বাংলাদেশে ফল উৎপাদন ও সম্ভাবনাময় বিদেশী ফল

কৃষিবিদ মোঃ কবির হোসেন:খাদ্য তালিকায় ফলের গুরুত্ব অপরিসীম। একজন প্রাপ্ত বয়স্ক লোকের দৈনিক ২২০ থেকে ২৫০ গ্রাম ফল খাওয়া দরকার। দেহে পুষ্টি উপাদান সরবরাহের অন্যতম উৎস ফল। বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থার হিসাবমতে গত বছর সারা বিশ্বে প্রায় ৮৮৩.৪২ মিলিয়ন (৮৮ কোটি ৩০ লাখ ৪২ হাজার) টন ফল উৎপন্ন হয়। এসময়ে বাংলাদেশে ৭,২৯,২৮০ হেঃ জমিতে  ১২.১৫ মিলিয়ন (১ কোটি ২০ লাখ ১৫ হাজার) টন ফল উৎপাদন হয়। আমাদের দেশে ফলের মধ্যে আমের উৎপাদন শীর্ষে প্রায় ১,৮৯,৮৫০ হেঃ জমিতে উৎপাদন ২৪,৬৮,০০০ টন। কাঁঠাল, লিচু, পেয়ারা, পেঁপে, কলা ও কুলের আবাদ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশ্বে চীন ফল উৎপাদনে শীর্ষে (২৮%) এবং ভারত ২য় অবস্থানে।

সারা বিশ্বে কমবেশী ২০০০ ধরনের ফল আছে। বাংলাদেশে ৭২ ধরনের ফলের আবাদ হয়। গত দুই দশকের তুলনায় বর্তমানে বাংলাদেশে ১১% থেকে ১২% ফলের উৎপাদন বেড়েছে। সবচেয়ে বেশী বেড়েছে আম। নতুন নতুন জাতের পেঁপে, কলা, পেয়ারা, লিচু, কমলা, মাল্টা, আমের আবাদ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশ হেক্টর প্রতি ফল উৎপাদনে বিশ্বে ১ম, কাঁঠালে ২য়, আমে ৭ম, পেয়ারায় ৮ম এবং মোট ফল উৎপাদনে ২৮তম অবস্থান।

দেশী ফল আবাদের পাশাপাশি বেশ কিছু বিদেশী ফল আমাদের দেশে আবাদের বেশ সম্ভাবনা রয়েছে। জলবায়ু এবং মাটি চাষ উপযোগীর কারণে অনেক বিদেশী ফলের আবাদ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হর্টিকালচার উইং, বিএডিসি, বিএআরআই, বিভিন্ন কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, বেসরকারী গবেষণা প্রতিষ্ঠান, ব্যক্তি উদ্যোক্তা, বেসরকারী নার্সারী বিদেশী ফল চাষ সম্প্রসারণে কাজ করছে।

বছরব্যাপী ফল উৎপাদনের মাধ্যমে পুষ্টি উন্নয়ন প্রকল্প বিদেশ থেকে ১৩টি বিদেশী ফল গাছের চারা ও কলম দেশে আমদানী করে সরকারী হর্টিকালচার সেন্টারে মাতৃগাছ সৃজন করেছে। উল্লেখযোগ্য বিদেশী ফল হলো- ড্রাগন ফল, রামবুটান, এভোকাডো, আরবী খেজুর,খাটো জাতের নারিকেল, পারসিমন, আলুবোখারা, লংগন, ম্যাংগোস্টিন, টক আতা, কোকো ও কাজুবাদাম। আঁঠা বিহীন কাঁঠাল, বল সুন্দরী ও বীজ শূন্য কুল, থাই পেয়ারার জাত সম্প্রসারণে প্রকল্পটি কাজ করছে। বর্ণিত ফলের চারা ও কলম থাইল্যান্ড, সৌদী আরব, ভারত প্রভৃতি দেশ থেকে আনা হয়েছে।

ড্রাগন ফলঃ ভিয়েতনামের জাতীয় ফল  এবং বিশ্ব উৎপাদনে শীর্ষে অবস্থান। এ ফলের উৎপত্তি মধ্য আমেরিকা ও মেক্সিকো। রাতে ফুল ফোঁটে সকালে বন্ধ হয়। অনিন্দ্য সুন্দর এ ফুলকে রাতের রাণী বলে। পার্বত্য অঞ্চল, নরসিংদী, ঢাকা, রাজশাহী, বরেন্দ্র অঞ্চল, বৃহত্তর যশোর, চুয়াডাংগা, ঝিনাইদহসহ সারাদেশে এর আবাদ দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশে গত বছর ২৮০ হেক্টর জমিতে ২৯৪০ টন ড্রাগন ফল উৎপন্ন হয়। গোলাপী,লাল,হলুদ ও সাদা রংগের ড্রাগনের জাত আছে। বারি ড্রাগন-১ গোলাপী জাতের কাটিং হটিকালচার সেন্টার ও বিভিন্ন নার্সারীতে পাওয়া যায়।

স্ট্রবেরীঃ এ ফলের উৎপত্তিস্থল  উত্তর আমেরিকা ও চিলি। শীত কালের ফল। বিশ্বে স্ট্রবেরী উৎপাদনে চীন শীর্ষে। দেশের পার্বত্য এলাকা, রাজশাহী, গাজীপুর, ঢাকাসহ সারা দেশে এর চাষ বৃদ্ধি হচ্ছে। কৃষি বিভাগ, অভিজ্ঞ চাষি ও গবেষকদের পরামর্শে চাষ করলে বেশ লাভবান হওয়া সম্ভব। দেশে  গত বছর ৬৪ হেক্টর জমিতে ২৮৬ টন উৎপন্ন হয়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বোটানি বিভাগ চারা উৎপাদন করে চাষি পর্যায়ে সরবরাহ করছে।

মাল্টা ও কমলাঃ হিমালয়ের পাদদেশে আসাম, মায়ানমার এবং চীন মাল্টা এবং কমলার উৎপত্তি বলে অনেকে মনে করেন। চীন এ দুটি ফল উৎপাদনে বিশ্বে শীর্ষ। বাংলাদেশের সিলেট, পার্বত্য চট্রগ্রাম, যশোর, চুয়াডাঙ্গা, ময়মনসিংহ, পিরোজপুর, ঠাকুরগাঁও, টাংগাইলসহ সারা দেশেই দুটি ফলের চাষ হচ্ছে। বারি মাল্টা-১ যা পয়সা মাল্টা নামে অধিক পরিচিত সারা দেশে ব্যাপকভাবে আবাদ সম্প্রসারিত হচ্ছে। বারি কমলা-১, দার্জিলিং, ছাতক জাতসহ নানিয়ারচরের শ্বলেশ্বরী কমলার জাত গুলোর চাষ সারা দেশে সম্প্রসারিত হচ্ছে। হর্টিকালচার সেন্টারে কলম পাওয়া যায়। বাংলাদেশে গত বছর ২৫৫০ হেঃ জমিতে ১৭৮০০ টন মাল্টা, ৪০৮০ হেক্টর জমিতে ৪৬৫২২ টন কমলা উৎপন্ন হয়।

রামবুটানঃ মালয়েশিয়ার জাতীয় ফল। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম রামবুটানের উৎপত্তি। রাংগামাটি, নরসিংদী, গাজীপুর, বরেন্দ্র অঞ্চল এলাকায় চাষ বৃদ্ধি পাচ্ছে। বছরব্যাপী ফল উৎপাদন প্রকল্পের মাধ্যমে থাইল্যান্ড থেকে রামবুটানের কলম সংগ্রহ করে গাজীপুরের মৌচাক, দিনাজপুর, আসাদগেট, রংপুর, বান্দরবান, রাংগামাটি, খাগড়াছড়ি, বরিশাল, যশোর হর্টিকালচার সেন্টারে মাতৃগাছ সৃজন করা হয়েছে। মাতৃগাছে ফল ধরা শুরু হয়েছে। এ ফলটি দেশে দ্রুত সম্প্রসারিত হবে বলে  আশা করা য়ায়। দেশে ১১ হেক্টর জমিতে রামবুটান চাষ হয়েছে।

এভোকাডোঃ উৎপত্তি মধ্য আমেরিকা এবং মেক্সিকো। মেক্সিকোতে সবচেয়ে বেশী এভোকাডো উৎপন্ন হয়। সারা দেশে ১০ হেক্টর জমিতে এ ফল চাষ হয়েছে। পার্বত্য অঞ্চল, চট্রগ্রাম, বগুড়া, রাজশাহী, রাজবাড়ী, চাপাইনবাবগঞ্জ, যশোরে এর আবাদ হচ্ছে। সরকারী হর্টিকালচার সেন্টারে মাতৃগাছ সৃজন করা হয়েছে। আগামীতে এর চাষ দ্রুত সম্প্রসারণ হবে আশা করা যায়।

আরবী খেজুরঃ সৌদী আরবের জাতীয় ফল। পারস্য উপসাগর তীরবর্তী এলাকা ইরাক অঞ্চল এ ফলের উৎপত্তি। খেজুর উৎপাদনে মিশর ১ম, সৌদি আরব ২য় এবং ইরান ৩য়। বাংলাদেশে খেজুরের আবাদ বাড়ছে। ভালুকা, চাটমোহরে ব্যক্তি উদ্দ্যোগে সাফল্যজনকভাবে খেজুরের বাগান হয়েছে। বাংলাদেশে আজওয়া, মরিয়ম,শুক্কারী ও হলুদ জাতের সৌদী খেজুর চাষ উপযোগী। হর্টিকালচার সেন্টারসমুহে মাতৃগাছ রোপণ করা হয়েছে এবং পর্যাপ্ত খেজুরের ফলন হয়েছে। দেশে ১০ হেক্টর জমিতে সৌদী খেজুর চাষ হয়েছে।

খাটোজাতের নারিকেলঃ নারিকেলের উৎপত্তি দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার ফিলিপাইন, মালয়েশিয়া এবং ইন্দোনেশিয়া। বিশ্বে নারিকেল উৎপাদনে ইন্দোনেশিয়া শীর্ষে। গত বছর বাংলাদেশে ৪৭,০০০ হেক্টর জমিতে ৬.৬০ লাখ টন নারিকেল উৎপন্ন হয়। ২০১৬ সালে ভিয়েতনাম থেকে ২ লাখ ১০ হাজার খাটো ওপি জাতের নারিকেল চারা সরকারীভাবে সংগ্রহ করে চাষী পর্যায়ে বিতরণ করা হয়েছে। ওপি জাত-সিয়াম গ্রীন, সিয়াম ব্লো, সিয়াম গার্ডেন এবং সিয়াম ইয়েলো। তৎসময়ে বরিশালের রহমতপুর হর্টিকালচার সেন্টারে ৮০০ চারা রোপণ করে খাটো জাতের নারিকেলের মাতৃবাগান করা হয়। মাতৃগাছে পর্যাপ্ত নারিকেল ধরেছে এবং চারা উৎপাদনের কাজ শুরু হয়েছে। ভারতের কেরালা থেকে হাইব্রীড খাটো জাতের ডিজে-সম্পূর্ণা ৭০০০টি চারা এনে বিতরণ করা হয়েছে।  সঠিক পরিচর্যা করলে ৩ থেকে সাড়ে ৩ বছরের গাছে ফল আসে।

পার্সিমন ও ম্যাংগোস্টিনঃ দুটি ফলই গাব জাতীয় ফল। পার্সিমনকে সৃষ্টিকর্তার খাবার বলা হয় এবং জাপানের জাতীয় ফল। বাংলাদেশের মাটি ও জলবায়ু ফল দুটি চাষ উপযোগী। নাটোরে ব্যক্তি উদ্যোগে পার্সিমনের বাগান হয়েছে এবং ভাল ফলন হয়েছে। সরকারী হর্টিকালচার সেন্টারে পার্সিমন ও ম্যাংগোস্টিনের মাতৃগাছে ফল ধরেছে। চারা কলম তৈরীর কাজ চলমান আছে।

কাজু বাদামঃ বাংলাদেশে কাজু বাদাম চাষের বেশ সম্ভাবনা রয়েছে। বিশেষ করে পাহাড়ের ঢালুতে এর ফলন ভাল হয়। চাষ সম্প্রসারণের জন্য ইতোমধ্যে সরকারি পযায়ে একটি প্রকল্প কাজ শুরু করেছে।

বিদেশী ফল চাষের বিষয়ে সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। কৃষি বিভাগ, গবেষণা প্রতিষ্ঠান, অভিজ্ঞ চাষির পরামর্শে চাষ করলে আশানুরুপ ফলাফল পাওয়া যাবে। সঠিক নিয়মে পরিচযা না করলে ক্ষতির সম্ভাবনা রয়েছে। ভবিয্যতে দেশী ফলের পাশাপাশি বিদেশী ফলের গাছ সারা বছর ফল সরবরাহ দিবে। যা আমাদের পুষ্টি সমস্যা সমাধানে কার্যকর ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা যায়।

লেখক:পরিচালক (অবঃ), হর্টিকালচার উইং
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর
E-mail: This email address is being protected from spambots. You need JavaScript enabled to view it.