কৃষি শিক্ষা ও গবেষণার প্রাতিষ্ঠানিকীকরণে বঙ্গবন্ধু

ড. রাখী চক্রবর্ত্তী:সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন কৃষি ও কৃষকবান্ধব। তিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশের। তাঁর স্বপ্নের সোনার বাংলায় তিনি দেখতে চেয়েছিলেন দেশের কৃষি ও কৃষকের সর্বাঙ্গীন উন্নয়ন এবং স্বনির্ভরতা। বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের জনগনের ক্ষুধা ও দারিদ্র মুক্তির লক্ষ্যে কৃষি উন্নয়নে নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন।

কৃষকদের মাঝে কৃষি খাতে প্রতিযোগিতার মনোভাব সৃষ্টির লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু সরকার ১৯৭৪ সাল থেকে কৃষি উন্নয়নে জাতীয় পর্যায়ে সর্বোচ্চ সাফল্যের স্বীকৃতিস্বরূপ জাতীয় পুরস্কার প্রদান চালু করেন। বঙ্গবন্ধুর সময় দেশের প্রথম কৃষি ঋণ ব্যবস্থার প্রচলন করা হয়। কৃষকরা যাতে সহজভাবে ঋণ পেতে পারে এ লক্ষ্যে ১৯৭৩ সালে কৃষি ব্যাংক স্থাপন করা হয়। তিনি কয়েক লক্ষ কৃষকের কৃষি ঋণের সার্টিফিকেট মামলা প্রত্যাহার করেছিলেন এবং ভূমিহীন কৃষকদের মাঝে খাস জমি বিতরণ এবং সহজশর্তে কৃষি ঋণের ব্যবস্থা করেছিলেন বঙ্গবন্ধু কৃষিখাতের মাঠকর্মী ও সরকারি কর্মকর্তাদের মর্যাদা বৃদ্ধি করেন। খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে বঙ্গবন্ধু উন্নত এবং স্বল্পমেয়াদী চাষাবাদ পদ্ধতি, মানসম্মত বীজ সরবরাহ, সেচ এবং অন্য কৃষি উপকরণ সরবরাহের ক্ষেত্রে নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। তিনি কৃষিভিত্তিক প্রতিষ্ঠান স্থাপন, সংস্কার, উন্নয়ন এবং ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল, বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন, উদ্যান উন্নয়ন বোর্ড, তুলা উন্নয়ন বোর্ড, বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সি, ইক্ষু গবেষণা প্রতিষ্ঠান, মৎস্য উন্নয়ন কর্পোরেশন সহ অনেক নতুন প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি করেন।

১৯৭৩ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ থেকে, কৃষক ও কৃষিবিদদের জন্য তাঁর মমত্ববোধ ও আন্তরিকতা প্রমান পাওয়া যায়। ১৯৭৩ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে একটি চিরস্মরণীয় দিন। বঙ্গবন্ধু কৃষি ও কৃষকের টানে ছুটে এসেছিলেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্রহ্মপুত্রের তীরে সবুজ শ্যামল অঙ্গনে, তাঁর পদস্পর্শে মুখরিত হয়েছিল বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সবুজ শ্যামল আঙ্গিনা। তাঁর প্রদত্ত ভাষণটি একটি ঐতিহাসিক দলিল হিসাবে আজও সাক্ষ্য দেয়। বঙ্গবন্ধু ছাত্র শিক্ষকদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, “সবুজ বিপ্লবের কথা আমরা বলছি। সোনার বাংলার নাম আজকের সোনার বাংলা নয়-বহু দিনের সোনার বাংলা। বাংলার মাটির মত মাটি দুনিয়ায় খুঁজে পাওয়া যায় না- বাংলার সম্পদের মত সম্পদ দুনিয়ায় পাওয়া যায় না”।

তিনি বলেছিলেন, "যেভাবে মানুষ বাড়ছে যদি সেভাবে আমাদের বংশ বৃদ্ধি হতে থাকে ২০ বছরের মধ্যে বাংলার মানুষ, বাংলার মানুষের মাংস খাবে। সে কারণেই আমাদের কৃষির দিকে নজর দিতে হবে। কৃষি বিপ্লব বললেই কৃষি বিপ্লব করা যায় না, সে দিকে আমাদের নজর দেওয়ার প্রয়োজন”। কৃষিবিদদের উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, “আপনাদের কোট-প্যান্ট খুলে একটু গ্রামে নামতে হবে। কেমন করে হাল চাষ করতে হয়, ধানের কোন সময় নিড়ানি দিতে হয়, কোন সময় আগাছা ফেলতে হয়-এগুলো বই পড়লে হবে না। গ্রামে যেয়ে চাষী ভাইদের প্রাকটিক্যাল কাজ করে শিখতে হবে। তাহলে আপনারা অনেক শিখতে পারবেন”। তিনি বলেছিলেন, “আপনারা যারা কৃষি শিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছেন আপনাদের গ্রামে গিয়ে কৃষকদের সাথে মিশে যেতে হবে, মনোযোগ দিতে হবে তাদের চাহিদা আর কর্মের উপর, তবেই তারা সাহসী হবে, আগ্রহী হবে, উন্নতি করবে। ফলবে সোনার ফসল ক্ষেত ভরে। আপনারা এখন শহরমুখো হওয়ার কথা ভুলে যান। গ্রাম উন্নত হলে দেশ উন্নত হবে, তখন আপনারা আপনা আপনি উন্নত হয়ে যাবেন। গ্রামভিত্তিক বাংলার উন্নতি মানে দেশের উন্নতি, আর আপনাদের উন্নতি তখন সময়ের ব্যাপার। শহরের ভদ্রলোকদের দিকে তাকিয়ে আপনাদের চিন্তা বা আফসোস করার কোন কারন নেই। কেননা গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নয়নের দিকে আমাদের সবার ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। কৃষক বাঁচাতে হবে, উৎপাদন বাড়াতে হবে, তা না হলে বাংলাদেশ বাঁচতে পারবে না তিনি আরও বলেছিলেন, “খাদ্য শুধু চাউল-আটা নয়, মাছ-মাংস-ডিম-দুধ-তরকারীও আছে। কৃষিতে এ্যানিমেল হাজবেন্ড্রি, পোল্ট্রি যাই বলেন, সবদিকে নজর দিতে হবে। প্ল্যানওয়েতে চলতে হবে। সুতরাং কৃষির উন্নতি করতে হলে এসব খাদ্যশস্যের উৎপাদন উন্নতি করতে হবে”

বঙ্গবন্ধু উপলব্ধি করেছিলেন গতানুগতিক কৃষিব্যবস্থা দ্বারা দ্রুত ক্রমবর্ধমান বাঙালি জাতির খাদ্যের যোগান নিশ্চিত করা সম্ভব নয় তাই খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের জন্য কৃষিশিল্পের ব্যাপক আধুনিকীকরণ প্রয়োজন বলে তিনি মনে করতেন। সেই লক্ষ্যেই অধিকতর মেধাবী শিক্ষার্থীদের কৃষি শিক্ষায় আকৃষ্ট করার জন্য কৃষিবিদদের প্রথম শ্রেণির মর্যাদা দিয়েছিলেন। তাঁর ঐতিহাসিক ঘোষণার পথ ধরে আজ কৃষিবিদরা সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে প্রথম শ্রেণির গেজেটেড পদমর্যাদায় অধিষ্ঠিত। কৃষি শিক্ষা ও কৃষিবিদদের যথাযথ মূল্যায়ন এবং প্রথম শ্রেণির পদমর্যাদা প্রদানের ঐতিহাসিক ঘোষণা আজও “বঙ্গবন্ধু অবদান- কৃষিবিদ ক্লাস ওয়ান” সোচ্চার কন্ঠে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। বঙ্গবন্ধুর দেওয়া ঐতিহাসিক এই সম্মান আজও কৃষিবিদদের মায়ার বন্ধনে আবদ্ধ করে রেখেছে। কৃষিবিদ সমাজ ঐতিহাসিক এই দিনের অপরিসীম গুরুত্ব ও মর্যাদাকে স্মরণীয় করে রাখতে প্রতি বছর ১৩ ফেব্রুয়ারি জাকজমকপূর্ণভাবে “কৃষিবিদ দিবস" হিসাবে পালন করে আসছেন। কালের পরিক্রমায় কৃষি গ্র্যাজুয়েটরা তাদের কৃতজ্ঞতা স্বরূপ বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনা মোতাবেক দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।

বঙ্গবন্ধুর সেই কৃষি উন্নয়নের ধারা অব্যহত রেখেছেন তাঁর সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা। তাঁর সফল সরকারের শাসনামলে আজ সার্বিক কৃষিতে এসেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। কৃষিতে এখন বহুমুখীকরণ ও বাণিজ্যিকীকরণ ঘটেছে। বর্তমান সরকার খ্যাতি পেয়েছে “কৃষি বান্ধব” সরকার হিসাবে এবং বঙ্গবন্ধুর কৃষি উন্নয়নের ধারা অব্যহত থাকার কারনে বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশ এখন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতার স্বীকৃতি পেয়েছে। বিশ্বে বাংলাদেশ এখন ধান উৎপাদনে ৩য়, শাকসবজি উৎপদানে ৩য়, আলু এবং আম উৎপাদনে ৭ম, পেয়ারা উৎপাদনে ৮ম, অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ে মাছ উৎপাদনে ৩য় এবং ইলিশ মাছ উৎপদানে প্রথম স্থান অর্জন করেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বের কারণে বৈশ্বিক মহামারি কোভিড-১৯ এর মধ্যেও বাংলাদেশে খাদ্যাভাব পরিলক্ষিত হয়নি। জাতিসংঘের খাদ্য কৃষি সংস্থার (১৯৯৬) মতে, খাদ্য নিরাপত্তা হচ্ছে- সব মানুষের কর্মক্ষম ও সুস্থ জীবনযাপনের জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্য চাহিদার বিপরীতে পছন্দমতো পর্যাপ্ত নিরাপদ এবং পুষ্টিকর খাদ্য প্রাপ্তির বাস্তব ও আর্থিক ক্ষমতা থাকা। খাদ্য নিরাপত্তা অর্জিত হয়েছে কি না বুঝার উপায় জাতীয় পর্যায়ে পর্যাপ্ত খাদ্য সরবরাহ থাকবে, সময় ও অঞ্চলভেদে সরবরাহ স্থিতিশীল থাকবে, সবাই খাদ্য ক্রয় বা সংগ্রহ করতে পারবে, পুষ্টিকর ও নিরাপদ স্বাস্থ্যকর খাদ্য সহজলভ্য থাকবে। অর্থাৎ খাদ্য নিরাপত্তার মূল বিষয় হলঃ ১. খাদ্যের সহজ প্রাপ্যতা, ২. খাদ্যের লভ্যতা এবং ৩: স্বাস্থ্যকর পুষ্টিকর খাদ্য।

বাংলাদেশে প্রায় ১৭ কোটি মানুষের জন্য খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারলেও নিরাপদ খাদ্য সরবরাহ ও পুষ্টি নিরাপত্তা এখনও একটা বড় চ্যালেঞ্জ। নিরাপদ ও পুষ্টি সমৃদ্ধ খাবার নিশ্চিতকরণ এখন সময়ের দাবি। খাদ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টি সমৃদ্ধ খাবার নিশ্চিতকরণের জন্য বর্তমান সরকার অনেকগুলো পরিকল্পনা ও পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল- যেসব কৃষকের নিজ জমি নেই, তাদের জন্য জামানতবিহীন কৃষি ঋণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত ১৬,৬৬,৬৫৯ জন কৃষককে প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হয়েছে। কৃষি কাজে ব্যবহৃত বিদ্যুতের উপর ভর্তুকি, স্বল্পমূল্যে বিদ্যুত বিতরণের জন্য কৃষকদের মধ্যে স্মার্টকার্ড সরবরাহ, কৃষিপণ্য যেমন, বীজ, কীটনাশক ইত্যাদি সুশৃঙ্খলভাবে বিতরণের স্বার্থে ২ কোটি ৮ লাখ ১৩ হাজার ৪৭৭ কৃষিপণ্য সহযোগী কার্ড কৃষকদের মধ্যে বিতরণ, সারের উপর ভর্তুকী, ২০০৯-১০ সাল থেকে কৃষি ঋণের অর্থ বিতরণের স্বচ্ছতা আনয়ন ও সহজতর করতে ১০ টাকার বিনিময়ে কৃষকদের ব্যাংক একাউন্ট খোলার ব্যবস্থা করা সহ সরকার কৃষিবান্ধব বহুমুখী পরিকল্পনা গ্রহণ করে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে। কৃষি খাতে বায়োটেকনোলজি, কৃষি যান্ত্রিকীকরণ, প্রতি ইউনিয়নে সবজি পুষ্টি বাগান ইত্যাদি কর্মসূচী বাস্তবায়ন করেছে। শুধু সরকারী উদ্যোগ নয়, সরকারের পাশাপাশি খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আমাদের সকলকে এগিয়ে আসতে হবে। সকলের প্রচেষ্টায় এসব পরিকল্পনা ও পদক্ষেপগুলি বাস্তাবায়ন হলে বাংলাদেশের মানুষের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা শতভাগ নিশ্চিত হবে।

বাংলাদেশে রয়েছে উর্বর মাটি, প্রকৃতি প্রদত্ত অফুরন্ত সম্পদ, আর পরিশ্রমী জনগণ। এগুলোর সুষ্ঠু সমন্বয়ের মাধ্যমে আমরা গড়তে পারবো বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা, সুখে থাকবে বাংলার মানুষ, সুখে থাকবে বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু একটি নতুন মানচিত্র চেয়েছিলেন, নতুন ভূ-খন্ড চেয়েছিলেন, নতুন জাতিসত্ত্বা চেয়েছিলেন, চেয়েছিলেন একটি স্বনির্ভর-সুখী মানুষের সোনার দেশ। বঙ্গবন্ধুর সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের পুরো দায়িত্ব এখন আমাদের সবার। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়তে দরকার আমাদের সবার সম্মিলিত আন্তরিক এবং কার্যকরী পদক্ষেপ। বঙ্গবন্ধুর কথাগুলোকে তিল তিল করে কাজে লাগাতে হবে, কার্যকরভাবে বাস্তবায়িত করতে হবে বঙ্গবন্ধুর লালিত স্বপ্ন। তবে আমরা গর্বের সাথে বলতে পারবো বঙ্গবন্ধুর কথা রেখেছি। কৃষক, শ্রমিক, কৃষিবিদ, কৃষিবিজ্ঞানী, কৃষি বিশেষজ্ঞ, কৃষিকর্মী, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাই একত্রে কাজ করলে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়ন হবে এবং কৃষি উন্নয়নের মাধ্যমে পুষ্টিসমৃদ্ধ খাদ্য উৎপাদন করে বাংলাদেশের সব মানুষের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু, মুজিববর্ষ সার্থক হোক।

লেখক: সহযোগী প্রফেসর, ইন্টারডিসিপ্লিনারি ইনস্টিটিউট ফর ফুড সিকিউরিটি, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়।