পদ্মা সেতু-সোনালী স্বপ্ন: কৃষি পণ্যের সঠিক দাম, বাজারজাতকরন ও উৎপাদন বাড়বে

ড. জগৎ চাঁদ মালাকার:পদ্মা বহুমুখী সেতু হল গঙ্গার প্রধান শাখা পদ্মা নদীর উপর নির্মিত একটি বহুমুখী সড়ক-রেল সেতু যা বাংলাদেশের নিজস্ব অর্থায়নে বাস্তবায়িত হয়। সেতুটি মুন্সীগঞ্জকে শরীয়তপুর এবং মাদারীপুরের সাথে সংযুক্ত করে, এবং দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলকে উত্তর ও পূর্বাঞ্চলের সাথে সংযুক্ত করে। পদ্মা বহুমুখী সেতু বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং নির্মাণ প্রকল্প সমূহের মধ্যে অন্যতম হিসেবে বিবেচিত। যে কোনো দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে যোগাযোগ ব্যবস্থা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যোগাযোগ ব্যবস্থার ওপর নির্ভর করে একটি দেশের উন্নয়ন কর্মকান্ড আবর্তিত হয়।

যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হলে কৃষিপণ্য, শিল্পের কাঁচামাল এবং শিল্পজাত পণ্যসামগ্রী সহজে ও স্বল্প ব্যয়ে স্থানান্তর করতে সুবিধা হয়। এর ফলে দেশের উৎপাদন বৃদ্ধি পায়, শিল্প ও ব্যবসার প্রসার ঘটে। এজন্য যোগাযোগ ব্যবস্থাকে অর্থনৈতিক উন্নয়নের হাতিয়ার হিসেবে বিবেচনা করা হয়। পদ্মা সেতু এক্ষেত্রে অর্থনীতির ভিত্তি ও সোনালি সোপান হিসেবে কাজ করবে। পদ্মা সেতুর কারণে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অর্থনীতির চাকা ঘুরে যাবে দ্রুত বেগে। বাড়বে জীবনযাত্রার মান ও কর্মসংস্থান। এই পদ্মা সেতুর বাস্তবায়নের ফলশ্রুতিতে পার্শ্ববর্তী দেশসমূহ থেকে খাদ্য দ্রব্যসহ সকল ধরনের পন্য আমদানি ও রপ্তানি করা সহজলভ্য হবে।

পদ্মা নদী পৃথিবীর উত্তাল বা খরস্রোতা নদীগুলোর মধ্যে একটি। জলপ্রবাহের দিক থেকে দক্ষিণ আমেরিকার আমাজনের পর এই নদীটি দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে। এত উত্তাল নদীর ওপর আর কোনো সেতু এই পর্যন্ত নির্মিত হয়নি। সেতুটি ৬.১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এবং ১৮.১০ মিটার প্রসস্থ। পদ্মা সেতুর ব্যয় ৩০,১৯৩ কোটি।

অর্থনৈতিক গুরত্ব:
দক্ষিণাঞ্চলের ২১টি জেলার সঙ্গে ঢাকার যোগাযোগ ২ থেকে ৪ ঘণ্টা কমে যাবে। রাজধানীর সাথে সরাসরি যোগাযোগ ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার, কাঁচামাল সরবরাহ এবং শিল্পাঞ্চল সহজতর করতে সহায়তা করবে। গড়ে উঠবে ছোট-বড় শিল্প এবং কৃষির ব্যাপক উন্নতি হবে। কৃষকরা পণ্যের দাম ভালো পাবেন এবং ফলে উৎপাদন বাড়বে। দক্ষিণের জেলা সমূহের বার্ষিক জিডিপি বাড়বে এবং দেশের সামগ্রিক জিডিপি বাড়াতে সাহায্য করবে। সেতুটি নির্মাণের ফলে দেশের সমন্বিত যোগাযোগ কাঠামোর উন্নতি হবে। ভারত, ভুটান ও নেপালের সঙ্গে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক যোগাযোগ থাকবে। সেতুর দুই পাশে গড়ে তোলা হবে অর্থনৈতিক অঞ্চল, হাইটেক পার্ক ও বেসরকারি শিল্প শহর। ফলস্বরূপ, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বাড়বে। মংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দর নতুন উদ্দমে চালু থাকবে। পর্যটন শিল্পের বিকাশ ঘটবে এবং দক্ষিণাঞ্চলের কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত, সুন্দরবন, ষাট গম্বুজ মসজিদ, টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর মাজার, মাওয়া ও জাজিরায় পুরনো-নতুন রিসোর্টসহ নতুন-পুরনো পর্যটনকেন্দ্র দেশি-বিদেশি পর্যটকদের আকৃষ্ট করবে।পদ্মা সেতু চালু হলে পরিবহন খাতে ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে।

পদ্মা সেতু চালু হলে শুধু যোগাযোগ ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনই নয়, বৈচিত্র আসবে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পরিবহন ব্যয়সহ বিভিন্ন খাতে। পদ্মা সেতুর মাধ্যমে একদিকে যেমন দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গে রাজধানীর সরাসরি যোগসূত্র তৈরি হবে, ঠিক তেমনি এই সেতু ঘিরে দক্ষিণাঞ্চলে নতুন নতুন শিল্পকারখানা গড়ে উঠবে। এর মাধ্যমে কর্মসংস্থানের নতুন সুযোগ সৃষ্টি হবে। পদ্মা সেতুর কারণে সবচেয়ে বেশি সুবিধা হবে কৃষিজাত পণ্যের বাজারজাত করণে পরিবহনের ক্ষেত্রে। সেতুর কারণে কৃষক তার পণ্যের সঠিক মূল্য পাবেন।
 
আমাদের দেশের অর্থনীতি একটি শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়েছে। আগামী ২৫ জুন পদ্মা সেতু উদ্বোধনের মাধ্যমে দেশের যোগাযোগের ক্ষেত্রে একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে বলেই সবার বিশ্বাস। বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের সাথে অন্যান্য অঞ্চলের যোগাযোগ সহজ হওয়ার মাধ্যমে একদিকে যেমন অন্তর্দেশীয় সহযোগিতা বৃদ্ধি পাবে, ঠিক তেমনিভাবে আঞ্চলিক ক্ষেত্রেও যোগাযোগ বৃদ্ধি পাবে বলে সবাই প্রত্যাশা করেছে। যোগাযোগ এবং অর্থনীতির ওপর পদ্মা সেতুর ইতিবাচক প্রভাব বাংলাদেশের সার্বিক অর্থনীতিকে ইতিবাচক ভাবে প্রভাবিত করবে বলে সবার বিশ্বাস। এই সার্বিক কর্মকান্ড সাহসিকতার সাথে পরিচালনার জন্য জাতির জনকের সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে সাহসী সিদ্ধান্ত নিয়ে ছিলেন সেই সিদ্ধান্তের কারণে খরস্রোতা পদ্মার ওপর আজকের এই সেতু নির্মিত হয়েছে। বাংলাদেশের মানুষ এই সেতু ব্যবহারের ফলে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সকল স্তরের মানুষের হৃদয়ে চির অম্লান হয়ে থাকবেন।

আমরা জানি যে, দক্ষিণবঙ্গ থেকে লবণাক্ত পানির মাছ বাংলাদেশসহ দেশের বাইরে পাঠানো হয়। কিন্তু যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে মাছ চাষিদের জন্য মাছ পরিবহন ব্যয়বহুল ছিল। পদ্মা সেতু কারনে মাছ ও অন্যান্য পণ্য খুব অল্প সময়ের মধ্যেই ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য স্থানে পৌঁছানো সম্ভব হবে।

তাছাড়া এ অঞ্চলের মানুষের যাতায়াতের সময় অনেক কমে যাবে। এমনকি পদ্মা সেতু ব্যবহারের মাধ্যমে আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশসহ অন্যান্য দেশের সাথে আঞ্চলিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে একটি নতুন দিগন্ত উন্মুক্ত হবে, যা অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব থাকবে সেটি নিঃসন্দেহে বলা যায়।

পদ্মা বহুমুখী সেতু পুরো বাংলাদেশের অর্থনীতিই বদলে দেবে। আরও বিশদভাবে বলতে গেলে এই সেতু দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার যোগাযোগ, বাণিজ্য, পর্যটনসহ অনেক ক্ষেত্রেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। সব মিলিয়ে এই সেতু আসলেই দেশের মানুষের স্বপ্নের সেতু হয়ে উঠবে। এছাড়া এ সেতুটি ভবিষ্যতে  ট্রান্স-এশীয় রেলপথের অংশ হবে। তখন যাত্রীবাহী ট্রেন যত চলবে, তার চেয়ে অনেক অনেক বেশি চলবে মালবোঝাই ট্রেন। ডাবল কনটেইনার নিয়ে ছুটে চলবে ট্রেন। ঢাকা ও চট্টগ্রামের সঙ্গে যুক্ত হবে মংলা ও পায়রা বন্দর। অর্থনীতিতে যুক্ত হবে নতুন সোনালি স্বপ্ন এবং দেশের প্রবৃদ্ধিতে এ সেতু ব্যাপক ভূমিকা পালন করবে।

পদ্মা সেতুকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের প্রথম কোনো সমন্বিত যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে উঠবে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল এমনিতেই কৃষিতে উন্নত। কৃষিপণ্য খুব সহজেই ঢাকায় চলে আসবে। মংলা ও পায়রা বন্দর এবং বেনাপোল স্থলবন্দরের সঙ্গে রাজধানী ও বন্দরনগর চট্টগ্রামের সরাসরি যোগাযোগ স্থাপিত হবে। পুরো দেশের অর্থনীতিতে এর প্রভাব পড়বে। কৃষি, শিল্প, অর্থনীতি, শিক্ষা, বাণিজ্য সব ক্ষেত্রেই এই সেতুর বিশাল ভূমিকা থাকবে। দক্ষিণাঞ্চলের কুয়াকাটা ও সুন্দরবনসংলগ্ন ছোট ছোট বিভিন্ন দ্বীপ মালদ্বীপের মতো পর্যটন-উপযোগী করা যাবে। কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকত, সুন্দরবন ও পায়রা বন্দরকে ঘিরে দেখা দেবে পর্যটনের বিপুল সম্ভাবনা। দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন চর ও দ্বীপকে কেন্দ্র করে মালদ্বীপের মতো পর্যটনের বিশাল জগৎ তৈরি হবে এবং দেশের অর্র্থনৈতিক উন্নতি সাধিত হবে। পদ্মা সেতু হলে কক্সবাজারের চেয়ে কম সময়ে সুন্দরবন ও কুয়াকাটায় পৌঁছানো সম্ভব হবে।

নদীর দুই তীরে আসলেই আধুনিক নগর গড়ে তোলা সম্ভব। তবে সেজন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করা যেতে পারে। এরই মধ্যে বেশকিছু আবাসন প্রকল্প গড়ে উঠেছে। এই সেতু ঘিরে কী কী হতে পারে, কোথায় শিল্পকারখানা হবে, কোথায় কৃষিজমি হবে সেসব ভেবেচিন্তে করতে হবে। এই সেতুকে ঘিরে পর্যটনে যুক্ত হবে নতুন মাত্রা। অনেক আধুনিক মানের হোটেল, মোটেল ও রিসোর্ট গড়ে উঠবে। এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আঞ্চলিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে এই সেতু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে দক্ষিণাঞ্চলের ২১ জেলার প্রায় ছয় কোটি মানুষের ভাগ্যে পরিবর্তন আনবে এই পদ্মা সেতু। ২০৩৫-৪০ সালে বাংলাদেশ যে উন্নত দেশ হবে, সে ক্ষেত্রে এই সেতু নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। সব মিলিয়ে বলা যায়, স্বপ্নের এই সেতুকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হবে ভবিষ্যতের বাংলাদেশ। সোনালি স্বপ্ন এখন কল্পনা নয়, সত্যিই দৃশ্যমান এবং অনেক স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নিচ্ছে।

শেষ কথা:
অর্থনীতিবিদদের পর্যবেক্ষণ ও বিশ্বাস যে, পদ্মা সেতুর প্রভাবে দেশের সার্বিক দারিদ্র্য সূচক কমবে। মানুষের আয়-রোজগার বাড়বে। যোগাযোগ উন্নয়নসহ দেশের মানুষের সার্বিক স্বাচ্ছন্দ্য বাড়বে, মানব উন্নয়ন সূচকের অগ্রগতি হবে। যানবাহনের টোল প্রদান ও টোল আয় ও এ প্রবৃদ্ধিতে যুক্ত হবে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি, জিডিপি প্রবৃদ্ধি, বিভিন্ন সামাজিক সূচকে ক্রমবর্ধমান অগ্রগতি এখন আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। যেকোনো দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে যোগাযোগ ব্যবস্থা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যোগাযোগ ব্যবস্থার ওপর নির্ভর করে একটি দেশের উন্নয়ন কর্মকান্ড আবর্তিত হয়। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হলে কৃষিপণ্য, শিল্পের কাঁচামাল এবং শিল্পজাত পণ্যসামগ্রী সহজে ও স্বল্পব্যয়ে স্থানান্তর করতে সুবিধা হয়। এর ফলে দেশের উৎপাদন বৃদ্ধি পায়, শিল্প ও ব্যবসার প্রসার ঘটে। এজন্য যোগাযোগ ব্যবস্থাকে অর্থনৈতিক উন্নয়নের হাতিয়ার হিসেবে বিবেচনা করা হয়। পদ্মা সেতু এক্ষেত্রে অর্থনীতির ভিত্তি ও সোনালি সোপান হিসেবে কাজ করবে।

পদ্মা সেতুর কারণে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অর্থনীতির চাকা ঘুরে যাবে দ্রুত বেগে। বাড়বে জীবনযাত্রার মান ও কর্মসংস্থান। এই একটি মাত্র আত্মবিশ্বাসী যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত দৃঢ়চেতা, সফল, জনকল্যাণকামী রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনাকে সারা বিশ্বে মর্যাদার আসনে আসীন করেছে। তাই বলতে ইচ্ছে করছে, জয়তু দেশরত্ন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ সেতু প্রকল্পের সফল বাস্তবায়ন মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর মতো আমার ও দেশবাসীর স্বপ্নের বাস্তবায়ন।

লেখক:প্রকল্প পরিচালক
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, খামারবাড়ি, ঢাকা -১২১৫।