সাশ্রয়ী যান্ত্রিক রোপনের ম্যাট টাইপ ধানের চারা উৎপাদন

ড. মো. আনোয়ার হোসেন:রাইস ট্রান্সপ্লান্টার (Rice Transplanter)’ একটি ইংরেজী শব্দ। এই শব্দটি সময়ের সাথে সাথে বাংলা শব্দের সাথে মিশে এখন অনেকটাই বাংলার কৃষকের কাছে পরিচিত। এই যন্ত্রটি ধানের চারা রোপন পদ্ধতিতে এনেছে আমুল পরিবর্তন। ধানের চারা রোপন মওসুমে শ্রমিক সংকট বৃদ্ধি, ফসলের মধ্যবর্তী সময় হ্রাস, দ্রুত নগরায়ন ও শিল্পায়ন এবং কৃষকের আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরিবর্তনের সাথে সাথে জনপ্রিয় হচ্ছে এই যন্ত্রটি। তাছাড়া একজন কৃষক প্রথাগত পদ্ধতিতে যেখানে ঘন্টায় প্রায় ১ (এক) শতক জমিতে চারা রোপন করতে পারে সেখানে একটি ০৪ সারি বিশিষ্ট রাইস ট্রান্সপ্লান্টার যন্ত্র দিয়ে ঘন্টায় প্রায় ৩০-৩৫ শতক এবং ০৬ সারি বিশিষ্ট যন্ত্র দিয়ে ঘন্টায় প্রায় ৪৫-৫০ শতক জমিতে চারা রোপন করা করতে পারে। ফলে কৃষকের খরচ আর সময় দুটোই বাঁচায় চারা রোপনের আধুনিক এই যন্ত্রটি।

রাইস ট্রান্সপ্লান্টারে রোপনে চারা থেকে চারা ও সারি থেকে সারির দূরত্ব ঠিক রাখা যায় এবং অল্প বয়সের চারা রোপন করা যায়, যা ফলন বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাছাড়া সারিতে লাগানো ধানের জমিতে আন্তঃ পরিচর্যা করা সহজ হয়। কিন্তু প্রচলিত পদ্ধতিতে বীজতলায় উৎপাদিত ধানের চারা এই যন্ত্রের মাধ্যমে রোপন করা যায় না। যান্ত্রিক পদ্ধতিতে কার্যকর রোপনের পূর্বশর্ত হলো সঠিক ভাবে মেশিনের উপযোগী ধানের চারা উৎপাদন। এই যন্ত্রের মাধ্যমে ধানের চারা রোপনের জন্য বিশেষ পদ্ধতিতে ট্রে বা পলিথিনে চারা উৎপাদন করতে হয়। পলিথিন বা ট্রেতে উৎপাদিত এই চারা ‘ম্যাট টাইপ’ চারা হিসেবে পরিচিত। এই চারা সংগ্রহ এবং রোপনের সময় চারার শিকড়ের ক্ষতি হয় না। ট্রে ব্যবহার করে চারা উৎপাদনের জন্য চাষের জমির প্রয়োজন পড়ে না। বাড়ির আঙিনা, উঠুন বা মাচায় চারা উৎপাদন করা যায়। এমনকি ট্রেতে উৎপাদিত চারা সহজেই এক স্থান থেকে অন্য স্থানে নেওয়া যায়। তাই বন্যা কিংবা অন্য যেকোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগেও চারা উৎপাদনে কোনো ব্যাঘাত ঘটে না। ট্রে অথবা পলিথিনের উপর উৎপাদিত চারা আমন মওসুমে ১৫-১৮ দিন এবং বোরো মওসুমে ২৫-৩০ দিন বয়সে রোপন করা যায়। যে কারণে ধানের জীবনকাল মাঠে বেশীদিন দীর্ঘায়িত হয়। ফলে ধানের গোছায় বেশি সংখ্যক কার্যকরী কুশি উৎপন্ন হয়। চারার উচ্চতা, ঘনত্ব এবং ট্রে/পলিথিনের উপর মাটির পুরুত্ব ম্যাট টাইপ চারা উৎপাদনের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যান্ত্রিক পদ্ধতিতে ধানের চারা রোপনের জন্য ৩-৪ পাতা বিশিষ্ট ৫-৬ ইঞ্চি উচ্চতার চারা এবং ট্রে/পলিথিনের উপর প্রায় ১.০ ইঞ্চি মাটির পুরুত্ব রাখলে রোপন ভালো হয়।


প্লাষ্টিকের রিজিড/ফ্লেক্সিবল ট্রে অথবা পলিথিনের উপর ম্যাট টাইপ চারা তৈরি করতে হয়। ঝুরঝুরে দোআঁশ বা বেলে দোআঁশ মাটি ম্যাট টাইপ চারা তৈরির জন্য উপযোগী। প্রয়োজনমতো জৈব সার মাটির সাথে মিশ্রণ করা যেতে পারে। ট্রে অথবা পলিথিনের উপর পৌনে এক ইঞ্চি (০.৭৫ ইঞ্চি) গভীরতায় ঝুরঝুরে মাটি ছড়িয়ে দিতে হবে। ছড়িয়ে দেয়া মাটির উপর ধানের জাত এবং অঙ্কুরোদগমের হার অনুযায়ী ১২০ থেকে ১৪০ গ্রাম পরিমাণ বীজ প্রতি ট্রেতে সমঘনত্বে ছিটিয়ে দিতে হবে। চিকন ও লম্বা ধানের ক্ষেত্রে ১২০, মাঝারি ধানের ক্ষেত্রে ১৩০ এবং মোটা ও খাটো ধানের ক্ষেত্রে ১৪০ গ্রাম বীজ বপন করতে হবে। একটি ট্রের ক্ষেত্রফল পৌনে দুই বর্গ ফুট (১.৭৫ বর্গফুট)। পলিথিনে বীজ বপনের ক্ষেত্রে ১.০ বর্গফুট জায়গায় চিকন ও লম্বা ধানের ক্ষেত্রে ৭০, মাঝারি ধানের ক্ষেত্রে ৭৫ এবং মোটা ও খাটো ধানের ক্ষেত্রে ৮০ গ্রাম হিসেবে বীজ বপন করতে হবে। ট্রের উপর বীজ ছড়িয়ে দেয়ার পর ঝুরঝুরে মাটি দ্ধারা হালকা করে ঢেকে দিতে হবে। তারপর ঝর্নার মাধ্যমে হালকাভাবে সেচ দিতে হবে যাতে ট্রের সম্পূর্ণ মাটি ভিজে যায়। চারা তৈরির জন্য ব্যবহৃত বীজ ধানের অঙ্কুরোদগমের হার ৯০ ভাগ বা আরো বেশি হওয়া বাঞ্ছনীয়। বীজ ধানের অঙ্কুরোদগমের হার কম হলে আনুপাতিক হারে বীজের পরিমান বাড়াতে হবে। সমভাবে সেচ দেয়ার জন্য প্লাষ্টিকের রিজিড/ফ্লেক্সিবল ট্রে অথবা পলিথিন সমান জায়গায় স্থাপন করতে হবে।

আউশ এবং আমন মওসুমে ধান চাষাবাদের জন্য সাধারণত ১৫-৩০ চৈত্র (৩০মার্চ - ১৫ এপ্রিল) এবং ১৫ আষাঢ় - ১৫ শ্রাবণ (২৫ জুন - ২৫ জুলাই) বীজ বপন করা হয়। উক্ত সময়ে আবহাওয়া উষ্ণ থাকায় ম্যাট টাইপ চারা তৈরিতে কোনো সমস্যা হয় না। বোরো মওসুমে ধানের জাত, জীবনকাল এবং এলাকা অনুযায়ী ১৫ কার্তিক-২৫ অগ্রহায়ণ (০১ নভেম্বর-১০ ডিসেম্বর) পর্যন্ত চারার জন্য বীজ বপন করা হয়। চারা বপনের সময় আবহাওয়া ঠান্ডা থাকায় এবং প্রায়শ শৈত্য প্রবাহ দেখা দেয়ায় ম্যাট টাইপ চারার বিশেষ যত্ন নিতে হয়। বোরো মওসুমে ম্যাট টাইপ চারা উৎপাদনের ক্ষেত্রে কিছু ধাপ অনুসরণ করলে ভালো এবং সুস্থ্য মানের চারা উৎপাদন করা সম্ভব।

ধাপ সমূহ হলো- (১) রোপনের পরিকল্পনা অনুযায়ী পলিথিনে অথবা রিজিড/ফ্লেক্সিবল প্লাস্টিক ট্রেতে চারা তৈরি করতে হবে, (২) বীজের অঙ্কুরোদগম ক্ষমতা ৯০ ভাগের কম হলে প্রয়োজনমতো অতিরিক্ত বীজ ট্রেতে বপন করতে হবে, (৩) পানি দিয়ে বীজ ভিজানোর সময় পানির উপর ভাসমান চিটা ধান আলাদা করে নিতে হবে। বীজ শোধন করার জন্য এ্যাজোক্সিট্রবিন অথবা পাইরাক্লোস্ট্রবিন গ্রুপের ছত্রাকনাশক যেমন: এমিস্টারটপ অথবা সেলটিমা (প্রতি কেজি বীজের জন্য ২-৩ মিলি/লিটার) দিয়ে ১৮-২০ ঘণ্টা ভিজিয়ে রাখতে হবে। এরপর পরিস্কার পানি দিয়ে ধুয়ে জাগ দিতে হবে। বীজ শোধন করলে ফসলে বীজ বাহিত ছত্রাক রোগ, যেমন বাকানি, লিফস্পট, ব্রাউন স্পট, ফল্সম্মাট ইত্যাদি থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। (৪) ট্রের চারায় রোগবালাই দেখা দিলে এ্যাজোক্সিট্রবিন অথবা পাইরাক্লোস্ট্রবিন গ্রুপের ছত্রাকনাশক  ২-৩ মিলি/লিটার পানিতে মিশিয়ে ভালোভাবে স্প্রে করতে হবে। স্প্রে করার পর আনুমানিক ছয় (০৬) ঘণ্টা ট্রেতে সেচ দেয়া যাবে না। স্প্রে করার আনুমানিক ১২ ঘণ্টা পূর্বে ট্রের পানি সম্পূর্ণভাবে নিস্কাশন করতে হবে, (৫) বাড়ির আঙ্গিনায় অথবা উঁচু জায়গায় ট্রে স্থাপন করলে প্রতিদিন ঝর্নার মাধ্যমে সম্পূর্ণ সিক্ত করে পানি দিতে হবে। তবে মূল জমিতে ট্রে স্থাপন করলে চারার গোড়া পর্যন্ত সেচ দিয়ে পানি ধরে রাখতে হবে, (৬) যদি তাপমাত্রা ১২ ডিগ্রি বা তার কম থাকে সেক্ষেত্রে বিকেলে পানি দিয়ে সকালে তা ছেড়ে দিতে হবে। শীতের কবল থেকে চারা রক্ষা করার জন্য পলিথিনের শেড ব্যবহার করা উত্তম। পলিথিনের শেড অবশ্যই মাটি হতে ২-৩ ফুট উচুঁ অর্ধগোলাকৃতির হতে হবে এবং দিনের বেলায় পলিথিন দিয়ে ঢেকে রাখতে হবে। তবে প্রচন্ড এবং অত্যধিক কুয়াশাচ্ছন্ন অবস্থায়, যদি শৈত্য প্রবাহ থাকে, সেক্ষেত্রে পলিথিন দিয়ে চারা রাত-দিন ২৪ ঘণ্টা ঢেকে রাখাই উত্তম, (৭) মাটি কম উর্বর হলে বা চারার বাড়বাড়তি কম হলে ১০০-১৫০ গ্রাম ইউরিয়া, ৬০ গ্রাম এমওপি, ৪০ গ্রাম থিওভিট, ৩০ গ্রাম দস্তা সার ১০ লিটার পানিতে ভালোভাবে মিশিয়ে চারার উপর এমনভাবে স্প্রে করতে হবে যাতে সম্পূর্ণ চারা এবং মাটি ভিজে যায়। এটি মূলত চারা গজানোর ৫-৭ দিন পর করলেই উত্তম। তারপরও চারার বাড়বাড়তির ঘাটতি দেখা দিলে উল্লেখিত মাত্রায় আবারও স্প্রে করতে হবে। সবগুলো ট্রে একই সাথে এবং একই মাত্রায় স্প্রে করতে হবে। দিনের বেলায় স্প্রে করতে হবে যাতে চারার পাতায় লেগে থাকা শিশির/পানি সূর্য ডুবার পূর্বেই শুকিয়ে যায়।

বাংলাদেশের কৃষিতে বর্তমান শ্রম সংকট বিবেচনা করে রাইস ট্রান্সপ্লান্টার একটি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ প্রযুক্তি। ম্যাট চারা উৎপাদন প্রযুক্তি কৃষকের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়ার মাধ্যমে ধান রোপন যান্ত্রিকীকরণকে টেকসই রুপ দিতে আরো একধাপ এগিয়ে যাবে বলে আমি বিশ্বাস করি।

লেখক পরিচিতি:ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা
ফার্ম মেশিনারি এন্ড পোস্ট হারভেস্ট টেকনোলজি বিভাগ
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইন্সটিটিউট, গাজীপুর-১৭১০
ইমেইল:This email address is being protected from spambots. You need JavaScript enabled to view it.