জীবন ডাক দিয়ে যায়

মো রওশন জামাল জুয়েল: ‘আলাল কানা’- অন্ধ জহুরুল ইসলাম আলাল ভাইয়ের জন্য এই সভ্য সমাজের দেওয়া তাচ্ছিল্যভরা সম্বোধন। পাঁচটি ভাষার পন্ডিত (ইংরেজী ও আরবী ভাষায় মাস্টার ডিগ্রীসহ) জনাব জহুরুল ইসলাম আলাল ভাই তিন বছর বয়সে অন্ধ হয়ে যান বসন্ত রোগে আক্রান্ত হয়ে। আলাল ভাইয়ের স্মৃতিতে কোন সবুজ প্রকৃতি নেই, স্নিগ্ধ নদী নেই, সুনীল আকাশ নেই, গোধুলী-উষা নেই, দুঃখিনী মায়ের মায়াভরা মুখ নেই। তবুও স্বপ্ন আর সাহসের রঙ দিয়ে বর্ণময় করেছেন আলাল ভাইয়ের অন্ধ জীবন। তিনি সমাজের বোঝা নন, তিনি প্রতিদিন প্রদীপ জ্বালেন সমাজ থেকে আঁধার দুর করতে; এই সমাজকে আলো দিয়ে যান নিঃস্বার্থভাবে। সৃষ্টিকর্তা তাঁর চোখের দৃষ্টি কেড়ে নিলেও নক্ষত্রের আলোয় ভরে দিয়েছেন অন্তর, যে আলো দিয়ে তিনি দৃষ্টি সম্পন্ন মানুষের চেয়ে অনেক বেশী দেখেন।

দুর্দান্ত মেধাবী অন্ধ আলাল ভাই বালকবেলায় পাড়ার সাথিদের সাথে গোলাবাড়ী স্কুলে যাওয়া শুরু করেন। তাঁর মেধা ও প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে যান শিক্ষকরা। এক সময় বন্ধুদের সাথে ফিলিপনগর হাইস্কুলের ষষ্ঠ শ্রেণীর যাওয়া-আসা শুরু করেন। সবাই নিরুৎসাহিত করেন অন্ধদের পড়ার, পরীক্ষা নেওয়ার কোন সিস্টেমতো নেই। হঠাৎ একদিন শিক্ষক জনাব মো আবু তাহের স্যারের একটি তথ্য বদলে দেয় আলাল ভাইয়ের জীবন। জনাব আবু তাহের স্যার রাজশাহীতে পড়া অবস্থায় একজন অন্ধ বন্ধুকে ব্রেল পদ্ধতিতে পড়া ও পরীক্ষা দিতে দেখেছিলেন। আবু তাহের স্যারের উৎসাহে অন্ধ বালক আলাল চলে যায় রাজশাহীতে। এরপর সুদীর্ঘ ইতিহাস।

প্রতিভাবান আলাল ভাই হয়ে উঠেন ধীরে ধীরে ইংরেজী, আরবী, উর্দু, হিন্দি ও বাংলা ভাষার পন্ডিত। ভাষার পন্ডিত অন্ধ আলাল ভাইকে বেঁচে থাকার মত চাকুরীর ব্যবস্থা এই রাষ্ট্র-সমাজ করতে পারেনি। তিন গ্রামে এসে টিউটরিং শুরু করেন স্বল্প পরিসরে। পরে ফিলিপনগর গোলাবাড়ীতে একটি মাদ্রাসার যাত্রা শুরু হয় তাঁকে দিয়েই। মাদ্রাসাটি যখন এমপিওভুক্ত হয় তখন কর্তা ব্যক্তিগন সন্ধিহান ছিলেন অন্ধ শিক্ষক কিভাবে ছাত্র পড়াবে। যশোর শিক্ষা বোর্ডের প্রতিনিধির সামনে আলাল ভাই যখন অনর্গল ইংরেজীতে তাঁর জীবনের লড়াইয়ের গল্প বলা শুরু করেন তিনি কেঁদে ফেলেন এই বিরল প্রতিভা দেখে। আমার আব্বা উপস্থিত ছিলেন ঐ পরিদর্শনের সময়। আব্বা যতবার আলাল ভাইয়ের ঐ ঘটনাটা বলেন ততবারই কেঁদে ফেলেন। তিন বছর বয়সে আব্বারও গুটি বসন্ত হয়েছিলো। আল্লাহ আব্বার চোখ দুটি বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন।

পৃথিবীতে ভাষার দক্ষতাই সবচেয়ে বড় দক্ষতা। ভাষার দক্ষতা দিয়ে প্রতিভা পরিমাপের রীতি পৃথিবীতে এখনও খুব জনপ্রিয় (টোফেল, আইইলটিএস, জিআরই, পিটিই)। আমরা সারা জীবনে এক পাতা ইংরেজী ঠিক মত লিখতে পারিনা, শুদ্ধ করে বলতে পারিনা, আর আলাল ভাই পাঁচটা ভাষায় অনর্গল কথা বলতে পারেন। যে স্টাইলে ইংরেজী বললেন আলাল ভাই, আমি কয়েকটি ইংলিশ স্পিকিং কান্ট্রিতে পড়ালেখা করেও তার ধারে কাছেও যাওয়া সম্ভব নয়। কী বিরল প্রতিভা, কী অদম্য ইচ্ছা।

অস্ট্রেলিয়া থেকে আলাল ভাইয়ের সাথে একবার ফোনে কথা বলেছিলাম মাদ্রাসার প্রিন্সিপালের মাধ্যমে। খুব ইচ্ছে ছিলো দেশে ফিরে এসে দেখা করতে যাবো আলাল ভাইয়ের সাথে। আলাল ভাইয়ের ছোট্ট কুঠিরে গিয়ে আব্বার পরিচয় দিলে তিনি দরজা খুলে দিলেন। বসলাম আলাল ভাইয়ের শোবার চৌকিতে। ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে প্রায় তিন ঘন্টা আলাল ভাইয়ের জীবনের গল্প শুনলাম মনযোগ দিয়ে। কী ঝঞ্ঝাপূর্ণ অথচ বর্ণময় জীবন, কী দুঃসাহসী এক স্বপ্নচারী, কী আত্মপ্রত্যয়ী এক মানবতা। আলাপচারিতায় জীবন, সভ্যতা, আর সভ্যতার সংকট নিয়ে কী সুচিন্তিত বিশ্লেষণ আলাল ভাইয়ের। এই পৃথিবী, এই সমাজ তাকে তাচ্ছিল্য করেছে, ঠকাতে চেয়েছে, অপবাদ দিতে চেয়েছে। পাঁচটি ভাষার পন্ডিত এবতেদায়ী শাখায় (প্রাথমিক) শিক্ষকতার চাকুরী দিয়েও সমাজ মনে করেছে অনেক দিয়েছে তাকে। কারো প্রতি কোন অনুযোগ নেই আলাল ভাইয়ের। তিনি সকলের মঙ্গল চান।

অন্ধ আলাল ভাইয়ের অন্তরে আল্লাহ জ্বেলে দিয়েছেন কোরআনের আলো, ভাষার আলো, জ্ঞানের আলো। তিনি ঘুণে ধরা সমাজ-সস্কৃতি নিয়ে কথা বলতে গিয়ে যেভাবে আল কোরআন থেকে আরবিতে রেফারেন্স দিলেন, তরজমা করলেন আমার নিজেকে খুব অধম মনে হলো। কুসংস্কারমুক্ত সমাজ গড়াতে তাঁর সাধ্যের মধ্যে কাজ করে যাচ্ছেন তিনি। চরম অবক্ষয় থেকে সমাজকে বাচাতে তিনি কোরআনের জ্ঞান বিস্তারের উপর জোর দিলেন। তিনি বিদ্যমান মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা (দাখিল মাদ্রাসা) নিয়ে অত্যন্ত হতাশ; এই মাদ্রাসা শিক্ষা তথাকথিত ‘মডারেট ইসলামিজম’ প্রমোট করে। এখানে ঈমান, আকীদা আর তাকওয়ার চর্চা খুব কম হয়।

হাল জামানায় নানা রঙয়ের সেলিব্রিটিদের সংবর্ধনা দেওয়া হয়, সম্মাননা দেওয়া হয় অথচ প্রজন্মের দৃষ্টি সীমায় পড়ে না এমন জ্বলজ্বলে নক্ষত্র। দ্বীপ্তিমান নক্ষত্রসম আলাল ভাইয়েরা তৈলবাজির সমাজে হয়তো কোন তৈলের জোগান দিতে পারেন না কিন্তু তিনিই চরাঞ্চলের সবচেয়ে শিক্ষিত মানুষ, আলোকিত মানবতা, জ্ঞানের মশাল হাতে এক অদম্য শক্তি। ক্ষমা করবেন প্রিয় আলাল ভাই আমাদের। আপনাকে সম্মানিত করার মত কোন ভাষা আমার জানা নেই। আল্লাহ আপনার সম্মানকে সমুন্নত করুন।
লেখক: প্রজাতন্ত্রের একজন কর্মচারী