পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য ড. শামসুল আলমের দিক নির্দেশনা ও নগরায়ন প্রসঙ্গ

মোশাররফ হোসেন মুসা:স্থানীয় সরকার ও শাসন বিষয়ে কাজ করতে গিয়ে বেশ কয়েকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে গমন করেছি, সেখানে গেস্ট স্পীকার হিসেবে বক্তব্যও দিয়েছি। সে কারণে বহু শিক্ষকের সঙ্গে মতবিনিময় হয়েছে। আমি মনে করি, দুই শ্রেণীর শিক্ষকের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ ঘটেছে; তা হলো- এক শ্রেণীর শিক্ষকের মতে, বই-পুস্তকের বাইরে কিছু পড়ানো তাদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না। অর্থাৎ তাঁরা নিজেদেরকে নিছক চাকরিজীবি ভাবতে ভালবাসেন। আরেক শ্রেণীর শিক্ষকের বক্তব্য- ‘আমাদেরও দায়িত্ব রয়েছেন নতুন কিছুু বলার ও নতুন কিছু সৃষ্টি করার। বই-পুস্তকে যদি ভুল থাকে সেটা শোধরানোর দায়িত্বও আমাদের।’ অর্থাৎ এই শ্রেণীর শিক্ষকেরা নিজেদেরকে কেবল চাকুরির মধ্যে আবদ্ধ রাখতে রাজি নন। প্রফেসর ড. শামসুল আলম নিঃসন্দেহে এই শ্রেণীর শিক্ষকের মধ্যে পড়েন।

বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর লেখার সূত্র ধরে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ ও পরিচয় ঘটে। লেখার বিষয়বস্তু নিয়ে তাঁর সঙ্গে প্রায়ই মতবিনিময় হয়। তাঁর সঙ্গে আলোচ্য বিষয় হলো পরিবেশ বান্ধব পরিকল্পিত নগর ও নগরায়ন, কৃষি জমি রক্ষা, ভবিষ্যতের নগরীয় কৃষি, পরিবেশ-প্রকৃতি রক্ষা করেই উন্নয়ন ইত্যাদি। আমি একজন মাঠ পর্যায়ের নন-একাডেমিক গবেষক ও স্থানীয় সরকারের ক্ষুদ্র কর্মচারী। তারপরেও তিনি ধৈর্য্য সহকারে আমার বক্তব্য শুনেছেন এবং উপযুক্ত পরামর্শ দিয়েছেন। তাঁর আচরণে সরকারি বড় কর্মকর্তা সুলভ কোনো অহংবোধ লক্ষ্য করেনি। একটি দেশের কাঙ্খিত উন্নয়নের লক্ষ্য পুরণের পিছনে থাকে উপযুক্ত ‘পরিকল্পনা’। তিনি বাংলাদেশের সেই পরিকল্পনা কমিশনের সঙ্গে জড়িত। তিনি পরিকল্পনার প্রণয়নের কাজটি খুবই দক্ষতার সঙ্গে সম্পন্ন করে যাচ্ছেন।

যতদুর জানা যায়, ড. শামসুল আলম (মোহন) ১৯৫১ সালে ১ জানুয়ারি তারিখে চাঁদপুর জেলার মতলব (উত্তর) উপজেলার ইসলামপুর গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৬৫ সনে তৎকালীন (ময়মনসিংহ) পূর্ব-পাকিস্তান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে কৃষি অর্থনীতি স্নাতক (অনার্স) কোর্সে ভর্তি হন এবং ১৯৭৩ সনে কৃষি অর্থনীতিতে এম.এস.সি ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৭৪ থেকে ২০১৫ সন পর্যন্ত শিক্ষকতা ও গবেষণায় নিয়োজিত ছিলেন। পঁয়ত্রিশ বছরের অধ্যাপনার অভিজ্ঞতা শেষে ১ জুলাই’ ২০০৯ তারিখে পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য হিসেবে যোগদান করেন এবং এখনও কর্মরত রয়েছেন। ২০১৮ সনে তাঁর কর্মজীবন ৪৩ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশন সৃষ্টির পর সদস্য হিসেবে ২০০৯ সনে যোগদান করেন। তিনি ২০১৪ সালে মহামান্য রাষ্ট্রপতির ১০% কোটায় ক্যাডার সার্ভিসের বাইরে প্রথম সিনিয়র সচিব পদ মর্যাদা অর্জন করেন।

এ প্রতিষ্ঠানে তাঁর প্রথম দায়িত্বের মধ্যে ছিল দ্বিতীয় দারিদ্র বিমোচন কৌশল পত্র (২০০৯-১১) ও সরকারের নির্বাচনী ইশতেহারের আলোকে সংশোধন পুনর্বিন্যাস করা। সেই সংশোধিত দলিল ‘দিন বদলের পদক্ষেপ’ নামে জাতীয় অর্থনৈতিক কাউন্সিল কর্তৃক অনুমোদিত হয় এবং ২০১০ থেকে ২০১১ সন পর্যন্ত তা বাস্তবায়িত হয়। তাঁর নেতৃত্বে ‘রূপকল্প-২০২১’- এর আলোকে প্রণীত বাংলাদেশের প্রথম প্রেক্ষিত পরিকল্পনা (২০১০-২০২১), ৬ষ্ঠ পঞ্চ-বার্ষিক পরিকল্পনা (২০১১-২০১৫) ও সপ্তম পঞ্চ-বার্ষিক পরিকল্পনা (২০১৬-২০২১) প্রণীত হয়। ইতোমধ্যে অষ্টম পঞ্চ-বার্ষিক পরিকল্পনা (২০২১-২০২৬) গৃহীত হয়েছে। তাছাড়া তাঁর নেতৃত্বে গত ২০১৮ সনে বাংলাদেশ শতবর্ষী ব-দ্বীপ পরিকল্পনা প্রণীত হয়েছে এবং সম্প্রতি “রূপকল্প ২০৪১ বাস্তবে রূপায়নঃ বাংলাদেশের প্রেক্ষিত পরিকল্পনা ২০২১-২০৪১” প্রণীত হয়েছে। ‘বাংলাদেশ টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট লক্ষ্যমাত্রা’ অর্জন ১৬টি গ্রন্থ’, বাংলাদেশ টেকসহ উন্নয়ন কৌশল পত্র (২০১১-২০২১) এবং বাংলাদেশের সামাজিক নিরাপত্তা কৌশল পত্র (২০১৫-২০২৫) প্রণীত হয়েছে। তাঁর কার্যকালীন সময়ে তাঁর তত্ত্বাবধানেও সম্পাদনায় এ পর্যন্ত ৮২টি মূল্যায়ন প্রতিবেদন, অধ্যয়ন ও গবেষণা গ্রন্থ’ প্রকাশিত হয়েছে। অর্থনীতি বিষয়ক তাঁর গবেষণা গ্রন্থ’ ১২টি এবং দেশ-বিদেশে প্রকাশিত সম্পাদিত গ্রন্থ’ সংখ্যা ২০টি। তাছাড়া দেশ-বিদেশের জার্নালে ইতোমধ্যে ৫০টি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। বাংলাদেশ কৃষি অর্থনীতি সমিতি ১৬তম দ্বি-বার্ষিক সম্মেলন’২০১৮ সনে তাঁকে স্বর্ণপদকে ভূষিত করে। বাংলাদেশ সরকার অনুমোদিত শিক্ষা পর্যবেক্ষণ সোসাইটি তাকে ‘বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম’ স্মৃতি পদক’২০১৮ তে ভূষিত করেছেন। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এ্যালামনাই এসোসিয়েশন ২০১৮ সনে শিক্ষকতা ও গবেষণায় বিশেষ অবদান রাখার জন্য ‘সম্মাননা এওয়ার্ড’ প্রদান করেন। শিক্ষকতায় সাফল্য ও বিশেষ অবদানের জন্য তাঁকে বিশ্ব শিক্ষক দিবস উদ্যাপন কমিটি (২০১৮)‘বিশেষ সম্মাননা স্মারক’ প্রদান করেন (সূত্রঃ উইকিপিডিয়া)।

এখানে উল্লেখ্য যে, অত্র নিবন্ধকার স্থানীয় সরকারে জনগণের ক্ষমতায়ন বিষয়ে অনুসন্ধিৎসু হওয়ায় এবং গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকার বিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান (সিডিএলজি)- এর সঙ্গে জড়িত থাকায় স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করা, নগরায়ন, নগরীয় কৃষি ইত্যাদি বিষয়ে গবেষণা করে থাকেন। আমরা দীর্ঘদিন থেকে বলে আসছি ২০৫০ সনের পূর্বে কিংবা পরে সমগ্র জনগোষ্ঠী নগরীয় সুযোগ-সুবিধা নিয়ে বসবাস করবে। একই কারণে প্রায় ৭৫ ভাগ জনগোষ্ঠী নগরীয় কৃষির সঙ্গে সম্পর্কিত হয়ে পড়বে। সেলক্ষ্যে পরিবেশবান্ধব পরিকল্পিত নগর ও নগরায়নের স্বার্থে দুই প্রকারের সরকার ব্যবস্থা (কেন্দ্রীয় সরকার ব্যবস্থা ও স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা) বাস্তবায়ন সহ স্থানীয় সরকারের স্তরবিন্যাসকরণ ও প্রকারভেদকরণ, কাজ পৃথকীকরণ, কাজ নির্দিষ্টকরণ ইত্যাদি কাজগুলো সুসম্পন্ন করতে হবে। ড. শামসুল আলমের সঙ্গে এ বিষয়ে বহু মত বিনিময় হয়েছে। তিনি ধৈর্য্য সহকারে আমার কথা শুনছেন এবং নিজের মতামত ব্যক্ত করেছেন।

এখানে উল্লেখ্য, মোঘল আমল, ব্রিটিশ আমলসহ এই সরকারের পূর্ববর্তী সকল সরকারই গ্রামকে কেন্দ্র করে সকল কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। বর্তমান সরকার নগরায়নের বাস্তবতাকে স্বীকার করে “আমার গ্রাম আমার শহর” প্রকল্প হাতে নিয়েছে। আশার কথা “রূপকল্প ২০৪১ বাস্তবে রূপায়ন ঃ বাংলাদেশের প্রেক্ষিত পরিকল্পনা ২০২১-২০৪১” 2041Ó (Making vision 2041 a reality perspective plan of Bangladesh 2021-2041) নামক প্রস্তাবনা পত্রে তিনি নগর সরকারের আবশ্যকতা তুলে ধরেছেন। প্রস্তাবনায় উল্লেখ আছে, অব্যাহত নগরায়ন হলো বর্তমানের বাস্তবতা। সেজন্য দায়িত্ব পূর্ণ নগর সরকারের স্বার্থে আর্থিক সঙ্গতি, তার স্বায়ত্বশাসন, কর আহরণ পদ্ধতি, বাজেট প্রণয়ণ পদ্ধতি তার পরিচালনা পর্ষদ, জাতীয় কর্মসূচির সঙ্গে নগর কর্মসূচির সমন্বয় ইত্যাদি বিষয় স্পষ্ট করতে হবে। তাছাড়া “বাংলাদেশ ব-দ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০: একুশ শতকের বাংলাদেশ” শীর্ষক প্রস্তাবনা পত্রে জলবায়ু পরিবর্তন ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ জনিত ঝুঁকির মধ্যে কীভাবে কাঙ্খিত লক্ষ্য অর্জন করা যায়- সেসব বিষয়ে সুন্দর প্রস্তাব করেছেন।

বলা হয়েছে-পানি, জলবায়ু, পরিবেশ ও ভূমির টেকসই ব্যবস্থার দীর্ঘমেয়াদি চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলা করে ২০৩০ সালের মধ্যে উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশের মর্যাদা অর্জন এবং চরম দারিদ্র্য দূরীকরণ ২০৪১ সালের মধ্যে একটি সমৃদ্ধ দেশের মর্যাদা অর্জন করবে। ‘বাংলাদেশ ব-দ্বীপ পরিকল্পনা -২১০০' প্রাথমিকভাবে ২০৫০ সাল পর্যন্ত মধ্য মেয়াদি ডেল্টা এজেন্ডা ঘিরে প্রণীত হলেও তাতে ২০৫০ পরবর্তী দীর্ঘমেয়াদি এজেন্ডার বিষয়েও আলোকপাত করা হয়েছে। প্রস্তাবনায় অব্যাহত নগরায়নকে স্বীকার করে হাওড়-বিল, নদ-নদী, খাল-বিল, কৃষিজমি রক্ষার বিষয়ে প্রস্তাব করা হয়েছে। বলে রাখা ভাল, তিনিই একমাত্র ব্যক্তি যিনি প্রশাসন ক্যাডারের বাইরে থেকে এসে দীর্ঘদিন পরিকল্পনা কমিশনে চাকরি করছেন এবং যথাযথ পেশাদারিত্বের সহিত দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। তাঁর গবেষণা ও প্রস্তাবনার সঙ্গে কিছুটা দ্বিমত করে বলা যায়, বর্তমান বাংলাদেশ পুরোপুরি গ্রামও নয়, নগরও নয়। বলা যায়, গ্রামীণ-নগরীয় অবস্থা বিরাজমান। তিনি পানি অপচয় রোধে ছাদ কৃষিকে নিরুৎসাহিত করেছেন। ছাদকৃষি হলো নগরীয় কৃষির অংশ মাত্র। অর্থাৎ নগরীয় ইউনিটের মধ্যে উৎপাদিত সকল কৃষিই নগরীয় কৃষি। বর্তমানের গ্রামীণ-নগরীয় দেশটি নগরীয় দেশে রূপান্তরিত হওয়ার পথে রয়েছে। তথা বর্তমান বাংলাদেশ অন্তর্বর্তীকালীন সময় অতিক্রম করছে। ২০৪১ সালের পরে নগরীয় দেশের কথা বলা হলেও বর্তমানের মধ্যবর্তী সময়ের গ্রামীণ-নগরীয় স্থানীয় সরকার, তার স্তরবিন্যাসকরণ, তার কাজের পরিধি, নামকরণ কী হবে ইত্যাদি বিষয়ে প্রস্তাবনায় নির্দিষ্ট করে কিছু বলা হয় নি। তাছাড়া পুরো দেশটি নগর হয়ে যাওয়ার পর নগর সরকারগুলোর নিয়ন্ত্রণকারী স্তর জেলা না বিভাগ হবে, তা স্পষ্ট করা হয়নি। তারপরেও তিনি নানান সীমাবদ্ধতাকে উপেক্ষা করে বর্তমান ও ভবিষ্যতের বাংলাদেশ নিয়ে গবেষণা করছেন, এটা মোটেই অবহেলার বিষয় নয়। তিনি দেশপ্রেম, কর্তব্যবোধ ও দায়িত্ব বোধে তাড়িত হয়ে কাজগুলোতে নিবিষ্ট থেকেছেন। তাঁর বর্ণবহুল জীবন ও যথাযথ গবেষণায় নিয়োজিত থাকার জন্য অসংখ্য অভিবাদন জানাই এবং তাঁর সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু কামনা করি।

লেখক: গণতন্ত্রায়ন গণতান্ত্রিক ও স্থানীয় সরকার বিষয়ক গবেষক, ঈশ্বরদী, পাবনা।