মাটির স্বাস্থ্য উন্নয়ন জরুরী

কৃষিবিদ ড. এম. মনির উদ্দিন:কৃষি উন্নয়নশীল বাংলাদেশের মুল চালিকাশক্তি। কৃষি প্রধান বাংলাদেশের ৮৭,২২৩টি গ্রামে বাস করে দেশের মোট জনসংখ্যার ৭০ শতাংশ অর্থ্যাৎ ১১ কোটি মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কৃষির সাথে সংশ্লিষ্ট। বিশ্বে জনসংখ্যার বিবেচনায় বাংলাদেশের অবস্থান অষ্টম এবং এশিয়ার মধ্যে পঞ্চম। তাই দেশের উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় কৃষির ভুমিকা খুবই গুরুত্বপুর্ন। দেশের মোট দেশীয় উৎপাদনের (জিডিপি) প্রায় ১৬ শতাংশ এবং মোট শ্রমশক্তির প্রায় ৪৭ শতাংশ কৃষি নির্ভর। সৃজনশীল এবং উদ্ভাবনী উন্নয়ন কর্মকান্ডের মাধ্যমে সকল কৃষিপণ্যের উৎপাদনে স্বয়ংসম্পুর্ণতা ও স্থায়ীত্ব অর্জনের জন্য কৃষিবান্ধব সরকার প্রতিবছর জাতীয় বাজেটে বরাদ্দ বাড়াচ্ছে।  

বর্তমান কৃষিবান্ধব সরকার কৃষির উন্নয়নে সার, ডিজেল, বিদ্যুৎ ও যান্ত্রিকীকরনে আর্থিক সহায়তা প্রদান করে আসছে। সরকারের কৃষিবান্ধব নীতি গ্রহনের ফলে দেশ আজ চালসহ শাকসব্জি, মাছ, মাংস, ডিম, দুধ ও ফল উৎপাদনে শুধু স্বয়ংসর্ম্পুনই নয় বরং উদ্বৃত্ত। গত বোরো মৌসুমে দেশে রেকর্ড পরিমান ২ কোটি ৭ লাখ ৮৪ হাজার ৫০৮ টন চাল উৎপাদন হয়েছে। সারাবিশ্বে যখন করোনার প্রভাবে খাদ্য উৎপাদন অনেকাংশে ব্যাহত হয়েছে তখন ২০২০-২০২১ অর্থবছরে দেশে মোট চাল উৎপাদন হয়েছে ৩৮৬.০৭ লাখ টন। এভাবেই জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মানে তার যোগ্য উত্তরসুরী মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কৃষিকে অগ্রাধিকার দিয়ে দেশের প্রতিটি মানুষের জন্য পুষ্টিসমৃদ্ধ ও নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতকল্পে সুদুরপ্রসারী পরিকল্পনা গ্রহন ও তা বাস্তবায়ন করে চলেছেন। তার সুদুরপ্রসারী নেতৃত্বের কারনেই দেশের কৃষিতে বিগত কয়েক বছর ধরে অভুতপুর্ব সাফল্যের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রয়েছে।

দেশে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা এবং জমির পরিমান দিন দিন কমে যাওয়া এমন এক প্রেক্ষাপটে দেশের কৃষির উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে রাসয়নিক সার ও পেস্টিসাইড। কৃষিতে বরাদ্দ দেয়া বাজেটের সিংহভাগ ভুর্তকিতে ব্যয় করা হয় এবং মোট ভুর্তকির ৭৫ শতাংশের বেশী ব্যয় হয় শুধু রাসায়নিক সার ব্যবস্থাপনায়। এর ফলে দেশের কৃষক কমদামে রাসায়নিক সার ক্রয় করতে পারছে এবং এর প্রভাবে কয়েক বছরের মধ্যে দেশে সকল ধরনের ফসলের উৎপাদন ৮০-২০০ শতাংশ বেড়েছে।
       
সকল ধরনের ফসলের স্বাভাবিক জীবনচক্র চালানোর জন্য ১৭টি পুষ্টি উপাদানের প্রয়োজন হয় যেখানে বিগত কয়েক দশকে দেশের জমিতে মুলত নাইট্রোজেন, ফসফরাস এবং পটাশিয়াম নামে ৩টি সার প্রয়োগ করা হয়েছে। দেশে রাসায়নিক সারের চাহিদা প্রায় ৫০ লাখ টন। এর মধ্যে ইউরিয়া সারের পরিমান ২৭ লাখ টন এবং অন্যান্য সার মিলে ২৩ লাখ টন। রাসায়নিক সারে ভুর্তকি প্রদানের ফলে দেশের ৯৮ শতাংশ জমিতে বর্তমানে রাসায়নিক সার ব্যবহার করা হয়।  

ফসল উৎপাদনে অনেকাংশে রাসায়নিক সার ও পেস্টিসাইড ব্যবহারের কারনে একদিকে যেমন কৃষকের উৎপাদন খরচ বাড়ছে সেইসাথে কমে যাচ্ছে জমির উৎপাদনশীলতা যার অন্যতম প্রধান কারন মাটির জৈব পদার্থ কমে যাওয়া। এরূপ প্রেক্ষাপটে জলবায়ুর পরিবর্তন, ফলন হ্রাস, প্রাকৃতিক দুর্যোগ বেড়ে যাওয়া ভবিষ্যতে খাদ্য নিরাপত্তার বলয় অনেকটাই আজ চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়ে পড়ছে।     

আমাদের কৃষি জমির হারানো স্বাস্থ্য ফিরিয়ে আনার জন্য এবং ভবিষ্যতে ক্রমবর্ধমান মানুষের খাদ্য চাহিদা মেটাতে জমিতে জৈব সার প্রয়োগের কোন বিকল্প নেই। মাটির উর্বরতা কমে যাওয়া, ফসলের ফলন কমে যাওয়া, রাসয়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহার বৃদ্ধি এবং ভারসাম্যহীন ব্যবহারের বর্তমান অবস্থায় মাটিতে জৈব পদার্থের পরিমান বৃদ্ধি করে মাটির স্বাস্থ্য উন্নত করার জন্য জৈব সারের ব্যবহার জরুরী হয়ে পড়েছে।

আদর্শ উর্বর জমিতে মাটির শতকরা ৫ ভাগ জৈব পদার্থ থাকা দরকার অথচ আমাদের দেশের মাটিতে জৈব পদার্থের পরিমান কমতে কমতে ২ শতাংশ এমনকি কোথাও কোথাও তা ১ শতাংশের নীচে চলে এসেছে। জমিতে রাসায়নিক সারের কার্যকারিতা বাড়ানোর জন্য মাটিতে কমপক্ষে ৩ শতাংশ হারে জৈব পদার্থ থাকা দরকার।

টেকসই কৃষির জন্য পরিবেশগত উপাদানগুলোর সুরক্ষা এবং কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির মধ্যে স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য শুধুমাত্র রাসায়নিক সারের ব্যবহারই নয়, জৈব সারের ব্যবহারকেও ভারসাম্যপুর্ন উপায়ে নিশ্চিত করা প্রয়োজন। ১৯৬০ এর দশকের পুর্বে কৃষিতে শস্যের বহুমুখীতা ছিলো যার ফলে জমিতে প্রাকৃতিকভাবে জৈব পদার্থ যুক্ত হতো। সেইসাথে কৃষকেরা বিভিন্ন ফসলের চাষে গোবরসহ অন্যান্য আবর্জনাসার প্রচুর পরিমানে ব্যবহার করতে পারতো এবং এতে মাটির জৈব পদার্থের পরিমানে ভারসাম্যতা বজায় থাকতো।

বর্তমানে দেশে আবাদী জমি কমে যাওয়া সেইসাথে ক্রমবর্ধমান মানুষের খাদ্য নিশ্চিত করতে জমির ফসলের নিবিড়তা বৃদ্ধি পেয়েছে। এমতাবস্থায় জমিতে প্রতিটি ফসল চাষ করতে গিয়ে ইউরিয়া, ফসফেট ও পটাশ প্রচুর পরিমানে ব্যবহার করতে হচ্ছে। প্রয়োগকৃত ইউরিয়া সারের ৬০-৭০ ভাগ পরিবেশে মিশে গিয়ে পরিবেশকে দুষিত করছে। ফসলের ফলন বাড়ানোর জন্য ফসফেট ও পটাশ সারের উপর নির্ভরতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। অধিকন্ত রাসায়নিক সার একচেটিয়া ব্যবহারের কারনে মাটির উপকারী অনুজীব দ্রুত কমে যাচ্ছে। এর কারনে গাছ মাটি থেকে প্রয়োজনীয় পুষ্টি গ্রহন করতে পারছে না এমনকি সার বেশী পরিমানে ব্যবহার করেও কাজ করছে না।

মাটিতে প্রয়াজনীয় পরিমানে জৈব পদার্থ থাকলে মাটির জন্য উপকারী অনুজীবের সংখ্যা দ্রুত বেড়ে যায় এবং তাদের কার্যকলাপের মাধ্যমে গাছের জন্য প্রয়োজনীয় ১৭টি প্রধান ও গৌন পুষ্টি উপাদানের প্রাপ্যতা বেড়ে যায়। এ বিবেচনায় দেশের ফসল উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি মাটি উর্বর ও উৎপাদনক্ষম রাখতে কম্পোস্টিং খুবই প্রয়োজন।

মাটির জৈব পদার্থ কমে যাওয়ায় মাটির স্বাস্থ্য আজ বিপন্ন। বিজ্ঞানীরা গত তিন দশকে মাটির স্বাস্থ্য এবং মানুষের স্বাস্থ্যের মধ্যে সরাসরি সম্পর্ক চিহিৃত করতে সক্ষম হয়েছে। ফসলের গাছের মধ্যে এ পর্যন্ত প্রায় একশ’র বেশী উপাদান পাওয়া গেছে যা মাটি থেকে সংগ্রহ করে। মানুষ গাছের মাধ্যমে তার দেহের জন্য প্রয়োজনীয় ৪৮টি পুষ্টি উপাদান খাদ্য থেকে গ্রহন করে। মানুষের অন্ত্রে বিভিন্ন ধরনের অনুজীব আছে এবং এই অনুজীবগুলো নির্দিষ্ট ধরনের পুষ্টির উপর নির্ভরশীল। এই অনুজীবগুলো যদি সঠিক পুষ্টি না পায় তাহলে মানুষের শারীরবৃত্তীয় কার্যকলাপে প্রভাব ফেলে এবং নির্দিষ্ট রোগের কারন হয়। এ কারনে জমিতে জৈবসার প্রয়োগ করা একটি কার্যকরী পদক্ষেপ।

এক কেজি ইউরিয়া সার ব্যবহারে ২০ কেজি শস্য উৎপাদন করার কথা অথচ আমাদের জমিতে এটি মাত্র ৮-১০ কেজি শস্য উৎপাদন করতে পারছে। এর অন্যতম কারন হচ্ছে জমিতে জৈব পদার্থের অভাব। মাটিতে জৈব পদার্থ যে সকল গুরুত্বপুর্ন কাজ করে থাকে তার মধ্যে অন্যতমঃ

১) জৈব পদার্থ মাটির গঠন উন্নত করে যার ফলে মাটির পানি ও পুষ্টি ধারন ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।
২) জৈব পদার্থে কার্বন রয়েছে যা নাইট্রোজেন, ফসফরাস ও পটাশিয়ামের সাথে কার্বন যুক্ত করে অনুজীবের বংশবৃদ্ধি ঘটায় এবং প্রাকৃতিকভাবে জৈবিক প্রক্রিয়ায় উদ্ভিদের জন্য পুষ্টি সরবরাহ বৃদ্ধি করে।
৩) জৈব সার রাসায়নিক সারের মত সহজে শেষ হয় না কারন  এটি মাটির কাঠামোর সাথে যুক্ত থাকে। ফলে জৈব সার রাসায়নিক সারের তুলনায় মাটির জীব বৈচিত্র্য ৩০ শতাংশ বাড়ায়।
৪) জৈব সার ফসলের জন্য ব্যাপকভাবে পুষ্টি সরবরাহ করে যা কৃষি পণ্যের মান উন্নত করে এবং মাটির বাফারিং ক্ষমতা বাড়ায়।
৫) জৈব সার মাটির গঠন উন্নত করায় আদ্রতা ধারন ক্ষমতা বাড়ে এবং ফসলে কম সেচের প্রয়োজন হয়।

দেশে জৈব সার উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামাল পর্যাপ্ত আছে কিন্তু সঠিক ব্যবহার না থাকায় এ সমস্ত কাঁচামাল বেশীরভাগ ক্ষেত্রে মাটিতে ডাম্পিং করা হচ্ছে। দেশের শহরাঞ্চলের বর্জ্য ডাম্পিং করা হচ্ছে, গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগীর খামারে উৎপাদিত ব্যাপক পরিমান বর্জ্য ব্যবহার না থাকায় ডাম্পিং করা হচ্ছে। অথচ এ সমস্ত বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সুযোগ থাকলে দেশে প্রতি বছর কয়েক লক্ষ টন জৈব সার উৎপাদন করা সম্ভব। তাছাড়া দেশের প্রয়োজনীয়তা মেটানোর পাশাপাশি জৈব সার দেশের বাইরে রপ্তানী করারও সুযোগ রয়েছে।                     

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের নেয়া কর্মসুচীর ফলে দেশে অনেক ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা ভার্মিকম্পোস্ট উৎপাদন করে সীমিত পরিসরে বাজারজাত করছে। ইতিমধ্যে দেশের কয়েকটি বড় প্রতিষ্ঠান জৈব সার উৎপাদন ও বাজারজাত শুরু করেছে এবং বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান জৈব সার উৎপাদনের আগ্রহ নিয়ে যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করেছে। এখন প্রয়োজন কৃষিবান্ধব সরকারের তথা কৃষি মন্ত্রণালয়ের পৃষ্ঠপোষকতা এবং সহযোগীতা।

বিগত কয়েক বছরে যেমন সরকারের কৃষিবান্ধব নীতি গ্রহন বিশেষ করে রাসায়নিক সারে ভর্তুকি ও প্রনোদনার কারনে বিভিন্ন ফসলের উৎপাদন ৮০-২০০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। আগামীদিনেও যাতে কৃষির এই অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকে সেজন্য রাসায়নিক সারের পাশাপাশি জৈব সারেও ভর্তুকির ব্যবস্থা করা আবশ্যক।

সম্প্রতি মাননীয় কৃষিমন্ত্রী মহোদয় বলেছেন এ বছর সারের ভর্তৃকির জন্য সাড়ে ২৮ হাজার কোটি টাকা প্রয়োজন। এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই যে, মাননীয় কৃষিমন্ত্রীর নের্তৃত্বে বর্তমান সরকারের ৩ বছর মেয়াদে কৃষিতে যে অভাবনীয় সাফল্য এসেছে তার অন্যতম কারন রাসায়নিক সারে ভর্তুকি ও প্রনোদনা। দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রার মুলে কাজ করছে কৃষির ব্যাপক সাফল্য আর এই সাফল্যকে ধরে রাখতে অবশ্যই অর্থমন্ত্রণালয়কে প্রয়োজনীয় অর্থের জোগান দেয়া প্রয়োজন। এটি অস্বীকার করার কোন উপায় নেই যে, দেশকে আরো এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে কৃষির অগ্রযাত্রাকে ধরে রাখতে হবে।

দেশের ১৭ কোটি মানুষকে খাওয়ানোর ব্যবস্থা করছে কৃষি। তাই কৃষির উন্নয়ন বাঁধাগ্রস্থ হলে তা দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির উপরই প্রভাব ফেলবে। তাই সুযোগ্য কৃষিমন্ত্রী আগামীদিনে কৃষি ও কৃষকের সার্বিক কল্যানে শুধু রাসায়নিক সারই নয় জৈব সারেও প্রয়োজনীয় ভর্তুকির ব্যবস্থা করে দেশের কৃষিকে আরো এগিয়ে নিয়ে যাবেন।           
    
লেখক:এগ্রোনোমিস্ট, কলামিষ্ট ও উন্নয়ন কর্মী