কৃষিপণ্য আমদানি-রপ্তানিতে প্ল্যান্ট কোয়ারেন্টাইন ব্যবস্থাপনার গুরুত্ব

ড. জগৎ চাঁদ মালাকার:বাংলাদেশ পৃথিবীর কৃষি প্রধান একটি দেশ। কৃষি খাদ্য আমদানি নির্ভরতা কমানোর জন্য দেশের প্রতি ইঞ্চি জমি ফসল ফলানোর কাজে লাগানোর জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দিক নির্দেশনা দিয়েছেন। কৃষি যান্ত্রিকীকরণের সাথে সাথে ব্যবহার করতে হবে লাগসই প্রযূক্তি। আর ন্যায্যমূল্যে সরবরাহ করতে হবে সার, সেচ, বীজ, কীটনাশক ইত্যাদি। সরকারি নির্দেশনা মেনে সরকারী, বেসরকারী বা স্বায়িত্বশাসিত প্রতিটি অফিসের পতিত জমি কৃষি কাজে লাগানোর কার্যকরী উদ্যোগ অত্যন্ত জরুরি। আগামী দিনের কৃষিতে করোনার মতো অজানা রোগ জীবাণু সংক্রমণ ঘটলে খাদ্য সমস্যা হতে পারে।

বিশাল জনসংখ্যার খাদ্য ও পুষ্টি যোগানের পাশাপাশি কর্ম সংস্থান সৃষ্টি, আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন ও দারিদ্র দূরীকরণে কৃষি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৮০ ভাগ লোক প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কৃষির উপর নির্ভরশীল। দেশের মোট শ্রম শক্তির শতকরা ৪৫.৬ ভাগ কৃষি কাজে নিয়োজিত। ২০১৫-১৬ অর্থ বছরে জিডিপি’তে কৃষি খাতের অবদান ১৫.৩৩% (অর্থনৈতিক সমীক্ষা, ২০১৬)। দেশের মোট জনসংখ্যা ইতোমধ্যেই ১৬ কোটি অতিক্রম করেছে। প্রতি বছর এই জনসংখ্যার সাথে ২০ লক্ষ নতুন মূখ যোগ হচ্ছে। এই বাড়তি জনসংখ্যার জন্য প্রতি বছর প্রায় ৩ লক্ষ মেট্রিক টন অতিরিক্ত খাদ্যের প্রয়োজন। তাই ক্ষুদ্র দেশের বিশাল জনসংখ্যার খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ অত্যন্ত জরুরী।

কৃষি বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি। কিন্তু কৃষি জমির উপর ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার অব্যাহত চাপ, প্রতি বছর উল্লেখযোগ্য হারে কৃষি জমি অকৃষি খাতে চলে যাওয়া, প্রতিবছর আমদানিকৃত উদ্ভিদ ও উদ্ভিদজাত পণ্যের সাথে বা বিভিন্ন উপায়ে বালাই প্রবেশ করে ফসল বিনষ্ট হওয়ার কারণে খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মধ্যে পড়েছে। ২০১২-১৩ সালে যেখানে উদ্ভিদ ও উদ্ভিদজাত পণ্য আমদানির পরিমান ছিল প্রায় ৭৫ লক্ষ মেট্রিক টনের মত সেখানে বর্তমান ২০১৭-১৮-তে  আমদানির পরিমান দাঁড়িয়েছে ১ কোটি ৮৬ লক্ষ মেট্রিক টন। অপরদিকে একই সময়ে যেখানে রপ্তানির পরিমান ছিল ৮ লক্ষ মেট্রেক টন সেখানে গত ৬ বছরে রপ্তানির পরিমান মাত্র ২ লক্ষ টন বৃদ্ধি পেয়ে বর্তমানে দাঁড়িয়েছে প্রায় ১০ লক্ষ টনের মত (৯.৯৫ লক্ষ মে.টন)।   

বর্তমান সরকার ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণে নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। কৃষি বাংলাদেশের অর্থনীতির এখনও প্রাণশক্তি। সীমিত কৃষি জমির সর্বোত্তম ব্যবহার, শস্য চাষের নিবিড়তা বৃদ্ধি, উন্নত কৃষি ব্যবস্থাপনা প্রবর্তন করেও বিশাল জনগোষ্ঠীর খাদ্য যোগান দেয়া কষ্টকর হয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশে গত অর্থবছরে এক কোটি ছিয়াশি লক্ষ মেট্রিক টন উদ্ভিদ ও উদ্ভিজাত পণ্য আমদানি করতে হয়েছে যা মাত্র পাঁচ বছর পূর্বেও ছিল মাত্র এর অর্ধেকেরও কম। এভাবে উদ্ভিদ ও উদ্ভিজাত পণ্য আমদানির পরিমান বৃদ্ধি পেলে আমরা অন্য সেক্টর থেকে যে বৈদেশিক মূদ্রা প্রাপ্ত হই তা দিয়েও খাদ্য নিরাপত্তা বলয় সৃষ্টি করা সম্ভব হবেনা। তাছাড়া যে পরিমানে আমরা পণ্য আমদানি করি তার মাধ্যমে যেকোন পণ্য দিয়ে বা যেকোন ভাবে বিদেশ থেকে ফসলের জন্য মারাত্বক ক্ষতিকর বালাই দেশে প্রবেশ করে কৃষি উৎপাদন ব্যহত করে খাদ্য নিরাপত্তা বিঘ্নিত করতে পারে যেমন বর্তমানে গমের ব্লাষ্টের কারণে গত তিন বছরে আমাদের উৎপাদন কমেছে প্রায় তিন লক্ষ মেট্রিক টন আবার গত বছর ভুট্টার ফল অর্মি ওয়ার্ম  প্রবেশের মাধ্যমে আশানুরূপ ভুট্টার ফলন পাওয়ার সম্ভবনা কম। ফলে বিদেশী বালাই প্রবেশরোধের মাধ্যমে দেশের কৃষিকে রক্ষা করে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত রাখতে এবং উৎপাদনশীলতা ধরে রাখতে ও দারিদ্র বিমোচনে accredited laboratory গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

বর্তমান সরকারের কৃষিবান্ধব নীতির কারণে দানাদার খাদ্যশস্যের পাশাপাশি শাক সবজি ও ফলমূল উৎপাদনে দেশে ব্যাপক সাফল্য অর্জিত হয়েছে। শাক-সবজি উৎপাদনে বিশ্বে বর্তমানে বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয়। কিন্তু উৎপাদিত কৃষিজ পণ্য রপ্তানির এক বিশাল সম্ভবনা থাকলেও সেই সুযোগ আমরা পুরোপুরি কাজে লাগাতে পারছি না। আমাদের দেশে কৃষিজ পণ্য উৎপাদনে এখনো অর্গানিক ফার্মিং/ কনট্রাক্ট ফার্মিং এর ব্যাপক প্রসার ঘটেনি। ফলে প্রথাগতভাবে কৃষিজ পণ্য উৎপাদনে অনিয়ন্ত্রিত কীটনাশক, সার ইত্যাদি ব্যবহার হচ্ছে। আর কনট্রাক্ট ফার্মিং ছাড়াই কৃষিজাত এই সব পণ্যের উৎপাদন থেকে শুরু করে বাজারজাত করা পর্যন্ত তাতে কি কি ইনপুট (সার, কীটনাশক ইত্যাদি) কি মাত্রায় কখন প্রয়োগ করা হচ্ছে তার সুনির্দিষ্ট তথ্য লিপিবদ্ধ করা হয়না। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কর্তৃক দেশের বিভিন্ন অঞ্চল হতে শাক সবজি সংগ্রহ করে কীটনাশক অবশিষ্টাংশের বিষক্রিয়ার মাত্রা পরীক্ষা করা হয়। কিন্তু আন্তর্জাতিক ভাবে স্বীকৃত accredited laboratory না থাকায় দেশের জন্য গ্রহণযোগ্য এম.আর.এল অথবা একসেপটেবল ডেইলি ইনটেক (এডিআই) মাত্রা নির্ণয় করা সম্ভব হয়নি।

বর্তমানে বাংলাদেশে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কোন accredited laboratory নাই। বাংলাদেশ বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার সদস্য রাষ্ট্র এবং International Plant Protection Convention (IPPC) এ স্বাক্ষরকারী দেশ। তাই বিশাল জনগোষ্ঠীর খাদ্য নিরাপত্তার জন্য দেশের কৃষিকে রক্ষার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে WTO-SPS Agreement এবং International Plant Protection Convention (IPPC) এর বিধি বিধান অনুসরণ করা সকল দেশের জন্য বাধ্যতামূলক। WTO-SPS Agreement এবং IPPC এর বিধি-বিধান অনুসরণ করার জন্য পৃথিবীর সকল দেশই আলাদাভাবে স্বতন্ত্র স্বাধীন সংস্থা সৃষ্টি করেছে যা বাংলাদেশে অদ্যাবধি সৃষ্টি হয়নি। ফলে বাংলাদেশে উদ্ভিদ সংগনিরোধ কার্যক্রম গতি লাভ করছে না। IPPC এর বিধান অনুসারে উদ্ভিদ সংগনিরোধের যে সংস্থা থাকবে তার Administrative, Legislative and Financial ক্ষমতা থাকতে হবে। বর্তমান সরকার ২০১১ সালে উদ্ভিদ সংগনিরোধ আইন পাশ করেছে।

উদ্ভিদ সংগনিরোধ একটি পুরোপরি কারিগরী ও আইনি বিষয়। দেশের কৃষিকে রক্ষা করার জন্য যেমন আমদানিকৃত পণ্যে বিদেশী কোন বালাই আছে কিনা তা ল্যাবরেটরীতে পরীক্ষান্তে নিশ্চিত হতে হয় ঠিক তেমনি রপ্তানিকৃত পণ্য আন্তর্জাতিক বিধি-বিধান মতে আমদানিকারক দেশের আমদানি শর্ত পূরণ হয়েছে কিনা তাও মাঠ পর্যায়ে এবং ল্যাবরেটরীতে পরীক্ষান্তে নিশ্চিত হতে হয়। যারা নিয়মিত এ কাজগুলো করবেন তারা দক্ষতা অর্জন করবেন কিন্তু তারা যদি না থাকেন তা হলে আমদানিকারক দেশের আমদানি চাহিদা পূরণ করে রপ্তানি করা সম্ভব হয়না ঠিক তেমনি আমদানিকৃত পণ্যের সাথে বিদেশী ধ্বংসাত্বক বালাই প্রবেশ করে দেশের কৃষিকেও ধ্বংস হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করা যাবেনা।

বর্তমান সরকার  উদ্ভিদ সংগনিরোধ আইন, ২০১১ অনুযায়ী আলাদা করে উদ্ভিদ সংগনিরোধ কর্তৃপক্ষ তৈরি করার কাজ শুরু করেছে। রপ্তানি বৃদ্ধির জন্য জনবলসহ রপ্তানিযোগ্য আলুসহ,শাক-সবজি ও ফলমূল এবং আমদানিকারক দেশের আমদানি চাহিদা পূরণের জন্য কৃষিজাত পন্যের রপ্তানি বৃদ্ধিকল্পে রপ্তানি পূর্ব আন্তর্জাতিক ভাবে স্বীকৃত accredited laboratory ল্যাবরেটরীতে পরীক্ষা ব্যবস্থা করা। Accredited laboratory জনবলকে ল্যাবরেটরী পরীক্ষা, স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং সিস্টেম (এসওপি), ফাইটোস্যানিটারী ইনসপেকশন, স্যাম্পলিং, উদ্ভিদ সংগনিরোধ বিষয়ক আন্তর্জাতিক বিধি-বিধান, ট্রেড ফেসিলিটেশন, ইত্যাদি বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদান করে দক্ষ করে গড়ে তুলতে হবে।

বহিঃদেশে Market Access সৃষ্টি হবে এবং দেশের উৎপাদিত পণ্যের শাকসজ্বি এবং ফল WTO-SPS Agreement এবং International Plant Protection Convention (IPPC) এর বিধিবিধান অনুসরণের মাধ্যমে নিরাপদভাবে রপ্তানি করা সম্ভব হবে। রপ্তানী আয় বৃদ্ধি পাবে। এশিয়া, ইউরোপ এবং অন্যান্য দেশে আলু, পান, বিভিন্ন ধরনের শাকসব্জি এবং ফলের রপ্তানি বৃদ্ধি পাবে। উদ্ভিদ সংগনিরোধ বিষয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সাথে তাল মিলিয়ে চলা সম্ভব হবে ফলে রপ্তানিকৃত পণ্যের ইন্টারসেপশন কম হবে। আমদানিকৃত পণ্যের মাধ্যমে Invasive Alien Specis (IAS)/Quarantine Pest বা Regulated Non Quarantine Pest প্রবেশে বাধা প্রদানের মাধ্যমে দেশের কৃষিকে বহিঃদেশীয় ধ্বংসাত্বক বালাই থেকে রক্ষা করা।

আগামী দিনের বিশ্ব পরিস্থিতি কি হবে আর আমাদের জন্যই বা কি অপেক্ষা করছে তা পুরোপুরি অনিশ্চিত। এরই মধ্যে কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হয়ে আগামীতে খাদ্য সংকট হতে পারে মর্মে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো এরই মধ্যে সতর্ক করেছেন। কৃষি মন্ত্রালয়ের দায়িত্বে মাননীয় কৃষিমন্ত্রী মহোদয় করোনা কালীণ সময় এ, খাদ্য সমস্যা মোকাবিলার জন্য নিরন্তর কাজ করে যাচ্ছেন। আগামী দিনের কৃষিতেও করোনার মতো অজানা রোগজীবাণু সংক্রমণের ভয়াল থাবায় খাদ্য সমস্যা প্রকটতর পর্যায়ে পৌঁছতে পারে। কৃষিপন্য আমদানী রপ্তানীর জন্য নতুন নতুন বাজার অনুসন্ধান করা জরুরি। এই কঠিন বাস্তবতা উপলদ্ধির এখনই প্রকৃত সময়। প্রয়োজনে এই সংক্রান্ত সেল গঠন করে দেশওয়ারী পণ্যের চাহিদা এবং ফাইটোসেনেটারী শর্তসমূহ সংগ্রহ করে আমাদের দেশ হতে কিভাবে শর্ত পূরণ করে আরো অধিকতর কৃষিজ পণ্য রপ্তানী করা যায় এই ব্যাপারে বিদেশি দূতাবাসে কর্মরত কর্মাশিয়াল কাউন্সেলরগণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন। বাংলাদেশি দূতাবাসে নিযুক্ত কানাডা, আমেরিকান কর্মাশিয়াল কাউন্সেলর মাঝে মধ্যেই বাংলাদেশি স্টেক হোল্ডারদের সাথে মতবিনিময় করেন যেন তাদের দেশে উৎপাদিত পণ্য বাংলাদেশে প্রবেশে কোন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি না হয়।

বর্তমান সরকার ২০১১ সালে উদ্ভিদ সংগনিরোধ আইন, ২০১১ পাশ করেছে এবং তাতে উদ্ভিদ সংগনিরোধ কর্তৃপক্ষ সৃষ্টির কথা বলা থাকলেও অদ্যাবধি উদ্ভিদ সংগনিরোধ কর্তৃপক্ষ সৃষ্টি করা হয়নি।বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি কৃষি, কৃষিজাত পণ্য আমদানি-রপ্তানিতে ও প্ল্যান্ট কোয়ারেন্টাইন কাযক্রমে আন্তর্জাতিক মানের ল্যাবরেটরি না থাকলে আগামী দিনের কৃষিতেও করোনার মতো অজানা বিদেশী ধ্বংসাত্বক রোগজীবাণু প্রবেশ করে  সংক্রমণের ভয়াল থাবায় খাদ্য সমস্যা প্রকটতর পর্যায়ে পৌঁছতে পারে।

উদ্ভিদ সংগনিরোধ কর্তৃপক্ষ ও প্ল্যান্ট কোয়ারেন্টাইন ল্যাবরেটরি (accredited laboratory ) সৃষ্টি করা হলে বহিঃদেশে Market Access সৃষ্টি হবে এবং দেশের উৎপাদিত পণ্যের শাকসজ্বি এবং ফল WTO-SPS Agreement এবং International Plant Protection Convention (IPPC) এর বিধিবিধান অনুসরণের মাধ্যমে নিরাপদভাবে রপ্তানি করা সম্ভব হবে। সুতরাং আগামী দিনের প্ল্যান্ট কোয়ারেন্টাইন (উদ্ভিদ সংগনিরোধ) ব্যবস্থাপনা কিভাবে যুগোপযোগি করা যায় তা এখন থেকেই চিন্তা ভাবনা করার সময় এসেছে।

লেখক:উপপরিচালক (এল.আর)
সংযুক্ত উদ্ভিদ সংগনিরোধ উইং
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, খামারবাড়ি, ঢাকা।
ইমইেল:This email address is being protected from spambots. You need JavaScript enabled to view it.