পুষ্টিগুণে ভরপুর-কাজু বাদাম ও কাজু আপেল

কৃষিবিদ মোঃ কবির হোসেন:কাজু বাদাম একটি গ্রীষ্মমন্ডলীয় ফল। বাংলাদেশের সর্বত্র এর চাষ সম্ভব। কাজু বাদামকে বলা হয় প্রাকৃতিক পুষ্টিকর ফল। এর ২টি অংশ খাওয়ার উপযোগী। কাজু অর্থাৎ আপেল অত্যন্ত রসালো এবং বাদাম অতিকর পুষ্টিকর খাবার। পাকা কাজু আপেল সাধারণ আপেলের মত খাওয়া যায়। কিন্তু বাদাম কাঁচা অবস্থায় খাওয়ার উপযোগী নয়। প্রক্রিয়াজাত করার পর বাদাম খাওয়া হয়। খাদ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টি সমস্যা সমাধানে কাজু বাদামের ভূমিকা অপরিসীম।

কাজু আপেল
কাজু আপেল স্বাদে মিষ্টি এবং এতে  প্রায় ৭০% পানি থাকে। গাছ থেকে পাকা আপেল পেরে সহজে খাওয়া যায়। কাজু আপেলের ত্বকে Urushiol থাকে যার কারণে চামড়ায় চুলকানি ও এলারজি হতে পারে। পাহাড়িরা সতেজ পাকা আপেল কেটে লবণ-মরিচের গুড়া মিশিয়ে খেতে বেশ পছন্দ করে। কাজু বাদাম  তরকারী হিসেবে রান্না করে খাওয়া যায়। ভিনেগারের সাথে মিশিয়ে গাঁজন করে এলকোহল পানীয় হিসেবে তৈরি করে অনেক দেশে পান করা হয়। তাছাড়া চাটনি,জ্যাম ও জেলি তৈরি ও সংরক্ষণে  ভারত ও ব্রাজিলে ব্যাপকভাবে এর ব্যাবহার হয়। কাজু আপেল ভিনেগারে গাঁজন করে ভারত, তানজানিয়া, মোজাম্বিক ও ব্রাজিলে এলকোহল পানীয় তৈরি করা হয়। ভারত ও পাকিস্থানে বিভিন্ন মিষ্টি তৈরি ,বরফি ও কোরমা তৈরিতে কাজু আপেল ও বাদাম ব্যাবহার করা হয়।মোজাম্বিকে কাজু কেক তৈরিতে এবং থাইল্যান্ড ও চীনে রান্নায় তরকারী হিসেবে এর ব্যাপক ব্যাবহার হয়। কাজু আপেল থেকে জুস তেরি করা হয় যা অনেক দেশে মূল্য়বান জুস হিসেবে পান করা হয়। কাজু আপেলে প্রচুর পরিমানে চিনি,আয়রন,ফসফরাস,ক্যালসিয়াম, ভিটামিন-সি থাকে। দেহের ফ্যাট ও কার্বহাইড্রেট দহনে কাজু জুস ভুমিকা রাখে। এতে Lutein এবং Zeaxanthin নামক এন্টিঅক্সিডেন্ট থাকে যা মানব দেহের জন্য বেশ উপকারি।

কাজু বাদাম
কাজু বাদামের বেসুমার পুষ্টি গুন। আমাদের সপ্তাহে ৩-৪ দিন পরিমিত কাজু বাদাম খাওয়া দরকার। বেশি পরিমানে বাদাম খেলে এলার্জি হতে পারে। তাছাড়া কাজুবাদামে অক্সালেট থাকার কারণে বেশি পরিমানে খেলে কিডনি নষ্ট হতে পারে। কাাঁচা বাদামের খোলসে Urushiol, Anacardic acid এবং Cardanol থাকে যার ফলে চামড়া পুড়ে  ক্ষতের সৃষ্টি হতে পারে।

কাজুবাদামের পুষ্টিগুণ
USDA National nutrient Database তথ্যমতে ১ আউন্স (২৮.৩৫ গ্রাম) কাঁচা কাজু বাদামে শক্তি ১৫৭ ক্যালরি, শর্করা, চিনি, আঁশ, আমিষ, চর্বি যথাক্রমে ৮.৫৬, ১.৬৮, ০.৯, ৫.১৭ এবং ১২.৪৩ গ্রাম। ক্যালসিয়াম, আয়রন, ম্যাগনেসিয়াম, পটাসিয়াম, ফসফরাস, সোডিয়াম যথাক্রমে ১০, ১.৮৯, ৮৩, ১৮৭, ১৬৮, ৩ এবং ১.৬৪ মিলিগ্রাম। তাছাড়াও ভিটামিন এ, সি, ই এবং বি সহ কপার, ম্যাঙ্গানিজ, সেলেনিয়াম, এন্টিঅক্সিডেন্ট কাজু বাদামে বিদ্যমান। কাজু বাদামের বেসুমার গুণ। সুস্থ্য সবল থাকার জন্য খাদ্য তালিকায় কাজু বাদাম যোগ করা জরুরী।

কাজু বাদাম রক্ত স্বল্পতা কমায়:কাজু বাদাম খাওয়ার ফলে শরীরের আয়রন ও কপার ঘাটতি দূর হয়। আয়রন ও কপারের কারণে লোহিত রক্ত কনিকা উৎপাদন বেড়ে যায় এবং রক্ত স্বল্পতা রোগ কমে যায়। আয়রণ রক্তে অক্সিজেন চলাচল বাড়ায়, শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিসহ এনজাইমের কার্য ক্ষমতা বৃদ্ধি করে।

মুখের ভিতরের রোগের প্রকোপ কমায়:কাজু বাদামের ফসফরাস দাঁতের বৃদ্ধি ঘটায়। দাঁতকে শক্ত করে এবং সুন্দর রাখতে সহায়তা করে।

ক্যান্সার প্রতিরোধ করে:কাজু বাদামে রয়েছে এন্টিঅক্সিডেন্ট যা ক্যান্সার কোষের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। ক্যান্সার কোষের সংখ্যা বৃদ্ধি বন্ধ করে দেয়। কাজু বাদামের Proanthocyanin এবং কপার টিউমার ও কোলন ক্যান্সার প্রতিরোধে সহায়ক ভূমিকা রাখে।

হাড় শক্ত করেঃকাজু বাদামের ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, কপার, জিংক এবং ম্যাগনেসিয়াম হাড়কে শক্ত ও মজবুত করে। বয়স্ক লোকের  অস্টিওআর্থাইটিসের মতো হাড়ের রোগ প্রতিরোধে কাজু বাদাম বেশ কার্যকর। কপার ও ক্যালসিয়াম অস্টিওপরোসিস রোগ কমায়। কপার এবং ম্যাংগানিজ আমাদের শরীরের স্ট্রাকচারাল উপাদান Collagen এবং Elastin সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করে। শরীর শক্ত পোক্ত করে। ম্যাগনেসিয়াম হাড়ে ক্যালসিয়াম সংযুক্তিতে সহায়তা করে হাড় গঠনে প্রত্যক্ষ ভুমিকা রাখে।

হৃদরোগ এবং খারাপ কোলেস্টোরেল কমায়:কাজু বাদামের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ক্যান্সার প্রতিরোধ ছাড়াও নানাবিধ হৃদরোগ কমায়। ফসফরাস, ভিটামিন-ই এবং বি, ফলিক এসিড হৃদরোগ কমাতে সাহায্য করে। কাজু বাদামে ওলিসিক এসিড নামে একধরনের মনোআনস্যাচুরেটেড ফ্যাটি এসিড আছে যা খারাপ কোলেস্টেরল অর্থাৎ এল ডি এল (LDL) এবং ট্রাইগ্লিসারাইডকে কমিয়ে দেয়। হৃদরোগ, স্ট্রোকসহ হার্ট এটাক রোগ কমায়।

রক্ত চাপ নিয়ন্ত্রণ:কাজু বাদামে কম সোডিয়াম এবং বেশি পরিমাণে ম্যাগনেসিয়াম ও পটাসিয়াম শরীরের রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে নিয়ামক ভূমিকা পালন করে। তাছাড়া কাজু বাদাম ইউরিক অ্যাসিড তৈরি বন্ধ করার ফলে রক্ত চাপ নিয়ন্ত্রণ করে।

মস্তিষ্কের শক্তি বাড়ায়:কাজু বাদামের ম্যাগনেসিয়াম স্নায়ুর ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। মস্তিস্কের শক্তি বাড়ে। মস্তিষ্কের শক্তি বৃদ্ধি পেলে বুদ্ধি, স্মৃতি শক্তি এবং মনোযোগ বাড়ে। কাজু বাদামের উপকারী ফ্যাটি এসিড ব্রেণের শক্তি বাড়ায় এবং রক্ত জমাট বাঁধতে সহায়তা করে।


ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করে:কাজু বাদাম শরীরের শর্করা এবং চর্বি বিপাকে সহায়তা করে। কাজু বাদামের উচ্চ প্রোটিন এবং উপকারী মনোআনস্যাচুরেটেড ফ্যাটি এসিড রক্ত চাপ নিয়ন্ত্রণ করে। কাজু বাদামের ম্যাগনেসিয়াম ইনসুলিনের মাত্রা এবং কার্যক্ষমতা বাড়িয়ে দেয় যাতে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ হয়।

চুলের এবং ত্বকের সৌন্দর্য্য বৃদ্ধি করে:কাজু বাদামের প্রোটিন, কপার, জিংক এবং সেলিনিয়াম চুলের ঔজ্জ্বল্য বাড়ানোর পাশাপাশি চুলের গোড়াকে শক্ত করে। চুল ফেটে যাওয়া, চূল পাকা এবং চুল পড়া অনেকাংশে  কম হয়। চুলকে কালো রাখতে কপারের ভূমিকা বেশি। কাজু বাদামের ভিটামিন-সি, কপার, কোলাজেন, ইলাসটিন, জিংক, আয়রন, ম্যাগনেসিয়াম, ফসফরাস এবং সেলেনিয়াম ত্বকের রং বাড়ায় এবং ত্বক ফাটা রোধ করে। কোলাজেন ত্বকের শক্তি, স্থিতিস্থাপকতা বাড়ায় এবং ত্বকের মৃত কোষ প্রতিস্থাপন করে। কাজু বাদামের এন্টিঅক্সিডেন্ট ত্বকের ভাঁজ এবং বয়স্কের ছাপ দূর করে।

সংক্রামক রোগ প্রতিরোধ:কাজু বাদামের জিংক ও এন্টিঅক্সিডেন্ট ভাইরাসের আক্রমন থেকে শরীরকে রক্ষা করে। কাজু বাদামে প্রচুর ভিটামিন থাকে যা ব্যাকটেরিয়া গঠিত মানব দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে ।

চোখের কার্যকারীতা বাড়ায়ঃকাজু বাদামের Lutein এবং Zeaxanthin চোখের একটি চমৎকার খাবার। এদের কারণে চোখ বেশ সবল থাকে এবং ক্ষতিকর বিকরিত রশ্মি থেকে চোখকে রক্ষা করার ক্ষমতা অর্জন করে।

শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণঃমানব দেহের ওজনের ভারসাম্য রক্ষা করতে সপ্তাহে ৩-৪ দিন দৈনিক ৪-৫টি কাজু বাদাম খাওয়া উত্তম। বেশি পরিমান কাজু বাদাম খেলে শরীরের ওজন বেড়ে যেতে পারে। মাথা ব্যাথাসহ অন্যান্য উপসর্গ দেখা দেয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কাজু বাদাম খারাপ কোলেস্টেরল কমিয়ে শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণ করে।

লেখক:পরিচালক (অবঃ), হর্টিকালচার উইং
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর
E-mail: This email address is being protected from spambots. You need JavaScript enabled to view it.