উদ্ভিদ পুষ্টিক্ষয় রোধে ও মাটির স্বাস্থ্য রক্ষায় করনীয়

ড. জগৎ চাঁদ মালাকার:ভাল ফলন পেতে হলে জমিতে নিয়মিত সার দিতে হয়। জমিতে সার দিলে গাছ তার প্রয়োজনীয় খাবার ও পুষ্টি পায়। কোন সার প্রয়োজনের বেশি মাটিতে প্রয়োগ করলে বা প্রয়োজনের কম প্রয়োগ করলে গাছের বিভিন্ন ক্ষতি হয়ে থাকে। এতে আর্থিক ক্ষতিসহ ফলনের এবং মাটির উপর বিরূপ প্রভাব পরে। তাই মাটিতে সঠিক পরিমান সার প্রয়োগ নিশ্চিত করা দরকার।

জৈব পদার্থ  মাটির প্রাণ। আদর্শ মাটিতে শতকরা ৫ ভাগ জৈব পদার্থ থাকা দরকার অথচ গড়ে আমাদের দেশের মাটিতে এর পরিমাণ ১-১.৫ ভাগ যা ফসল উৎপাদনের জন্য যথেষ্ট নয়। এর প্রধান কারন কৃষকগণ জৈব পদার্থের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে তেমন সচেতন নয়। কৃষকরা মাটিতে জৈব সার প্রয়োগ না করে শুধু রাসায়নিক সার প্রয়োগ করে থাকে যা আবার সুষম ও নয়। মাটিতে সঠিক মাত্রা জৈব ও রাসায়নিক সারের সমন্বয়ে সুষম সার প্রয়োগ করা না হলে ধীরে ধীরে মাটির উৎপাদন ক্ষমতা হ্রাস পেতে থাকে। আবার একই জমিতে বার বার একই ফসল আবাদ করলেও সে মাটির উৎপাদন ক্ষমতা হ্রাস পেতে থাকে। তাই সঠিক পদ্ধতিতে জৈব ও রাসায়নিক সারের সমন্বয়ে সুষম মাত্রায় সার প্রয়োগ করা অতীব জরুরী।

উচ্চ ফলনশীল জাত স্থানীয় জাতের চাইতে অধিক হারে মাটি হতে খাদ্য ও পুষ্টি গ্রহণ করে থাকে। আর তাই মাটি পরীক্ষার মাধ্যমে বা  বি. এ. আর. ডস. এর এইজেড ভিত্তিক নির্দিষ্ট ফসলের সার মাটিতে তা প্রয়োগ করা যেতে পারে।

জৈব সারের গুরুত্ব
মাটিতে জৈব পদার্থের পরিমাণ বাড়ায়। মাটির সকল প্রকার ভৌত গুনাবলী যেমন; পানি ধারণ ক্ষমতা, বায়ু চলাচল ক্ষমতা, মাটির রং, মাটির বুনট ইত্যাদি উন্নত করে। মাটির অনুজীবের কার্যবলী বাড়ায়। মাটির পুষ্টি গুন বাড়িয়ে মাটিকে উর্বর করে। মাটির উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ায়। মূল্যবান রাসায়নিক সাররে সাশ্রয় হয়। রাসায়নিক সারের কার্যকরিতা বাড়ায়। বসত বাড়ির সকল আবর্জনা নিয়মিত সংগ্রহ করে গর্তে ফেলা হয় বলে বাড়ি ঘর পরিস্কার পরিচ্ছন্ন থাকে।

উদ্ভিদের গঠন ও জীবনচক্র সম্পন্ন করতে যে সকল মৌলিক উপাদান প্রয়োজন তাদেরকে উদ্ভিদ পুষ্টি বা খাদ্য উপাদান বলা যায়। গাছের বৃদ্ধি, পুষ্টি, ফলন ও গুনাগুন বৃদ্ধির জন্য যে সকল পদার্থ গাছের খাদ্য হিসেবে মাটিতে প্রয়োগ করা হয়, তাকে সার বলা হয়। সার দুই প্রকার ক) জৈব সার যেমন: গোবর, খামারজাত সার ও খ) রাসায়নিক সার যেমন : ইউরিয়া, টিএসপি, এমওপি।

বিভিন্ন সারের কাজ:
নাইট্রোজেন জাতীয় ( ইউরিয়া, ডিএপি, গুটি ইউরিয়া ) সারের কাজ : পাতা সবুজ ও বড় হয়, গাছের কান্ড ও ডালপালার দ্রুত বৃদ্ধি করে, কুশি বাড়ে এবং ফলন বাড়ে।
অভাবজনিত লক্ষন : গাছের গোড়ার দিকের বয়স্ক পাতা প্রথমে হলুদ হয় এবং শেষে পুরো গাছই হলদে বা হালকা সবুজ  হয়ে যায়। গাছের বৃদ্ধি কম হয় এবং গাছ খাটো হয়। কুশির সংখ্যা কমে যায়। গাছের পরিপক্কতা তাড়াতাড়ি আসে। ফলন কমে যায়।
অতিরিক্ত প্রয়োগ করলে : গাছ হেলে পড়ে ও দুর্বল হয়ে যায়। রোগ ও পোকার আক্রমন বেশি হয়। ফলন কমে যায়।

ফসফরাস জাতীয় ( টিএসপি, এসএসপি ও ডিএপি) সারের কাজ : চারা অবস্থায় শিকড় দ্রুত গঠন ও বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। ফুল , ফল বৃদ্ধি করে ও দানা পুষ্ট করে। গাছের পরিপক্কতা আনয়নে সাহায্য করে।
অভাবজনিত লক্ষন : ধান গাছের পাতা খাড়া ও কালচে সবুজ রঙের হয়। কুশি কম, গাছ খাটো হয় এবং ধান কম পুষ্ট হয়। সময়মত ফুল ও ফল আসে না। ফলন কমে যায়।

পটাশ (এমওপি) সারের কাজ : গাছকে শক্ত করে, গাছের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। ফুল, ফল ঝরা কমে।শিকড়ের বৃদ্ধি ভালো হয়। আলু, মিষ্টি আলু ইত্যাদি আকারে বড় হয় । গাছের ভিতর খাদ্যবস্তু স্থানান্তরে সাহায্য করে
অভাবজনিত লক্ষন : বয়স্ক পাতার আগা থেকে হলদে কমলা বা হলদে বাদামী রং ধারন করে। উপরের থেকে নিচের দিকে ক্রমান্বয়ে শুকিয়ে যায়। ফুল/ফল ঝরে। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস পায়। দানার আকার ছোট হয়,ওজন কমে যায় এবং ফলন কম হয়।

গন্ধক (জিপসাম) সারের কাজ: গাছের গাঢ় সবুজ রং রক্ষায় সহায়তা করে এবং গাছের বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। গাছে বিভিন্ন ভিটামিন ও হরমোন তৈরিতে সাহায্য করে।তৈলবীজ ফসলে তেলের পরিমান বৃদ্ধি করে এবং পিয়াজ, রসুন ও সরিষার ঝাঁঝ আনয়নে সহায়তা করে
অভাবজনিত লক্ষন :গাছের কচি পাতা হলুদ হয়।গাছের বৃদ্ধি ব্যাহত হয়, কুশি কমে যায়। দেরিতে পরিপক্ক হয়।ক্ষেতের যে অংশে পানি জমে থাকে সেখানে গাছের পাতা হলুদ হয়ে যায়।

দস্তা (জিংক) সারের কাজ :বীজ গঠন ও পাতার সবুজ কনা তৈরিতে সাহায্য করে।মাটি থেকে বিভিন্ন পুষ্টি উপাদান গ্রহনে সাহায্য করে। ফুল ফোটানো, ফল ও বীজ গঠনে সহায়তা করে। গাছকে সমভাবে বৃদ্ধিতে সাহায্য করে
অভাবজনিত লক্ষন : কচি পাতার গোড়া বা মধ্যশিরা সাদা হয়ে যায়। গাছের বৃদ্ধি সমান হয় না বলে কোথাও উঁচু, কোথাও নিচু দেখায়। বয়স্ক পাতায় মরিচা রঙের দাগ পড়ে। দেরিতে পরিপক্কতা আসে।

বোরন সারের কাজ: গাছের কোষের দেয়াল শক্ত করে। ডগা ও শিকড়ের বৃদ্ধি হয়। ফল ফেটে যাওয়া বন্ধ করে। নিষিক্তকরন ও দানা গঠনে সাহায্য করে।ভুট্রা, তৈলবীজ, ছোলা, আলুর ফলন বাড়ায়
অভাবজনিত লক্ষন : ফল ফেটে যায়।ফল এবড়ো তেবড়ো, বিকৃত হয়। ফল ঝরে।ভুট্রার মোচায় ফাঁকা ফাঁকা দানা হয়। দানা পুষ্ট হয় না । সরিষার দানা হয় না বা হলেও বীজে তেলের পরিমান কমে যায়।

ম্যাগনেসিয়াম সারের কাজ: পাতার সবুজ কনিকা গঠনে গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা রাখে। গাছের ভিতর ফসফরাসের বাহক হিসেবে কাজ করে। গাছের অন্যান্য খাদ্য উপাদান গ্রহন নিয়ন্ত্রিত করে।
অভাবজনিত লক্ষন : পাতার সবুজ বর্ন বিনষ্ট হয়, ধান গাছের পাতা কমলা রং ধারন করে, পাতা নুইয়ে পড়া। ভুট্রার পাতায় সাদা ডোরা দাগ দেখা যায়। তুলা গাছের পাতা বেগুনী বর্ন ধারণ করে, তামাক পাতার কিনারা ও আগা লালচে বর্ণ ধারন করে, উপরের দিকে কিছুটা বেঁকে যায়। সরিষার বয়স্ক পাতায় গাঢ় কমলা, লাল বেগুনী দাগ দেখা দিতে পারে।

মাটিতে বিভিন্নভাবে গাছের প্রয়োজনীয় উদ্ভিদ পুষ্টি উপাদান যোগ হয় ও চলে যায়। উদ্ভিদ পুষ্টি  যোগ ও উদ্ভিদ ক্ষয় হওয়ার এ প্রক্রিয়াই হল পুষ্টি প্রবাহ। কৃষকরা যদি পুষ্টি যোগ হওয়া ও বিয়োগ হওয়ার পথগুলো চিনতে পারে তাহলে তারা মাটিতে পুষ্টি উপাদানের ভারসাম্য বজায় রেখে ভাল ফসল ফলাতে সক্ষম হবে। তাই, কৃষকদের উদ্ভিদ  পুষ্টি ক্ষয় ও উদ্ভিদ পুষ্টি যোগ সম্পর্কে একটি সাধারণ ধারণা দেয়া দরকার যাতে তারা উপযুক্ত ফসল নির্বাচন, সার ব্যবস্থাপনা, শস্য পর্যায় ইত্যাদি অবলম্বন করে মাটির উর্বরতা বজায় রেখে তথা মাটিতে উদ্ভিদ পুষ্টির সাম্যাবস্থা রেখে উত্তম ফসল ফলাতে পারে।

জমিতে অনবরত ফসল উৎপাদনের সময় প্রয়োজনীয় সার জমিতে প্রয়োগ না করা হলে জমিতে মজুদকৃত (ইউরিয়া টিএসপি এমপি ) পুষ্টি উপাদানের পরিমাণ দিনে দিনে কমতে থাকে তাকে পুষ্টি ক্ষয় বলা হয়। জমিতে বিভিন্ন উপায়ে পুষ্টি উপাদানের যেমন ক্ষয় হয় তেমনি বিভিন্ন উপায়ে পুষ্টি উপাদান যোগও হয়ে থাকে। পুষ্টি উপাদানের এইরূপ চলে যাওয়া এবং যোগ হওয়াকে পুষ্টি প্রবাহ বলা হয়ে থাকে।

উদ্ভিদ পুষ্টি উপাদান যোগ ও ক্ষয় হওয়ার পথসমূহ


উদ্ভিদ পুষ্টির ভারসাম্য বজায় রাখার পদ্বতি:
সারের অপচয় রোধ তথা পুষ্টি উপাদানের ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য মাটি পরীক্ষা করে সুষম মাত্রায় ফসলের চাহিদাভিত্তিক সার প্রয়োগ করা। প্রয়োজনে মিশ্র সার প্রযোগ করা। গুড়া ইউরিয়া সারের বদলে গুটি ইউরিয়া সারের ব্যবহার করা এতে গ্যাসীয় ক্ষয় এবং চুয়ানো ক্ষতি কমবে। গাছের পাতার রঙ দেখে সার দেয়া (এলসিসি ব্যবহার)। জমিতে পর্যাপ্ত পরিমাণে জৈব সার প্রয়োগ করা এতে মাটির বুনট উন্নত হবে এবং মাটির পানি ধারন ক্ষমতা বাড়বে। ফসলের অবশিষ্টাংশ/খড়, আগাছা মাটিতে মেশানো। ডালজাতীয় ফসলের চাষ করা । সবুজ সার, বাদামী সার(মুগডাল) ফসলের চাষ ও জমিতে মেশানো। কিস্তিতে ইউরিয়া সার প্রয়োগ করা ইত্যাদি। প্লাবন সেচ ব›ধ করা। অতি বৃষ্টির জন্য মাটির ক্ষয় রোধে জমির আইল উচু করা। ইট ভাটায় ব্যবহৃত কৃষি জমির উপরের মাটি কাটা বন্ধ করা। মাটিতে সঠিক মাত্রা জৈব ও রাসায়নিক সারের সমন্বয়ে সুষম সার প্রয়োগ করা। বার বার একই ফসল না করে বিভিন্ন ফসল ধরনের মূলের গভীরতা সম্পন্ন ফসল চাষ করা এতে করে মাটির বিভিন্ন গভীরতা থেকে গাছ পুষ্টি উপাদান নিবে ফলে মাটিতে উদ্ভিদ পুষ্টির ভারসাম্য বজায় থাকবে।

লেখক:উপপরিচালক (এল.আর)
সংযুক্ত উদ্ভিদ সংগনিরোধ উইং
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, খামারবাড়ি, ঢাকা।
ইমইেল:This email address is being protected from spambots. You need JavaScript enabled to view it.