কৃষি সাংবাদিকতার বাতিঘর "বাকৃবি সাংবাদিক সমিতি"

আবুল বাশার মিরাজ:মানুষের জীবন শুরু হয়েছে কৃষির মাধ্যমে এমনকি শেষও হবে কৃষির সমাপ্তির মাধ্যমে। একথায় কৃষির বাইরে যাওয়ার আমাদের কোনই সুযোগ নেই। আর এদিকে বাংলাদেশ কৃষি প্রধান দেশ, কৃষিকাজের সাথে জড়িয়ে আছে এদেশের প্রায় ৮০ ভাগ মানুষের জীবনযাত্রা, তাই কৃষির উন্নয়ন জাতীয় উন্নয়নের ধারাকে এগিয়ে নেয়। আর এ কারণেই  আমাদের দেশে উন্নয়ন সাংবাদিকতা বলতে খুব করেই কৃষি সংবাদকেই বুঝানো হয়।

আর এ কথা বলতে দ্বিধা নেই, বাংলাদেশে কৃষি সাংবাদিকতার বাতিঘর বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বাকৃবি) সাংবাদিক সমিতি। দরিদ্রতা দূরীকরণের প্রত্যয়ের লক্ষ্য নিয়ে ১৯৬১ সনে প্রতিষ্ঠিত হওয়া দেশের প্রথম ও উপমহাদেশের সর্ববৃহৎ কৃষি শিক্ষার তীর্থ স্থান বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি)। কৃষি বিজ্ঞানীদের নিরলস প্রচেষ্টায় উদ্ভাবিত আধুনিক ও টেকসই প্রযুক্তি কৃষকদের কাছে বোধগম্য করে তুলে ধরতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দুই বছরের মাথায় ১৯৬৩ সালে প্রতিষ্ঠা হয়েছিল বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতি (বাকৃবিসাস)। প্রতিষ্ঠার শুরু থেকে নিরন্তর ছুটে চলা এই সংগঠনটি আজও তার লক্ষ্য থেকে একবিন্দুও বিচ্যুত হয়নি।  

বলতে গেলে, সত্তরের দশশের শুরু থেকেই বাংলাদেশে কৃষিভিত্তিক উন্নয়ন সাংবাদিকতার সূত্রপাত বাকৃবিসাসের সদস্যদের হাত ধরে। তাই বাকৃবিসাস’কে আমাদের দেশে উন্নয়ন সাংবাদিকতা তথা কৃষি সাংবাদিকতার বাতিঘর বললেও কোন ভুল হবে না। সেই সত্তরের দশক থেকে আজ অবধি কৃষির উন্নয়নে বিভিন্ন বিষয়ে ধারাবাহিক সংবাদ পরিবেশন করে আসছে বাকৃবিসাসের একঝাঁক নির্ভিক সদস্যরা। বাকৃবিসাসের সংবাদকর্মীরা জাতীয় বিভিন্ন গণমাধ্যমে কৃষি সাংবাদিক হিসেবে পরিচিত। যা অনেক গর্বের বলে মনে করেন বাকৃবিসাসের প্রতিটি সদস্য। আরেকটি কথা- যা না বললেই নয় সেটি হচ্ছে বাকৃবিসাস শুধু কৃষির উন্নয়ন সাংবাদিকতায় প্রথম নয়, দেশের বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় গুলোর সাংবাদিক সমিতির মধ্যেও সর্ব প্রাচীন সাংবাদিক সংগঠন।

বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি পাবলিক ও সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাস সাংবাদিকতায় নিযুক্ত রয়েছেন। ক্যাম্পাস সাংবাদিকতা হচ্ছে সাংবাদিকতার ‘আঁতুড়ঘর’। একজন পূর্ণকালীন সাংবাদিকের চেয়ে ক্যাম্পাস সাংবাদিক বেশি দায়িত্ব পালন করেন। পূর্ণকালীন সাংবাদিক যেকোনো একটি বিষয়ে দক্ষ হলেও ক্যাম্পাস সাংবাদিককে নানা বিষয়ের পন্ডিত হতে হয়। শিক্ষক-ছাত্ররাজনীতি, বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেট তথা অর্থনীতি, ছাত্রছাত্রীদের সুযোগ-সুবিধা, পড়ার পরিবেশ, সংগঠন সংবাদসহ নানা ইতিবাচক ও নেতিবাচক সংবাদ সংগ্রহে থাকতে হয় সদা তৎপর। ফলে পূর্ণকালীন সাংবাদিকের চেয়ে ক্যাম্পাস সাংবাদিককে বেশি সময় সংবাদ সংগ্রহে ব্যয় করতে হয়। একটি জেলা প্রতিনিধির চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে নিযুক্ত থেকেও যুগের পর যুগ ক্যাম্পাস সাংবাদিককে যৎসামান্য সম্মানীতেই খুশি থাকতে হয়।

ক্যাম্পাস সাংবাদিক হচ্ছেন ক্যাম্পাসের নায়ক। ক্যাম্পাস সম্পর্কিত নানা ধরনের সংবাদ প্রকাশের কারণে একজন ক্যাম্পাস সাংবাদিক অল্প সময়ের মধ্যে ক্যাম্পাসে পরিচিত মুখে পরিণত হন। ফলে উপাচার্য, ছাত্রবিষয়ক উপদেষ্টা, কোষাধ্যক্ষ, ডিন, প্রক্টর, বিভাগীয় প্রধান, রেজিস্ট্রার, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকসহ প্রশাসনিক দায়িত্বে নিযুক্ত ব্যক্তিদের সঙ্গে তাঁর সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে। নিজ বিভাগের শিক্ষক ছাড়াও বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষকদের সঙ্গে হৃদতাপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপিত হয়। এভাবে একজন সৎ ক্যাম্পাস সাংবাদিক সবার প্রিয়পাত্রে পরিণত হন। এক অর্থে তাঁর সমবয়সী শিক্ষার্থীদের মধ্যে তিনি ক্যাম্পাসের নায়ক হয়ে ওঠেন।

এবার আসি বাকৃবি সাংবাদিকদের কাজের বিষয়ে, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ায় নিত্য নতুন কৃষি প্রযুক্তি ও জাত উদ্ভাবিত হচ্ছে এখানে। তাই দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিকদের সংঘর্ষের নিউজের পরিবর্তে আমাদের উদ্ভাবনের নিউজই বেশি করা হয়। এজন্য সব পত্রিকা অফিসেই বাকৃবি সাংবাদিকদের রয়েছে আলাদা অবস্থান। আর সবাই মিলে যেন একটি দেহে একই প্রাণের মত। সততা, সাহসীকতা আর সৃজনশীলতা যেন বাকৃবি সাংবাদিকদের অনন্য বৈশিষ্ট্য।

ক্যাম্পাসে সাংবাদিকদের নাম না জানলেও এই পরিচয়টা সবাই জানেন। বন্ধুরা তো সবসময় সাংবাদিক বলেই সম্বোধন করে। কেউ কেউ মজা করে সাংঘাতিকও বলে। আর স্যারদের সাথে পরিচিতি থাকার কারণে বিপদেও পড়তে হয়। স্যাররা অনেক সময় প্রশ্ন করেন, ‘এই সাংবাদিক এই প্রশ্নের উত্তর বল?’ আবার স্যাররা অনেক স্নেহও করেন। আমি মনে করি দায়িত্বশীল সাংবাদিকতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশকে সুন্দর করে, প্রশাসন ও ছাত্র সংগঠনগুলোকে স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক করে। পাশাপাশি ছাত্র স্বার্থকেও সমুন্নত করে। বাকৃবিসাসের কঠিন ঐক্য আর সততা, সাহসিকতা এবং সৃজনশীলতার অনন্য এ পরিবারের একজন সদস্য হতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে করছি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ছোট্ট এই সাংবাদিকতা জীবনে অনেক অনেক অনেক অভিজ্ঞতা হয়েছে। মিশতে পেরেছি সাধারণ শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা-কর্মচারী থেকে শুরু করে ভিসি স্যার পর্যন্ত সবার সাথেই। অনেক সহযোগিতা পেয়েছি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, সন্মানিত শিক্ষকবৃন্দ, ছাত্রনেতৃবৃন্দ, কর্মকর্তা, কর্মচারীসহ সাধারণ শিক্ষার্থীদের থেকে যা অনস্বীকার্য যদিও কিছু অনাকাঙ্খিত ঘটনা থাকবেই। সর্বোপরি, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতির সদ্যস্যরা কালক্রমে দীর্ঘ ৫৯ বছরের ঐতিহ্য-সততা ধরে রেখে সাহসিকতার মাধ্যমে যেভাবে বস্তনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশনে জনশীল প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে যাচ্ছে, তার একজন সহযোদ্ধা হতে পেরে আমি গর্বিত।

বাকৃবি সাংবাদিক সমিতি সদস্যদের দেশের জাতীয় বিভিন্ন গণমাধ্যমে কৃষি প্রতিবেদন প্রকাশের পর নতুন সেই কৃষি প্রযুক্তি ব্যবহার করে অনেক কৃষকের মুখে হাসি ফুটেছে। বেড়েছে কৃষিতে বিনিয়োগ। সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে কর্মসংস্থানের। বাড়ছে দেশের দেশজ উৎপাদন। অনেকে হয়েছেন সফল কৃষক। পত্রিকার পাতায় প্রকাশিত বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি প্রযুক্তি সম্পর্কে জেনে পরবর্তীতে তা ব্যবহার করে সফল হওয়া কৃষক ও উদ্যোক্তার গল্প আছে অনেক। যা আমাদের গর্বিত করে।

লেখক: সভাপতি, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতি, ময়মনসিংহ।