টাইমস হায়ার এডুকেশন ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি র‌্যাঙ্কিং-এ বাকৃবি ও কিছু কথা

ড. মোঃ আলমগীর হোসেন:টাইমস হায়ার এডুকেশন ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি র‌্যাংকিং ২০২২-এ প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বাকৃবি) স্থান করে নিয়েছে। দেশের কৃষি শিক্ষার সর্বোচ্চ এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সবাইকে প্রানঢালা অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা। যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় বরাবরের মতো এবারও তালিকার শীর্ষে রয়েছে। বিশ্বের সেরা দশের তালিকায় যুক্তরাষ্ট্রের 8 টি বিশ্ববিদ্যালয় (ক্যালটেক হার্ভার্ড, স্ট্যানফোর্ড, এম আই টি, প্রিন্সটন, ক্যালিফোর্নিয়া, ইয়েল, এবং শিকাগো) এবং যুক্তরাজ্যের ২ টি বিশ্ববিদ্যালয় (অক্সফোর্ড, এবং ক্যামব্রিজ) রয়েছে।

বাংলাদেশ থেকে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় সহ ৩ টি বিশ্ববিদ্যালয় এই টাইমস হায়ার এডুকেশন ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি র‌্যাংকিং-২০২২ এ রয়েছে। এই  রাঙ্কিং এ স্থান পাওয়া মোট ১৬৬২ টি বিশ্ববিদ্যালয় এর মধ্যে বাকৃবি এর গ্লোবাল র‌্যাংকিং হল ১০০১–১২০০ এবং লোকাল র‌্যাংকিং হল ০২। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় এর গ্লোবাল  র‌্যাংকিং হচ্ছে যথাক্রমে ৮০১–১০০০ এবং ১২০১+। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত থেকে ৭১ টি এবং পাকিস্তান থেকে ২১ টি বিশ্ববিদ্যালয় এই র‌্যাংকিং এ স্থান করে নিয়েছে। বুয়েট গত বছরের র‌্যাংকিং এ প্রথমবারের মতো স্থান করে নিয়েছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ২০১৬ এর র‌্যাংকিং এ প্রথমবারের মতো জায়গা করে নিলেও ২০১৭ ও ২০১৯ এর র‌্যাংকিং তালিকায় আবার অনুপস্থিত ছিল!! তাই টাইমস হায়ার এডুকেশন ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি র‌্যাংকিং এ সর্বদা অবস্থান ধরে রাখা ও এর উন্নয়নে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনসহ সবাইকেই কাজ করে যেতে হবে।
 
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা, গবেষণা, প্রকাশনা, আন্তর্জাতিকীকরণ, একাডেমিয়া-ইন্ডাস্ট্রি সহযোগিতার মাত্রা ইত্যাদির উপর ভিত্তি করে বিশ্বের অনেক প্রতিষ্ঠানই বিশ্ববিদ্যালয়ের র‌্যাংকিং করে থাকে এবং মাঝে মাঝেই আমরা মিডিয়াতে সেই ফলাফল দেখতে পাই। একজন ছাত্র উচ্চশিক্ষার জন্য কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবেন, শিক্ষক/ গবেষক কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াবেন বা গবেষণা করবেন, অর্থায়নকারী প্রতিষ্ঠানসমূহ কোথায় অর্থ বরাদ্দ দিতে পছন্দ করবে, নীতি নির্ধারকগণ বিশ্ববিদ্যালয় এর মান উন্নয়নে কি ধরনের পরিকল্পনা প্রণয়ন করবেন, স্কলারশিপ প্রাপ্তি, বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক মূল্যায়ন ইত্যাদিতে এই র‌্যাংকিং বিশেষ ভূমিকা রাখে। সারাবিশ্বে মূলত টাইমস হায়ার এডুকেশন, কিউ এস এবং সাংহাই এই তিনটি গ্লোবাল র‌্যাংকিং এর ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা থাকলেও টাইমস হায়ার এডুকেশন কর্তৃক প্রণীত বিশ্ববিদ্যালয়ের র‌্যাংকিং সারা দুনিয়াতে ছাত্র, শিক্ষক, গবেষক, প্রতিষ্ঠান নির্বাহী, ইন্ডাস্ট্রি, এবং নীতি নির্ধারক গণ কর্তৃক সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য ও সবচাইতে প্রভাবশালী র‌্যাংকিং। বাংলাদেশ সরকারও বিভিন্ন স্কলারশিপ (যেমন প্রধানমন্ত্রী ফেলোশিপ) এর জন্য স্কলার নির্বাচনে একমাত্র টাইমস হায়ার এডুকেশন এর র‌্যাংকিং এ প্রথম দিকে থাকা বিশ্ববিদ্যালয় সমূহে ভর্তির বিষয়টিকেই বিবেচনায় নিয়ে থাকে।

লন্ডন-ভিত্তিক প্রভাবশালী টাইমস হায়ার এডুকেশন ম্যাগাজিন ২০০৪ সাল থেকে কিউ এস এর সাথে যৌথভাবে বিশ্ববিদ্যালয় র‌্যাংকিং প্রকাশ করছে। ২০০৯ থেকে কিউ এস এবং টাইমস হায়ার এডুকেশন আলাদাভাবে র‌্যাংকিং করে আসছে। তবে টাইমস হায়ার এডুকেশন ২০০৯ থেকে ২০১৩ এ থমসন রয়টার্স এর সাথে এবং ২০১৪ থেকে অদ্যাবধি এলসেভিয়ের এর সাথে পার্টনারশিপে এই র‌্যাংকিং প্রকাশ করে আসছে।

টাইমস হায়ার এডুকেশন এর র‌্যাংকিং তালিকায় বিশ্ববিদ্যালয়কে থাকতে হলে নিম্নোক্ত ন্যূনতম মানদণ্ড পূরণ করতে হয়ঃ
(১) বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাফিলিয়েশনে বিগত পাঁচ বছরে কমপক্ষে ১০০০ এবং বছরে কমপক্ষে ১৫০ টি স্কোপাস ইন্ডেক্সড প্রকাশনা থাকতে হয়।
(২) বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা কেন্দ্রিকতা একাধিক বিষয়ের উপর থাকতে হবে এবং মোট প্রকাশনার ৮০% বা অধিক একই বিষয়ের উপরে হলে র‌্যাংকিং এ থাকার সুযোগ থাকেনা।
(৩) বিশ্ববিদ্যালয়ের অবশ্যই আন্ডার-গ্রাজুয়েট প্রোগ্রাম চালু থাকতে হয়।
(৪) বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক টাইমস হায়ার এডুকেশন ডাটা পোর্টালে নিয়মিত বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যাদি প্রদান করতে হয়।
(৪) কমপক্ষে একটি বিষয়ের এর বিপরীতে ডাটা প্রদান করতে হবে, ইত্যাদি।

টাইমস হায়ার এডুকেশন মোটা দাগে শিক্ষা (৩০%), গবেষণা (৩০%), সাইটেশন (৩০%), ইন্টারন্যাশনাল আউটলুক (৭.৫%) এবং ইন্ডাস্ট্রি ইনকাম (২.৫%) ইনডিকেটর সমূহে প্রাপ্ত স্কোর থেকে র্যাঙ্কিং এর কাজটি করে থাকে। শিক্ষার ক্ষেত্রে মোট স্কোর (৩০%) এর মধ্যে প্রতিষ্ঠানের টিচিং রেপুটেশন (১৫%), ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত (৪.৫%), পিএইচডি ছাত্র ও ব্যাচেলর ছাত্রের অনুপাত (২.২৫%), প্রদান-কৃত ডক্টরেট ডিগ্রী ও শিক্ষকের অনুপাত (৬%), শিক্ষক প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট অর্থ বরাদ্দ (২.২৫%); গবেষণার ক্ষেত্রে মোট স্কোর (৩০%) এর মধ্যে গবেষণা রেপুটেশন (১৮%), শিক্ষক প্রতি বরাদ্দ গবেষণা ফান্ড (৬%), শিক্ষক/গবেষক প্রতি প্রকাশনার সংখ্যা (৬%); এবং ইন্টারন্যাশনাল আউটলুক এর ক্ষেত্রে মোট স্কোর ৭.৫%, যার মধ্যে দেশি-বিদেশি ছাত্রের অনুপাত ২.৫%, দেশি-বিদেশি শিক্ষকের অনুপাত ২.৫%, ও মোট প্রকাশনায় বিদেশি অথর সংখ্যা/ ফরেন কোলাবোরেশন ২.৫%।

উপরোক্ত নির্দেশক সমূহের স্কোর হিসাবের জন্য টাইমস হায়ার এডুকেশন নিন্মোক্ত তিনটি উৎস থেকে ডাটা সংগ্রহ করে এবং নির্দিষ্ট মেট্রিক্স এ ১০০ এর মধ্যে স্কোর হিসাব করে র‌্যাংকিং প্রকাশ করে থাকে।

(১) টাইমস হায়ার এডুকেশন পোর্টালে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সরবারহকৃত ভেরিফাইড ডাটা। (২) রেপুটেশন সার্ভে, THE এর সহযোগী এলসেভিয়ের (Elsevier) অনলাইনে একাডেমিসিয়ান/ গবেষকদের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করে) এবং (৩) সকল প্রকাশনা সংশ্লিষ্ট ডাটা স্কোপাস ডাটাবেজ থেকে নেয়া হয়।

কোন নির্দেশক এর বিপরীতে কোন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক প্রাপ্ত সর্বোচ্চ মানকে মোট ১০০ ধরে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য প্রাপ্ত মানকে আপেক্ষিকভাবে হিসাব করে স্কোর তৈরি করা হয় যদিও অনেক ক্ষেত্রেই ডাটা নর্মালাইজেশন এর দরকার হয়, তাও করা হয় সুনির্দিষ্ট নিয়মে!
টাইমস হায়ার এডুকেশন-এর র‌্যাংকিং পদ্ধতি থেকে দেখা যাচ্ছে তারা স্কোপাস ইন্ডেক্সড প্রকাশনাতে (শিক্ষক/গবেষক প্রতি প্রকাশনা সংখ্যা, সাইটেশন সংখ্যা, বৈদেশিক গবেষকগণের সাথে যৌথ গবেষণায় প্রকাশনার সংখ্যা) সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে এবং যা র‌্যাংকিং সংশ্লিষ্ট মোট স্কোরের ৩৮.৫% কে নিয়ন্ত্রণ করে। তাই স্বাভাবিকভাবেই বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাফিলিয়েশনে কিভাবে স্কোপাস ইন্ডেক্সড জার্নালে প্রকাশনা বাড়ানো যায় সেদিকে আমাদের গভীরভাবে ভাবতে হবে! এর পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণার সুনাম গুরুত্ব পাচ্ছে যা র‌্যাংকিং সংশ্লিষ্ট মোট স্কোরের ৩৩%। আন্তর্জাতিকভাবে আমাদের প্রতিষ্ঠান ও এর অর্জনকে তুলে ধরার পদক্ষেপ নিতে হবে। অন্যান্য সূচকে যাতে আমরা আরো ভাল করতে পারি তার বিভিন্ন মেয়াদি পরিকল্পনাও নিতে হবে। যেমন গবেষণা বরাদ্দ বাড়ানো, বিদেশি ছাত্র ভর্তি বৃদ্ধির উদ্যোগ নেয়া, পি-এইচ, ডি ছাত্র বেশী ভর্তি করা ও যথাসময়ে ডিগ্রি প্রদানের উদ্যোগ নেয়া, ইন্ডাস্ট্রির সাথে সহযোগিতা বাড়িয়ে কিভাবে গবেষণা খাতে বেশি অর্থায়ন করা যায় তার উদ্যোগ সহ মাঝে মাঝে র‌্যাংকিং সংশ্লিষ্ট সেমিনার এবং ওয়ার্কশপ আয়োজন করে করনীয় নির্ধারণ করা।

আমাদের সম্পদের সীমাবদ্ধতার মধ্যেই সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনায় আর আমাদের সকল শিক্ষক-সহকর্মী ও ছাত্র-ছাত্রীদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় কয়েক বছরের মধ্যেই বিশ্বের সেরা ৫০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় থাকবে আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এই হোক আমাদের সকলের প্রত্যাশা।

লেখক: প্রফেসর, ফসল উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগ ও পরিচালক, ফ্যাবল্যাব -বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ