বর্ষার পরে বোরো মৌসুমেও পর্যটন সম্ভাবনার হাওর

কৃষিবিদ ড. মো. হুমায়ুন কবীর: দেশে এখন বোরো মৌসুম চলছে। এ মৌসুমটি বাংলাদেশের কৃষির ক্ষেত্রে অনেক গুরুত্বপূর্ণ। সারাদেশে যে পরিমাণ বোরো ধান উৎপাদিত হয় তার সিংহভাগ উৎপাদিত হয় হাওরাঞ্চলে। অর্থাৎ পরিসংখ্যান বলে দেশের বোরো উৎপাদনের প্রায় একপঞ্চমাংশ হাওরাঞ্চলে উৎপাদিত হয়। সম্প্রতি হাওর নিয়ে বেশ আলোচনা উঠে এসেছে এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য সম্পর্কিত বিষয়কে ঘিরে। সেখানকার সাবমারজিবল ও অলওয়েদার খ্যাত নবনির্মিত রাস্তা-ঘাট পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সমর্থ হয়েছে। কাজেই হাওর নিয়ে এখন ভ্রমণ পিপাসুদের আগ্রহের অন্ত নেই। আর হাওরের একমাত্র ফসল বোরোধান হওয়ায় এর অর্থনৈতিক গুরুত্বও অনেক। একদিকে অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ও অন্যদিকে প্রাকৃতিক সৌন্দয্যমন্ডিত হওয়ায় দিন দিনই হাওরের গুরুত্ব বেড়ে চলেছে। আর সেকারণেই বিষয়টি সামনে নিয়ে আলোচনার অবকাশ রয়েছে।

হাওর মানেই বিস্তির্ণ দিগন্তজুড়া ফসলের মাঠ। আবার বর্ষাকালে যেখানে থৈ থৈ পানি। সবগুলোই দৃষ্টি নন্দন বিষয়। এর নান্দনিকতা আরো বহুগুণে বৃদ্ধি পায় সা¤প্রতিক হাওর উন্নয়নে গৃহীত কার্যক্রমে। এক সময় হাওরের কথা শুনলেই গা শিহরিয়া উঠত। কোন সরকারি চাকুরে তার পোস্টিং নিয়ে হাওরে যেতে চাইতেন না। কিন্তু এখন সময় পাল্টেছে। এমন সময় খুব দূরে নয় যখন সেখানে তদবির করে যেতে চাইবেন অনেকে। কারণ সেখানকার প্রাকৃতিক পরিবেশ সম্পূর্ণ দুষণমুক্ত। সরাসরি নদীর তাজা মাছ, ক্ষেতের তরি-তরকারি, শাক-সবজি, চাল-ডাল, ডিম-দুধ, দেশীয় ফল-মূল ইত্যাদি সহজেই পাওয়া যায় সতেজ ও সুলভমূল্যে।
 
এইতো মাত্র গতবছরের (২০২১) নভেম্বর-ডিসেম্বরে যেসব এলাকা ছিল একেবারে পানির নিচে আর মাত্র ২-৩ মাসের ব্যবধানে এখন সেসব এলাকাই সবুজের সমারোহে ভরপুর। সড়কের মাঝখানে দাঁড়িয়ে চারিদিকে তাকালে যেন প্রাণ-মন জুড়িয়ে যায়। বোরো ধানের আবাদের জন্য খুবই উপযুক্ত এলাকা এটি। আমি আগেই উল্লেখ করেছি, সারাদেশের বোরো উৎপাদনের একটি বড় অংশ উৎপাদিত হয় এই হাওরাঞ্চলে। এখানে একমাত্র ফসল বোরো হওয়ায় কৃষককে আশা-নিরাশার দোলাচলে দুলতে হয় সর্বদা। কারণ আমরা জানি, বোরো ফসলের উৎপাদন ও সংগ্রহ দুটোই খুব গুরুত্বপূর্ণ। উৎপাদন যতই হোক না কেন, যদি সেটি সময়মত সংগ্রহ ও মাড়াই করা না যায় সেটি বিপর্যয় ডেকে আনে।   

আমরা পুরো বর্ষা মৌসুমে যখন হাওরে ভ্রমণ করি তখন একধরনের প্রাকৃতিক পরিবেশ দেখি আবার যখন এ শুস্ক মৌসুমে সেখানে যাই সম্পূর্ণ উল্টো চিত্র ও পরিবেশ দেখতে পাবো। শীতকালে বোরোধান রোপনের সময়। আর তখন পানি কম থাকে বিধায় সেখানে দেশি জাতের সুস্বাদু মাছগুলো ধরা পড়তে থাকে। আবার এখনকার ওয়েদারে শুধু সবুজের সমারোহ। যেদিকেই তাকানো যায় দিগন্তজুড়া শুধু সবুজ আর সবুজ। আর মাত্র কয়েকদিন পরেই আবার সেখানকার প্রাকৃতিক পরিবেশ হবে অন্যরকম। তখন ধানের শীষ বের হবে। তারপর ধান পাকতে শুরু করবে। কাজেই যারা ভ্রমণ পিপাসু এবং সৌন্দর্য্যপ্রিয় তারা যেকোন সময়েই হাওরের এমন অলওয়েদার রূপ দেখতে যেতে পারেন।  

হাওরের এমন উন্নয়নের রূপকার হলেন আমাদের হাওরের শার্দূলখ্যাত বর্তমান মহামান্য রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। তাঁর সারাজীবনের স্বপ্ন ছিল হাওরকে এমন একটি স্থানে নিয়ে যাওয়া। সেখানে কিশোরগঞ্জ সদরের সাথে ইটনা, মিঠামইন, অষ্টগ্রাম-এই তিনটি উপজেলাকে আপাতত সড়ক যোগাযোগ নেটওয়ার্কের আওতায় আনার চেষ্টা করেছেন। সেখানকার যোগাযোগ, বিদ্যুতায়ন, বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও প্রয়োজনীয়। এগুলো প্রকারান্তরে সেখানকার কৃষিকেই সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে চলেছে। কারণ হাওরের বোরোধান ফসল ঘরে তোলা যেহেতু একটি বড় চ্যালেঞ্জ সেজন্য সেখানকার রাস্তা-ঘাট সেখানে কৃষি যান্ত্রিকীকরণে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছে।
   
কাজেই পরিশেষে বলতে হয়, হাওর শুধু বর্ষাকলের পর্যটন সম্ভাবনা নয়। সেটি সারাবছরের একটি কমপ্রিহেনসিভ পর্যটন সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিয়েছে। সেখানকার দিগন্তজুড়া অথৈ পানি যেমন ভ্রমণপিপাসুদের মনতুষ্টি করতে পারে ঠিক তেমনিভাবে বছরের অন্য সময়েও সেটি কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। বরং বর্ষাকালে যেসব জায়গায় নৌকা ও জলযান ছাড়া যাতায়াত করা যায় না, বছরের অন্যন্য সময় সেখানে নৌকা কিংবা কোন জলযানের প্রয়োজন হয় না। তাছাড়া সেখানকার পর্যটকদের সুবিধার্থে এবং পর্যটক আকর্ষণের জন্য বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠান এবং বেসরকারি উদ্যোক্তাগণ হোটেল মোটেল ও রিসোর্ট করার ক্ষেত্রে এগিয়ে আসছে।
 
আমাদের দেশসহ বিশ্বে যে করোনা পরিস্থিতির ভয়াল থাবা চলছে সেখানে কৃষি একটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে। আর সে পরিস্থিতিতে হাওরের বোরোধান, মাছ, হাঁস-মুরগী, গরু-ছাগল ও অন্যান্য কৃষি উপকরণ আমাদের খাদ্য চাহিদার এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ মিটিয়ে থাকে। কাজেই হাওরের মানুষের জন্যও এখন সেখানকার পর্যটন গুরুত্ব বাড়তি আয়-ইনকামের সুযোগ সুষ্টি করেছে। এখন সেখানকার মানুষজন তাদের নিজেদের গুরুত্বপূর্ণ ভাবছে। কারণ তারা এখন শুধুমাত্র কৃষক নয়। তারাও দেশের মানুষের মনোরঞ্জনের উপলক্ষ হতে পারছে। সামনের দিনগুলোতে এ গুরুত্ব বাড়তেই থাকবে। যা অবহেলিত হাওরকে নতুন মাত্রা দেবে।

লেখক: রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়
email: This email address is being protected from spambots. You need JavaScript enabled to view it.