কৃষিপ্রেমী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান

কৃষিবিদ মো. তানজিবুল হাসান:সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলার গর্বিত স্বাধীন নাগরিক আমরা। যে স্বাধীনতার স্বোপান অর্জিত হয়েছে ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ, ত্রিশ লক্ষ শহীদ এবং প্রায় দুই লক্ষ মা বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে। আমি শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি বাঙালি জাতির জনক, স্বাধীনতার স্থপতি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে।

১৫ আগস্ট, বাঙালি জাতির জীবনে সবচেয়ে কলঙ্কময়, বেদনার দিন। যে কলঙ্ক থেকে বাঙালি জাতি আজও পুরোপুরি মুক্ত হতে পারেনি। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোর রাতে সেনাবাহিনীর কিছুসংখ্যক বিপদগামী সদস্য এ দেশেরই কিছু বেঈমানের প্রত্যক্ষ মদদে ধানমন্ডির বাসভবনে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে। ঘাতকরা শুধু বঙ্গবন্ধুকেই হত্যা করেনি, তাদের হাতে একে একে প্রাণ হারিয়েছেন বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিনী বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, বঙ্গবন্ধুর সন্তান শেখ কামাল, শেখ জামাল, শিশু শেখ রাসেলসহ পুত্রবধু সুলতানা কামাল ও রোজি জামাল। এ সময় বঙ্গবন্ধুর দু'কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা বিদেশে থাকায় প্রাণে রক্ষা পান।

বাংলার সর্বস্তরের মানুষের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর ছিল অটুট বন্ধন, প্রতিটি বাঙালির হৃদয়ে ছিল তার প্রতিচ্ছবি। তিনি ছিলেন এমন এক নেতা যার ব্যক্তিগত সম্পদ বলে কিছুই ছিল না। জনগণের জন্য সবকিছু উজাড় করে দিয়েছিলেন তিনি। জনগণের ভালোবাসাই ছিল তার একমাত্র সম্পদ। তাকে কোনো বাঙালি হত্যা করতে পারে এমন বিশ্বাস কোনো দিন ছিল না বঙ্গবন্ধুর মনে। আর তাই বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা ও ঘনিষ্ঠজনদের শত অনুরোধ উপেক্ষা করে রাষ্ট্রপতি হয়েও বঙ্গভবনের মতো সুরক্ষিত স্থানে না থেকে সাধারণ মানুষের মতো থেকেছেন ধানমন্ডিতে অরক্ষিত নিজ বাড়িতে। প্রতিটি মুহূর্ত থেকেছেন গরিব-দুঃখী মানুষের মাঝে। আর এটিই তার কাল হয়েছে। স্বাধীনতাবিরোধী ওই ঘাতকচক্র হত্যা করে বঙ্গবন্ধুকে। যা ছিল পৃথিবীতেও বিরল মর্মান্তিক ঘটনা।

বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ। গত শতাব্দীর সত্তরের দশকে কৃষিই ছিল এ দেশের অর্থনীতির প্রধান খাত। এ দেশের জনসংখ্যার সিংহভাগ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কৃষির সঙ্গে সম্পৃক্ত। এই কৃষিকে দেখে দেখেই বেড়ে উঠেছেন বঙ্গবন্ধু। কৃষি পরিবারে বেড়ে ওঠা বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ ও কৃষকদের জন্য সংগ্রামের মাধ্যমে স্বপ্ন দেখিয়ে একটি স্বাধীন দেশ এনেছিলেন। বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল চাবিকাঠি ছিল কৃষি ও কৃষক। কৃষি ও কৃষককে বাঁচিয়ে রাখার জন্য সর্বোপরি বাংলাদেশের কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি গড়ে তুলে সোনার বাংলাদেশ সফল করার জন্য বঙ্গবন্ধু নানাবিধ পদক্ষেপ নিয়েছিলেন  স্বাধীনতা উত্তর ১৯৭২ সালে দেশে খাদ্যশস্য উৎপাদন ছিল ১ কোটি ১০ লাখ মেট্রিক টন। সাড়ে ৭ কোটি মানুষের জন্য ওই খাদ্য পর্যাপ্ত ছিল না। খাদ্য ঘাটতি সংকুলানে বঙ্গবন্ধু সরকার স্বাধীনতার পর ২ বছর খাদ্যে ভর্তুকি প্রদান করেছে। ১ম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় কৃষি সেচ সুবিধায় বেশি বিনিয়োগ ধরা হয়েছিলো। বিজ্ঞান ভিত্তিক চাষের গুরুত্ব তিনি উপলব্ধি করেছিলেন তাইতো কৃষিবিদদের সাথে তার নিবিড় সম্পর্ক গড়ে ওঠে।

আর তারই ধারাবাহিকতায়, ১৯৭৩ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে তথা সমগ্র কৃষিবিদদের জন্য একটি ঐতিহাসিক দিন, কারণ এই দিনে বঙ্গবন্ধু এসেছিলেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সবুজ চত্বরে। তৎকালীন বাকসুর সাধারন সম্পাদক, বর্তমান সরকারের মাননীয় কৃষি মন্ত্রী, বরেণ্য কৃষিবিদ বীর মুক্তিযোদ্ধা ড. আব্দুর রাজ্জাক এমপি, কৃষিবিদদের প্রথম শ্রেণীর সম্মান দেবার বিষয় বঙ্গবন্ধুর কাছে উত্থাপন করার প্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধু কৃষিবিদদের প্রথম শ্রেণীর সম্মান দিয়ে বিজ্ঞান ভিত্তিক কৃষি শিক্ষায় উৎসাহিত করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু ভাষণে বলেছিলেন, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছি। সবুজ বিপ্লবের কথা আমরা বলছি। যুগ যুগ ধরে বাংলাদেশের যে অবস্থা, সত্য কথা বলতে কী বাংলার মাটি, এ উর্বর জমি বারবার দেশ-বিদেশ থেকে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিকে ও শোষকদের টেনে এনেছে এই বাংলার মাটিতে। এই উর্বর এত সোনার দেশ যদি বাংলাদেশ না হতো, তবে এতকাল আমাদের থাকতে হতো না।

বঙ্গবন্ধু প্রথম বাজেটে কৃষিখাতে সর্বোচ্চ বরাদ্দ রাখার ব্যবস্থা করেছিলেন। ২১ দফার প্রতিটা দফাই ছিল কোনো না কোনোভাবে কৃষি ও কৃষকের মঙ্গলকামি। বঙ্গবন্ধু স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার প্রত্যয়ে উল্লেখযোগ্য কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেন তন্মধ্যে, কৃষির উন্নতির জন্য সমবায় কৃষি ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন, বন্যা ও খরার হাত থেকে কৃষককে রক্ষার জন্য বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ করেন ও সরকারি ইজারাদারি প্রথা বিলুপ্ত করেন, বঙ্গবন্ধু কৃষকদের ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মওকুফ করেন এ কারণে কৃষি কাজে জড়িতরা উপকৃত হয়েছেন। খাজনা দেওয়ার অক্ষমতা ও জটিলতা হতে মুক্ত হয়ে কৃষকরা আনন্দে কাজ করে গেছেন।

সবুজ বিপ্লব কর্মসূচির আওতায় খাদ্য ঘাটতি কমিয়ে আনার নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, শ্মশান হওয়া বাংলাকে তিনি সোনার বাংলায় গড়ে তুলতে চান। তিনি বলেছিলেন " কৃষি খাদ্য বলতে শুধু ধান, চাল, আটা, ময়দা আর ভুট্টাকে বুঝায় না বরং মাছ, মাংস, ডিম, দুধ, শাকসবজি এসবকে বুঝায়।"

সুতরাং কৃষির উন্নতি করতে হলে এসব খাদ্যশস্যের সাথে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদের উৎপাদন বাড়াতে হবে। কৃষির প্রতি, কৃষি সম্প্রসারণের প্রতি, কৃষি উন্নয়নের প্রতি তাঁর আন্তরিকতা প্রকাশ পায়। বঙ্গবন্ধু ভাবতেন সবার আগে দরকার খাদ্যের। খাদ্যের নিশ্চয়তা না দিতে পারলে সব উন্নয়ন কার্যক্রম বিফলে যাবে। সুতরাং নিজেদের প্রয়োজনীয় খাদ্য নিজেরা উৎপাদন করতে হবে।

প্রাতিষ্ঠানিক কৃষি উন্নয়ন তথা কৃষি এবং কৃষকের কথা ভেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের জনগণের ক্ষুধা ও দারিদ্র্য মুক্তির লক্ষ্যে কৃষি উন্নয়নের বৈপ্লবিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেন এ কারণেই তিনি কৃষিভিত্তিক প্রতিষ্ঠান স্থাপন, পুনঃসংস্করণ, উন্নয়ন এবং ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল, বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন, উদ্যান উন্নয়ন বোর্ড, তুলা উন্নয়ন বোর্ড, বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সি, ইক্ষু গবেষণা প্রতিষ্ঠান, মৎস্য উন্নয়ন কর্পোরেশনসহ অনেক নতুন প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি করেন। কৃষি বিষয়ক বিদ্যমান বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানগুলোর কাঠামো ও কার্যক্রমের আমূল পরিবর্তন ও সংস্কারের মাধ্যমে এবং প্রযুক্তি চর্চায় মেধা আকর্ষণের যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন।

জাতির জনক বলেছেন, খাদ্যের জন্য অন্যের ওপর নির্ভর করলে চলবে না। আমাদের প্রয়োজনীয় খাদ্য আমাদেরই উৎপাদন করতে হবে। কৃষি উপকরণে বঙ্গবন্ধুর চিন্তাচেতনা যা ছিল আজ এত বছর পরেও আশ্চর্য হতে হয়। কৃষিশিক্ষা, মানসস্মত বীজ উৎপাদন এবং বিতরণ, সুষ্ঠু সার ও সেচ ব্যবস্থাপনা, কৃষিতে ভর্তুকি, বালাই ব্যবস্থাপনা, সমন্বিত ফসল ব্যবস্থাপনা, খামারভিত্তিক ফসল ব্যবস্থাপনা, সমবায়ভিত্তিক চাষাবাদ, ভেঙে যাওয়া অর্থনীতি পুনর্গঠন, মিল্কভিটা পুনর্গঠন, সার, সেচ, বীজ বিষয়ক কার্যক্রম এসবের ওপর সর্বাত্মক জোর দিয়েছেন। কেননা তিনি জানতেন এগুলো যথাযথভাবে না করতে পারলে আমরা অনেক পিছিয়ে যাবো। বিশেষ করে রাসায়নিক সারের বিষয়ে তিনি বলেছেন, আমাদের যে সার কারখানাগুলো আছে এগুলোকে নিশ্চিত উৎপাদনমুখী করতে হবে বেশি করে।

গবাদিপশুর কথাও বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন। গরু দিয়ে হাল চাষ, গরুর গোবর জমিতে প্রয়োগ করে জমির উর্বরতা বাড়ানোর তাগিদ তিনি তখনই দিয়েছেন। বর্তমানে জনসংখ্যার প্রায় ২০ শতাংশ প্রত্যক্ষ ও ৫০ শতাংশ পরোক্ষভাবে প্রাণিসম্পদ খাতের উপর নির্ভরশীল। বর্তমান সরকারের নির্বাচনী অঙ্গীকার 'আমার গ্রাম আমার শহর' বাস্তবায়নে ২০২৩ সালের মধ্যে গবাদিপশুর উৎপাদন দ্বিগুণ করার লক্ষ্য অর্জিত হবে ইনশাআল্লাহ।

১৯৭২ সালের ৪ জুলাই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, ‘মাছ হবে দ্বিতীয় প্রধান বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী সম্পদ।’ বঙ্গবন্ধুর সেই স্বপ্নকে বাস্তবায়নের লক্ষ্যেই বর্তমানে জননেত্রী শেখ হাসিনার সুযোগ্য নেতৃত্বে করোনাকালে বিপর্যয়ের মাঝে সুখবর নিয়ে এসেছে দেশের মৎস্য খাত। বিশ্বে মাছ উৎপাদন বৃদ্ধিতে ২০১৯ সালে দ্বিতীয় স্থানে উঠে এসেছে বাংলাদেশ। গত বছর রেকর্ড পরিমাণ মাছ উৎপাদন হয়েছে দেশে। স্বাদুপানির মাছ উৎপাদনে তৃতীয় স্থান ধরে রেখেছে বাংলাদেশে।

বঙ্গবন্ধুর আজীবনের লালিত স্বপ্ন ছিল- এদেশের শোষিত, বঞ্চিত, অবহেলিত কৃষকের মুখে হাসি ফোটানো, তাই তিনি কৃষি খাতকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব ও অগ্রাধিকার প্রদানের পাশাপাশি কৃষি উন্নয়নের সৈনিক কৃষিবিদদের যথাযোগ্য সম্মান ও মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করেছিলেন। এজন্য বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়তে আমরা সবাই বদ্ধপরিকর। আমাদের প্রয়োজন সমন্বিত, আন্তরিক এবং কার্যকর পদক্ষেপ। বঙ্গবন্ধু একটি নতুন মানচিত্র চেয়েছিলেন, নতুন ভূ-খণ্ড চেয়েছিলেন, নতুন জাতিসত্তা চেয়েছিলেন, চেয়েছিলেন একটি স্বনির্ভর-সুখী মানুষের সোনার বাংলাদেশ।

পৃথিবীতে বাঙালি জাতি যতদিন থাকবে- ততদিনই থাকবে বঙ্গবন্ধুর নাম, তাঁর কর্ম। আমরা বঙ্গবন্ধুকে হারানোর শোককে শক্তিতে রূপান্তর করবো ইনশাআল্লাহ এবং দেশ গঠনে আত্মনিয়োগ করে জাতির পিতার কৃষিসমৃদ্ধ স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার যে স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন, আমাদের দায়িত্ব হবে- দেশকে একটি সুখী ও সমৃদ্ধ দেশে পরিণত করে জাতির জনকের সে স্বপ্ন পূরণ করা এবং জননেত্রী শেখ হাসিনার হাতকে শক্তিশালী করে ভিশন ২০৪১ এ দেশকে উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত করা। বাঙালি জাতিকে বিশ্বে মাথা উচু করে বাঁচার প্রয়াসে সকলকে সম্মিলিতভাবে সচেষ্ট হতে হবে, তা হলেই তার আত্মা শান্তি পাবে এবং আমরা এ মহান নেতার প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করতে পারব। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।

লেখকঃ মহাসচিব, বাংলাদেশ এনিম্যাল হাজবেন্ড্রী এসোসিয়েশন (বাহা), ঢাকা মহানগর ও বিভাগ।