দিনাজপুরে ব্যাপক লিচু ফলনের কারণ কী?

আয়শা সিদ্দিকা আখি:বাংলাদেশের সর্ব উত্তরের জেলা হিসেবে সুপরিচিত জেলা দিনাজপুর। রংপুর বিভাগের ৮ টি জেলার মধ্যে সর্ববৃহৎ দিনাজপুর জেলাটি রংপুর শহর থেকে প্রায় ৭৮ কি.মি. উত্তর-পশ্চিম দিকে অবস্থিত এবং রাজধানী ঢাকা থেকে এর দূরত্ব প্রায় ৩৩৮ কি.মি.। বাসমতি ও কাটারিভোগ চাল, সুমিষ্ট ও সুস্বাদু আম ও লিচুর জন্য বাংলাদেশের বিখ্যাত একটি জেলা। দেশের সব জেলাতেই লিচু চাষ হয়, তবে তুলনামূলকভাবে দিনাজপুরে বেশি পরিমাণে লিচু উৎপাদিত হয়। বিভিন্ন জাতের লিচু চাষ হলেও মাদ্রাজি, বোম্বাই, বেদানা, চায়না-৩, কাঁঠালি বোম্বাই বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য এবং বর্তমানে বেদানা লিচু বিদেশেও রপ্তানি করা হচ্ছে।

দিনাজপুর লিচু চাষের জন্যে বাংলাদেশের অন্যতম অনুকূল অঞ্চল হিসেবে সুপরিচিত। কেননা দেশের এই অঞ্চলের আবহাওয়া ও মাটির ধরন লিচু চাষের জন্য খুবই উপযোগী।

প্রধানত তাপমাত্রা, আপেক্ষিক আর্দ্রতা ও বৃষ্টিপাত পরিমিত পরিমাণে হওয়ায় ব্যাপক পরিমাণে লিচুর ফলন হয়। এই জেলা সমুদ্র উপকূল থেকে সর্বাধিক উত্তরে অবস্থিত। ফলে গ্রীষ্মকালে উচ্চ তাপমাত্রা (প্রায় ৯৯° ফারেনহাইট) এবং আপেক্ষিক আর্দ্রতা কম থাকে। বার্ষিক বৃষ্টিপাত ১৫০ সেমি. ও বাতাসের আপেক্ষিক আর্দ্রতা ৭০-৮৫% লিচু চাষের জন্য উপযোগী যা দিনাজপুর অঞ্চলে প্রতীয়মান। কালবৈশাখী ঝড় ও বৃষ্টিপাত লিচু চাষের প্রয়োজনীয় পানি সরবারাহ করে। যেহেতু লিচু চাষের জন্যে অপেক্ষাকৃত কম পানি প্রয়োজন তাই কৃত্রিম সেচ এর প্রয়োজন হয় না।

আবার, ভূপ্রকৃতির ধরণ অনুযায়ী দিনাজপুর হচ্ছে বরেন্দ্রভূমি এবং সমুদ্রপৃষ্ঠতল (Sea level) হতে এর উচ্চতা ৩৭ মিটার। এখানকার প্রচুর জৈব পদার্থ সমৃদ্ধ নিষ্কাশিত গভীর উর্বর দো-আঁশ মাটি লিচু চাষের জন্য সর্বোত্তম। কেননা এ ধরনের মাটিতে জন্মানো গাছের শিকড়ে মাইক্রোরাইজা নামক একধরনের ছত্রাক উৎপন্ন হয়। এ ছত্রাকগুলো মিথোজীবীতার মাধ্যমে গাছে পুষ্টি উপাদান সরবরাহ করে থাকে।  এধরণের মাটির পানি ধারণ ক্ষমতা আপেক্ষিক ভাবে কম হওয়ায় গাছের গোড়ায় পানি জমে থাকে না। এ অঞ্চলের মাটির ধরণ বেলে দো-আঁশ যা লিচু চাষের জন্যে অত্যন্ত উপযোগী। সাধারণত মাটির পিএইচ মান ৬.৫-৬.৮ হলে লিচু চাষ উপযোগী হয়। দিনাজপুরের মাটি কিছুটা অম্লীয় যা লিচু চাষের জন্যে অনুকূল। এছাড়া এই মাটি  উচ্চ জৈব উপাদান ও পুষ্টিগুন সমৃদ্ধ যা সুমিষ্ট ও সর্বাধিক ফলনের নিশ্চয়তা প্রদান করে।

এছাড়াও লিচু গাছের অধিক চারা উৎপাদনের জন্য সাধারনত বিভিন্ন ধরণের কলম  তুলনামূলক সহজ ও দিনাজপুরের আবহাওয়া উপযোগী। সাধারণত ব্যবসায়ীক ক্ষেত্রে কম সময়ে অধিক ফলনের জন্য শাখা কলম, গুটি কলম এর মাধ্যমে চারা উৎপাদন করা হয়। এর ফলে লিচু পুষ্টি উপাদান ও গুনগত মান অক্ষুন্ন থাকে । তবে বীজ মাধ্যমেও চারা উৎপাদন সম্ভব কিন্তু সময়সাপেক্ষ বেশি হওয়ায় ব্যবসায়িক প্রেক্ষিতে এটা অনুপযোগী। এছাড়াও বাডিং, গ্রাফটিং এর মাধ্যমেও চারা উৎপাদন করা হয়।

দিনাজপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর লিচু বাজারজাতকরণ ও নিয়ন্ত্রণ, পরিবহন ও সংরক্ষণ, সঠিক মূল্য নিশ্চিত এসব বিষয় তত্ত্বাবধান করেন। তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় সাধারণ মানুষ লিচু চাষের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠছে। বর্তমান দিনাজপুর জেলায় প্রায় ৬ হাজার হেক্টর এলাকা জুড়ে ব্যবসায়িক ভাবে লিচু চাষ হচ্ছে। এর ফলে খাদ্য চাহিদা পূরণ, বেকারত্ব হ্রাস ও  জিডিপি তে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এই মৌসুমী ফলের চাষ।

লেখক:শিক্ষার্থি, হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি, দিনাজপুর।