পোল্ট্রি এবং ফিডমিলের গন্তব্য কোথায়?

পোল্ট্রি ফিডের কাঁচামালের বাজারমূল্য এবং খামারির উৎপাদিত পণ্যের মূল্য ব্যবধান
প্রফেসর ড. মোঃ আনোয়ারুল হক বেগ, পোল্ট্রি বিজ্ঞান বিভাগ, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা:বর্তমান কোভিড-১৯ পেনডেমিক পরিস্থিতিতে যে সব শিল্পখাত সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হলো পোল্ট্রি শিল্প। এই ক্ষতির কবলে পড়ে পোল্ট্রি খাদ্য উৎপাদন ও সরবরাহ ব্যবস্থার উপর প্রভাব পড়ায়, খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তার বিষয়টিও বর্তমানে চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশ পোল্ট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিল (বিপিআইসিসি) ২০২৫ সাল নাগাদ এই শিল্পের রপ্তানি লক্ষমাত্রা টার্গেট করেছে। সংস্থাটি মনে করে পোল্ট্রির উৎপাদন ও চাহিদার মধ্যে ব্যাপক অসংগতিই এই শিল্পের ভবিষ্যৎ উন্নয়নে বাধা।

পোল্ট্রি ফিডে ব্যবহৃত বেশির ভাগ কাঁচামাল এবং প্রায় সকল ফিড-এডিটিভ আমদানি নির্ভর। করোনা মহামারির প্রভাবে এই সব পণ্যের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে ব্যপকভাবে। পোল্ট্রি খাদ্যের কাঁচামালের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় ভুট্টা এবং সয়াবিন মিল। পোল্ট্রি ফিডের মোট উপাদানের ৭০-৮০ ভাগই ব্যবহৃত হয় এই দুটি কাঁচামাল। ভুট্টা এবং সয়াবিন মিল এর মূল্য বৃদ্ধি পর্যালোচনা করলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে।

টেবিল-১ দেখা যাচ্ছে, করোনা পরিস্থিতি শুরুর আগে ২০১৯ সালে কেজি প্রতি ভুট্টার গড় মূল্য ছিল ১৯.৭০ টাকা, যা ২০২০ ও ২০২১ সালে বৃদ্ধি পেয়ে যথাক্রমে ২১.২৯ এবং ২৩.৭৬ ও ২৯.৭০ টাকা হয়। অর্থাৎ ২০১৯ সাল থেকে ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে আসতে ভুট্টার প্রায় ৫০% মূল্য বৃদ্ধি হয়েছে। একইভাবে সয়াবিন মিল এর গড় মূল্য ৩৬.৫৭ টাকা থেকে বৃদ্ধি পেয়ে বর্তমানে ৫২.৭৫ টাকায় দাঁড়িয়েছে, যার মূল্য বৃদ্ধি  প্রায় ৪৪%। একইভাবে আমদানি জটিলতা এবং আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্য বৃদ্ধির ফলে পোল্ট্রি খাদ্যে ব্যবহৃত ফিড-এডিটিভস গুলোর দামও বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই কাঁচামাল এবং এডিটিভস এর মূল্য পর্যালোচনা করে দেখা যায় গত তিন মাসে প্রত্যেকটি ফিডমিলের ফিড উৎপাদন খরচ বেড়েছে ২৫-৩০%।

টেবিল-১: গত তিন বছরে প্রধান কাঁচামালের দাম (প্রতি কেজি টাকায়)


অন্যদিকে আমরা যদি ফিডের বিক্রয় (টেবিল-২) মূল্যের দিকে লক্ষ্য করি, গত জুন মাসে প্রতি কেজি ব্রয়লার খাদ্যের দাম ছিল ৫০-৫১ টাকা, যা বর্তমানে ৫২-৫৩ টাকা। লেয়ারের বিভিন্ন খাদ্যের দাম ছিল প্রতি কেজি ৪১-৪৬ টাকা, যাহা বর্তমানে ৪৩-৪৮ টাকা। অর্থাৎ, ভুট্টার ৫০% ও সয়াবিনের ৪৪% মূল্য বৃদ্ধির বিপরীতে ব্রয়লার ফিডের দাম ৩-৪% এবং লেয়ারফিডের দাম ৪-৫% বৃদ্ধি পেয়েছে।

টেবিল-২: গত তিন মাসের ফিডের দামের পরিবর্তন (প্রতি কেজি টাকায়)


একইসাথে যেহেতু  ব্রয়লার এবং লেয়ারের উৎপাদন খরচের ৬৫-৭০% হচ্ছে ফিড খরচ, তাই এখানে ব্রয়লার ও খাবার ডিমের উৎপাদন খরচ বিশ্লেষন করা প্রয়োজন। সবচেয়ে অবাক হওয়া বিষয় (টেবিল-৩) হচ্ছে ২০১১ সালে ব্রয়লার মুরগির বিক্রয় মূল্য ছিল ১১০ টাকা, যা বর্তমানে কমে হয়েছে ১০০ টাকা। ফিডের দাম বৃদ্ধির সাথে সাথে গত তিন বছরে খামারি পর্যায়ে ব্রয়লার মুরগির উৎপাদন খরচ ৯% এবং লেয়ার ডিমের উৎপাদন খরচ ৮% বৃদ্ধি পেয়েছে। ব্রয়লারের বিক্রয় মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে ১১% এবং লেয়ার ডিমের ৯% । বর্তমানে ব্রয়লার উৎপাদনে লাভের মুখ দেখা না গেলেও ডিমে কিছু লাভ হচ্ছে। এদিকে, সব চেয়ে শঙ্কার বিষয় হলো, সহজলভ্য প্রাণিজ আমিষের অন্যতম উৎস ব্রয়লার ও ডিমের উৎপাদন খরচ বাড়লেও সেই তুলনায় গত কয়েক বছরে খামারি পর্যায়ে ব্রয়লার মুরগি ও ডিমের দাম বাড়েনি। তাই দিন দিন ছোট ও মাঝারি খামারের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। অর্থাৎ পোল্ট্রি খামার দ্বারা দারিদ্র দূরীকরণের পথ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।  খামারের খরচ বৃদ্ধি অনুযায়ী ডিম এবং মাংসের দাম বৃদ্ধি না পাওয়ায় পুঁজি উঠাতে না পেরে খামারিরা খামার বন্ধ করে দিচ্ছে।

টেবিল-৩: গত তিন বছরে ব্রয়লার মুরগি ও ডিমের উৎপাদন খরচ (টাকায়)


অন্যদিকে লোকসান দিতে দিতে ফিডমিল গুলো মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে, ছোট ও মাঝারি ফিড মিলগুলো বন্ধ হওয়ার শঙ্কায় আছে। বর্তমান এই পরিস্থিতি চলতে থাকলে পোল্ট্রি শিল্পের ভবিষ্যৎ কি হবে তা নিয়ে পোল্ট্রি বিশেষজ্ঞরা শঙ্কা প্রকাশ করছেন।এমতাবস্থায়, উৎপাদনকারীকে (হ্যাচারি, ফিডমিল, খামারি) বাঁচিয়ে রাখতে হলে উৎপাদন খরচের সাথে সামঞ্জস্য রেখে বিক্রয় মূল্য (বাচ্চা, ফিড, ব্রয়লার, ডিম) নির্ধারণও নিশ্চিত করতে হবে। কেবলমাত্র তাতেই পোল্ট্রি  ও পোল্ট্রিশিল্প বেঁচে যাবে এবং দেশে খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়টি সুনিশ্চিত করা সম্ভব হবে। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ এবং সকলের জন্য নিরাপদ ও স্বাস্থ্যকর প্রাণিজ আমিষের সরবরাহ নিশ্চিত করতে বর্তমান পরিস্থিতির পরিবর্তনের জন্য আশু-পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন।