কাজুবাদাম চাষ করে অদূর ভবিষ্যতে বছরে প্রায় ৮-৯ হাজার কোটি টাকা আয় করা সম্ভব

কৃষিবিদ মো: কবির হোসেন: কাজুবাদাম গ্রীষ্মমন্ডলীয় চিরহরিৎ উদ্ভিদ। কাজুবাদামরে লাল-হলুদ রঙ্গের আপেল আর বাদাম খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। আপেল আর বাদাম উভয়ই পুষ্টি সমৃদ্ধ। বাংলাদেশে কাজুবাদাম  অপ্রধান ফল। বাংলাদেশের বানিজ্যিক কৃষির সম্ভাবনাময় ফসল কাজুবাদাম। বাংলাদেশের মাটি, জলবায়ু, বৃষ্টিপাত কাজুবাদাম উৎপাদনের জন্য বেশ উপযোগী। সমতল ভূমিসহ দেশের ৩ পার্বত্য জেলাসহ চট্রগ্রাম,ফেনী,কুমিল্লা, ব্রাক্ষনবাড়িয়া,বৃহত্তর সিলেট,টাংগাইল, শেরপুরের পাহাড় ও টিলা এলাকায় এর চাষ উপযোগিতা রয়েছে। তাছাড়া দেশের বরেন্দ্র এলাকায় এর চাষ সম্প্রসারণ সম্ভব।

তিন দশক পূর্বে পার্বত্য এলাকায় কৃষি পুনর্বাসনের আওতায় ভুমি ক্ষয় এবং ভূমি ধ্বস রোধের জন্য পার্বত্য উন্নয়ন বোর্ড ও উদ্যান উন্নয়ন বোর্ডের মাধ্যমে প্রথমে কাজুবাদাম চাষ শুরু হয়। প্রক্রিয়াজাতকরণের অসুবিধা ও যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহন না করার কারণে এর চাষ সম্প্রসারণ হয়নি। আন্তর্জাতিক বাজারে চাহিদা বৃদ্ধির কারণে বিশ্বব্যাপী  কাজুবাদামের চাষ দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। অদূর ভবিষ্যতে সমতল ভূমিসহ সবুজ পাহাড়ের অনাবাদি জমিতে কাজুবাদাম চাষ ও প্রক্রিয়াজাত করে দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানী করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারবে।

অনাবাদী পাহাড়ে কাজুবাদাম চাষঃ বাংলাদেশে মোট প্রায় ১৩ লাখ ৩০ হাজার হেক্টর পাহাড়ি জমি যার ৭০% অর্থাৎ ৯ লাখ ৩০ হাজার হেক্টর জমি তিন পার্বত্য জেলায়। পাহাড়ি জমির প্রায় ৫ লাখ হেক্টর অনাবাদী। পার্বত্য অঞ্চল এবং অন্যান্য পাহাড়ি এলাকার শুধু ২ লাখ হেক্টর অনাবাদী জমিতে কাজুবাদাম চাষ করে অদূর ভবিষ্যতে বছরে প্রায় ৮-৯ হাজার কোটি টাকা আয় করা সম্ভব। অনাবাদী জমি চাষের আওতায় এনে কাজুবাদাম চাষের যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে।

খাদ্য ও পুষ্টি সরবরাহ: কাজুবাদাম পাহাড়ি আদিবাসীদের অন্যতম খাবার। কাজুবাদামের ২টি অংশ। কাজু আপেল আর বাদাম। কাজু আপেলে রয়েছে প্রচুর পানি,খনিজ উপাদান, ভিটামিন-সিসহ অন্যান্য ভিটামিন ও অপরাপর পুষ্টি উপাদান। পাকা রসালো কাজু আপেলের সুমিষ্ট ঘ্রাণ ও স্বাদ পাহাড়ীদের পছন্দনীয় খাবার। কাজু আপেলের জুস একটি দামী জুস। পর্যাপ্ত কাজু চাষ হলে বেসরকারি উদ্যোক্তাগন জুস তৈরিতে আগ্রহী হবেন। বাদামে রয়েছে বেসুমার পুষ্টি।

ক্যালরি, শর্করা, চিনি, আঁশ, আমিষ, চর্বিসহ ক্যালসিয়াম, লোহা, ম্যাগনেসিয়াম, পটাসিয়াম, ফসফরাস, সোডিয়াম, কপার, ম্যাংগানিজ, সেলেনিয়াম, এন্টিঅক্সিডেন্টসহ বিভিন্ন ভিটামিন রয়েছে। শরীরের রক্তস্বল্পতা কমানো, মুখের ভিতরের রোগ দমন, ক্যান্সার প্রতিরোধ, হাড় শক্ত, হৃদরোগ কমানো, খারাপ কোলেস্টেরল কমানো, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রন, ব্রেনের শক্তি বৃদ্ধি, ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রন, চুল ও ত্বকের সৌন্দর্য বৃদ্ধিতে কাজুবাদামের যথেষ্ট ভূমিকা রয়েছে। আমাদের দেশে খাদ্য হিসাবে ফল প্রয়োজনের তুলনায় খুব কম খাওয়া হয়। বাংলাদেশে ফল খাদ্য ঘাটতি পূরণে এবং পুষ্টি সমস্যা সমাধানে কাজুবাদাম অনন্য ভূমিকা রাখতে পারে। বিশেষ করে পাহাড়ি জনপদে উপজাতীয়দের খাদ্য চাহিদা পূরণসহ পুষ্টি সমস্যা সমাধানে কাজুবাদামের চাষ বৃদ্ধি করা খুবই প্রয়োজন।

অনুকুল জলবায়ু ও উপযোগী মাটিঃ কাজুবাদাম চির সবুজ গ্রীষ্মমন্ডলীয় খরা সহনীয় উদ্ভিদ। ২০ হতে ৩০ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রা, বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাত ১০০০ হতে ২০০০ মিলিমিটার, সমুদ্র পৃষ্ঠ হতে গড়ে ৭০০ মিটার উচ্চতায় কাজুবাদাম ভাল জন্মে। গভীর সুনিষ্কাশিত শক্তস্তরবিহীন বেলে দোঁয়াশ মাটি উপযুক্ত। লাল মাটির পাহাড়ি ঢালে বাড়-বাড়তি বেশি হয়। মাটির উপযুক্ত অম্লমান ৫ হতে ৬.৫। বাংলাদেশের সুনিষ্কাশিত বেলে দোয়াঁশ মাটিতে বিশেষ করে পাহাড়ি অঞ্চলের লালমাটিতে কাজুবাদাম চাষের বেশ সম্ভাবনা রয়েছে।

চাষ পদ্ধতি ও উৎপাদন খরচঃ কাজুবাদামের চাষ খুব সহজ। পাহাড়ে, পাহাড়ের ঢালে এবং সমতলভূমিতে হেক্টরে ১৫০ হতে ১৮০টি চারা রোপণ যথেষ্ট। চারা রোপণের ২ হতে ৩ বছরের মধ্যে ফল ধরা শুরু হয়। ১০ হতে ১২ বছরের ১টি গাছ থেকে বছরে গড়ে ১০ হতে ১২ কেজি কাঁচা বাদাম পাওয়া যায়। তবে হাইব্রিড জাতের গাছে ফলন অনেক বেশি হয়। বর্তমানে ৬০ হতে ৭০ টাকা কেজি দরে কাঁচা বাদাম বিক্রি হয়। সে হিসেবে ১ হেক্টর জমি থেকে বছরে প্রায় দেড় লাখ টাকা অর্থাৎ বিঘায় ২০ হাজার টাকা আয় হয়। প্রথম বছরের চারার দাম, সার, বালাইনাশক, অন্যান্য পরিচর্যা, শ্রমিক খরচ বাবৎ গড় হিসাবে বছরে বিঘা প্রতি ৫-৬ হাজার টাকা উৎপাদন খরচ হয়। সবচেয়ে সুবিধা হলো কাঁচা বাদাম রোদে শুকিয়ে বস্তাবন্দী করে ৭ হতে ৮ মাস ঘরে রেখে পরবর্তীতে সুযোগমত বিক্রি করা যায়।

জাতীয় অর্থনীতিতে কাজুবাদামঃ বাংলাদেশে পরিকল্পিভাবে কাজু বাদাম চাষ ও প্রক্রিয়াজাত করে দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানীর মাধ্যমে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন সম্ভব। শুধুমাত্র পাহাড়ি অনাবাদি ২ লাখ হেক্টর জমিতে কাজুবাদাম চাষ করে বছরে ৮-৯ হাজার কোটি টাকা আয় করা সম্ভব। উল্লেখ্য দেশে যে কয়টি কাজু কারখানা আছে এদের কাচাঁ বাদামের চাহিদা দেশে উৎপাদিত বাদাম দিয়ে মিটানো সম্ভব নয়। যার সিংহভাগ দেশের বাহির থেকে আমদানী করা হয়। ২০১৯ সালে ৭০ কোটি টাকা মূল্যের ৬৫০ টন কাাঁচা বাদাম দেশের বাহির থেকে কারখানা কর্তৃপক্ষ আমদানি করে কারখানায় প্রক্রিয়াজাত বাদাম তৈরি করে।

উদ্যোক্তা ও কর্মসংস্থানঃ দেশের জনসংখার একটি বিরাট অংশ বেকার। অনেক শিক্ষিত তরুন-তরুনী চাকুরি না পেয়ে কর্মহীন। পাহাড়ি এলাকায বেকারত্ব প্রকট ও দারিদ্র সীমার নীচে অধিকাংশের বসবাস। কাজুবাদাম চাষ সম্প্রসারণ এবং কারখানা প্রতিষ্ঠা হলে নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টিসহ কারখানা শ্রমিক নিয়োগের ফলে বেকার সমস্যা কিছুটা লাঘব হবে। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে নতুন নতুন কাজুবাদাম কারখানা সৃষ্টির যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে।

পাহাড়ি এলাকায় ভুমি সংরক্ষণ ও জীব বৈচিত্র রক্ষাঃ পাহাড়ি এলাকায় দিন দিন বন উজারের কারণে গাছ শূণ্য হয়ে পড়ছে। গাছ না থাকার কারণে ভুমি ক্ষয় এবং ভুমি ধবস বর্ষাকালে হয়ে থাকে। পর্যাপ্ত গাছ না থাকায় পাহাড়ি এলাকায় প্রতিবেশের বেশ ক্ষতি হচ্ছে। বন্য পশু-পাখির খাবার সংকট ও আবাসের অপর্যাপ্ততার কারণে এদের সংখ্যা দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। কাজু আপেল বানর জাতীয় প্রাণিদের প্রিয় খাবার। তাছাড়া অনেক বন্য পাখি কাজু আপেল খেয়ে বাঁচে এবং কাজুবাদাম গাছে বাসা বানিয়ে বংশ বিস্তার করে। কাজুবাদাম চাষ করে বনের জীব বৈচিত্র ফিরিয়ে আনা সম্ভব।

লেখক : পরিচালক (অব.), হর্টিকালচার উইং
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর
E-mail: This email address is being protected from spambots. You need JavaScript enabled to view it.