ব্রিটিশ বাহিনীর হয়ে বিশ্বযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন নওগাঁর কছির উদ্দিন আকন্দ-চান রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি

কাজী কামাল হোসেন, নওগাঁ:ব্রিটিশ বাহিনীর হয়ে বিশ্বযুদ্ধে অংশ নেয়া নওগাঁ সদর উপজেলার তিলকপুর ইউনিয়নের নগর কুসুম্বি গ্রামের কছির উদ্দিন আকন্দের বয়স ১০০ ছুঁই ছুঁই। ১৯২৫ সালে জন্ম নেয়া এ বৃদ্ধকে দেখে বোঝার উপায় নেই পৃথিবীর ইতিহাসের ভয়াবহতম দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বীর সৈনিক তিনি। বীরত্বের জন্য বেশ কিছু পদকও পেয়েছেন তিনি। যুদ্ধের ভয়াবহতার প্রত্যক্ষদর্শী এ বৃদ্ধ পরে সৈনিকবৃত্তি ছেড়ে বেসামরিক জীবনে ফিরেও এসেছিলেন।

কছির উদ্দিন আকন্দ এখনো কারো সহায়তা ছাড়াই ঘরে বাইরে চলা ফেরা করতে পারেন। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন মসজিদে গিয়ে। চশমা ছাড়াই বাড়িতে কোরান শরীফ ও পত্রিকা পড়েই সময় কাটে তার। স্মরণশক্তিও আছে আগের মতো।

১৯৩৯ সালের ১লা সেপ্টেম্বর শুরু এবং ১৯৪৫ সালের ২ সেপ্টেম্বর শেষ হওয়া  দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের এক পক্ষে ছিল ব্রিটিশ, আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং অন্য পক্ষে ছিল জার্মানি, জাপান ও ইতালি। ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান আর্মির হয়ে বিশ্বযুদ্ধে লড়াইকারী পূর্ববাংলার যুদ্ধফেরত নয়জন বাংলাদেশী সৈনিকের তথ্য পাওয়া যায়, যারা এখনো বেঁচে রয়েছেন। বিশ্বযুদ্ধে অবদান ও ব্রিটিশ সশস্ত্র বাহিনীর সাবেক সদস্য হিসেবে ব্রিটিশ সরকারের কাছ থেকে ভাতা-সহায়তাও পাচ্ছেন তারা। পিএনআর (পাইওনিয়ার কোর) কছির উদ্দিন আকন্দ এদের মধ্যে অন্যতম।

পূর্ববাংলা তথা বাংলাদেশে যারা এখনো বেঁচে রয়েছেন তারা হলেন, পিএনআর (পাইওনিয়ার কোর) কছির উদ্দিন আকন্দ, হাবিলদার  সাবেদ আলী সরকার, ল্যান্স নায়েক আব্দুল মান্নান, ল্যান্স কর্পোরাল সামছুদ্দিন, সৈনিক মতিয়ার রহমান, সৈনিক আবুল হোসেন, স্যাপার নূর মোহাম্মদ, ল্যান্স কর্পোরাল নূর মোহাম্মদ ও হাবিলদার নজির আহমেদ।

যুদ্ধকালীন অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে কছির উদ্দিন আকন্দ জানান, ১৯৪৪ সালের ৫ মার্চ সৈনিক হিসেবে নিয়োগ পান তিনি। কলকাতায় এক মাসের রাইফেল ট্রেনিংয়ের পর ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান আর্মির পাইওনিয়ার (পিএনআর) পদে যুক্ত হন। বোম্বাইয়ে (বর্তমান মুম্বাই) জাপানি বিমান হামলার পর বেশ কিছুদিন শহরটির পুনর্নিমাণ কাজে অংশ নেন। এরপর পুনেতে সম্মুখযুদ্ধের প্রশিক্ষণ দিয়ে তাকে পাঠানো হয় বার্মায়(বর্তমান মায়নমার)। সেখানে বিশাল এবং ঘন অরণ্যে হিংস্র নানা জীবজন্তুর মধ্যে অত্যন্ত কষ্টকর দিন কেটেছে তাদের। সেখানে বাহিনীর অন্য সদস্যদের সাথে কথা বলাও ছিল দুষ্কর। সেখানে আফ্রিকানসহ ১১ জাতির সৈন্য দিয়ে তাদের ইউনিটটি গড়ে তোলা হয়েছিল।

প্রায় এক বছর জঙ্গলে থেকে যুদ্ধ করার পর জাপানী বাহিনীকে দমনে সক্ষম হন তারা। পরে এক মাসের ছুটি নিয়ে নওগাঁয় নিজ বাড়িতে চলে আসেন তিনি। ছুটি কাটানোর পর তিনি যোগদেন কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে। এরপর আবারো তাকে পাঠানো হয় বার্মায়। সেখানে জাপানী যুদ্ধবন্দীদের দিয়ে যুদ্ধবিধ্বস্ত এলাকার পুনর্গঠন কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তিনি।

তিনি বলেন, ‘যুদ্ধে অংশগ্রহণের স্বীকৃতি হিসেবে ১৯৩৯-৪৫ স্টার, বার্মা স্টার মেডেল, ওয়ার মেডেল ১৯৩৯-৪৫ পেয়েছি। ১৯৪৮ সালের ১৭ আগস্ট সেনাবাহিনীর চাকরি থেকে অবসর নিয়ে বাড়ি ফিরে এসেছি। বর্তমানে তিন মাস পরপর সশস্ত্রবাহিনী রাজশাহী ডিএএসবি অফিস থেকে ১৬ হাজার টাকা ভাতা পাই। সেটা দিয়েই কোনোভাবে খাবার ও ওষুধ খেয়ে বেঁচে আছি। ৯৭ বছর বয়স হয়েছে আমার। বার্ধক্যজনিত কারণে বিভিন্ন রোগব্যাধি বাসা বেঁধেছে শরীরে।’

তিনি আরোও বলেন, যুদ্ধ শেষে তাকে যুক্তরাজ্যে যাওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল ব্রিটিশ সরকার। দেশের কথা ভেবে দেশেই ফিরে আসেন তিনি। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ‘দেশে মুক্তযোদ্ধাদের রাষ্ট্রিয় ভাবে মূল্যায়ন করা হচ্ছে। আমাকে তো কেউ মূল্যায়ন করছেনা। কেউ আমায় কখনো ডাকেনা, খোঁজ খবর নেয়না।  হয়তো যেকোনো দিন আমি মরে যাবো। মৃত্যুর পরে নয়, আমি বেঁচে থাকতেই রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি চাই।’

নওগাঁ জেলা প্রশাসক খালিদ মেহেদী হাসান পিএএ বলেন, ‘দেশের প্রতিটি বয়স্ক নাগরীকদের জন্য আমাদের সহানুভুতি এবং সহযোগীতা সবসময় থাকে। ব্রিটিশ বাহিনীর হয়ে বিশ্বযুদ্ধে অংশ নেয়া কছির উদ্দিন আকন্দের অবদানকে আমরা শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আমরা যেসব সুযোগ-সুবিধা প্রদান করে থাকি তা মূলত ১৯৭১ সালে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহনকারী বীর সেনাদের জন্য। অন্য কোন যুদ্ধে অংশগ্রহনকারীদের জন্য নয়। তিনি যেহেতু ব্রিটিশ সরকারের পাঠানো এবং বাংলাদেশ সরকারের সশস্ত্রবাহিনী কর্তৃক প্রদত্ত সম্মানী ভাতা পেয়ে আসছেন তার জন্য এর চেয়ে বড় স্বীকৃতি আর কি হতে পারে। তার পরেও জেলা প্রশাসনের তরফ থেকে তার জন্য যা-যা করা সম্ভব আমি তার সবটুকু করার চেষ্টা করবো।’