি করা।
চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়
- প্রাথমিক বিনিয়োগ: আর্থিক সংস্থান একটি বড় চ্যালেঞ্জ। সরকারি অনুদান, ইসলামিক ব্যাংকগুলোর বিশেষ ঋণ স্কিম এবং CSR তহবিল কাজে লাগানো যেতে পারে।
- পেশাদার ব্যবস্থাপনা: ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের ব্যবসায়িক দক্ষতা নিয়ে সন্দেহ থাকতে পারে। তাই পেশাদার ব্যবস্থাপক নিয়োগ এবং স্বচ্ছ হিসাবরক্ষণ পদ্ধতি বাধ্যতামূলক করতে হবে।
- সিন্ডিকেটের বিরোধিতা: সিন্ডিকেটগুলি বাধা সৃষ্টি করবে। এজন্য সরকারের কঠোর অবস্থান, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সমর্থন এবং গণসচেতনতা অপরিহার্য।
- মান নিয়ন্ত্রণ: মাদ্রাসা নেটওয়ার্কের মাধ্যমে সংগৃহীত চামড়ার গুণগতমান নিশ্চিত করতে হবে যাতে ট্যানারি মালিকরা আস্থা রাখেন। প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তি সহায়তা এখানে মুখ্য।
উপসংহার: একটি সামাজিক-ধর্মীয়-অর্থনৈতিক বিপ্লবের সম্ভাবনা
কোরবানির চামড়ার বাজারকে সিন্ডিকেটের হাত থেকে মুক্ত করে সত্যিকার অর্থে জনকল্যাণমুখী ও ন্যায্য করতে হলে সৎ উদ্দোক্তার বিকল্প নেই। আর দেশের ব্যাপক নেটওয়ার্ক, জনগণের আস্থা এবং স্বার্থের জায়গায় অবস্থানকারী মাদ্রাসাগুলোই হতে পারে এই সৎ উদ্দোক্তা গড়ে তোলার সর্বোত্তম প্ল্যাটফর্ম। এটি শুধু চামড়ার ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করবে না, বরং মাদ্রাসা শিক্ষার অর্থনৈতিক ভিত্তি শক্তিশালী করবে, হাজার হাজার তরুণের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে, একটি ন্যায়ভিত্তিক ব্যবসায়িক মডেলের জন্ম দেবে এবং ধর্মীয় কর্তব্যের সাথে সামাজিক দায়িত্বের এক অনন্য সমন্বয় ঘটাবে।
এটি একটি জটিল কিন্তু অসম্ভব নয় এমন উদ্যোগ। এর জন্য দরকার সরকারের দূরদর্শী নীতি, মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষের আন্তরিকতা ও উদ্যোগ, বেসরকারি খাতের সহযোগিতা এবং সর্বোপরি জনগণের সমর্থন। সফল হলে, কোরবানির চামড়া ব্যবস্থাপনা বাংলাদেশে ইসলামিক অর্থনীতির একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে উঠতে পারে, যেখানে ধর্মীয় আচরণ, সামাজিক ন্যায়বিচার এবং অর্থনৈতিক বুদ্ধিদীপ্ততা একসাথে মিলিত হয়।
লেখক: ডিভিএম; এম এস ও পি এইচ ডি এবং সাধারন সম্পাদক, বাংলাদেশ লাইভস্টক সোসাইটি (বিএল এস)