টিকাদান ও রোগ-প্রতিরোধকতা

মো:আসিফ-উজ-জামান
১। টিকার মূলকথা কী ?
টিকা (vaccine)-তে নির্দিষ্ট রোগ সৃষ্টির জন্য দায়ী নির্দিষ্ট জীবানু (specific germs) যেমন- হাম টিকাতে হাম-জীবানু ও এইচআইভি টিকাতে এইচআইভি-জীবানু ধারণ করে। কিন্তু এই জীবানু এমন যে, তারা হয় মৃত, আর না হয় এতো দূর্বল যে আপনাকে অসুস্থ করতে পারেনা। কোন কোন টিকাতে আবার রোগ-সৃষ্টিকারী ঐ জীবানুর অংশবিশেষও থাকতে পারে। আপনি যখনই কোন রোগের সম্মুখীন হউন না কেন, এই টিকা আপনার শরীরের এন্টিবডি (antibodies) উৎপন্ন করার জন্য রোগ-প্রতিরোধক সিস্টেম (immune system) কে উদ্দীপ্ত (stimulates) করে চলে। এভাবে টিকা যেন একটি শক্তিশালী ঔষধের কাজ করে; এমনকি অধিকাংশ ঔষধ (রোগের প্রতিরোধ ও প্রতিকারের মাধ্যমে) যা না করে, টিকা সেগুলোও করতে পারে।

২। টিকাদান কী ?
টিকাদান (vaccination) হলো ক্ষতিকর রোগের সংস্পর্শে আসার পূর্বেই উক্ত রোগ হতে দেহকে সহজ, নিরাপদ ও কার্যকরভাবে সূরক্ষা করার একটি পদ্ধতি, যার মাধ্যমে আপনার দেহের প্রাকৃতিক রক্ষাকবচ (natural defenses) ঐ সুনির্দিষ্ট রোগ-সৃষ্টিকারী জীবানুর (specific pathogens) বিরুদ্ধে প্রতিরোধ-ক্ষমতা তৈরী করে দেহকে আরও বেশি মজবুত ও শক্তিশালী করে। এই টিকা কোন রোগের সংস্পর্শে আসলে দেহের রোগ-প্রতিরোধক কে এন্টিবডি তৈরী করার জন্য শেখায় বা নির্দেশ দেয়। যাহোক টিকা যেহেতু নিজেই ঐ রোগ-সৃষ্টিকারী (মৃত বা দূর্বল) জীবানু (যেমন: ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়া) ধারণ করে, তদুপরি এটা কোন রোগ-জটিলতা বা রোগ-প্রাদুর্ভাবের ঝুঁকি রাখে না। বেশিরভাগ টিকা ইনজেকশন করে, কিছু মুখে খাইয়ে, কিছু নাকে স্প্রে করে দেয়া হয়। অধিকাংশক্ষেত্রে, টিকা-ই এখন বিভিন্ন রোগ থেকে বাঁচাতে কিংবা জীবন রক্ষাকারী সর্বশেষ একটি নিরাপদ ও কার্যকরী পথ হিসেবে সর্বোচ্চ বিবেচিত হচ্ছে।

বর্তমান বিশ্বে ২০ রকম রোগের টিকা ব্যবহৃত হচ্ছে, যেমনঃ নিউমোনিয়া, কলেরা, পোলিও, হাম, ডিপথেরিয়া, ইন্ফ্লুয়েঞ্জা, টিটেনাস, টাইফয়েড, জলাতঙ্ক, জলবসন্ত, বাতজ্বর, মেনিনজাইটিস, মাম্পস্, রুবেলা, রোটাভাইরাস, পার্চুসিস, এনসেফালিটি, হেপাটাইটিস-বি, সারভিক্যাল ক্যানসার , কোভিড-১৯।

৩। টিকাদান গুরুত্বপূর্ণ কেন ?
আমরা যখন টিকা নিচ্ছি, তখন শুধু নিজেদের নয়, বরং আমাদের চারপাশের সবাইকে পরোক্ষভাবে রক্ষা করছি। কেউ এমনও আছে যে, অতি বার্ধক্যজনিত, অসুস্থতাজনিত বা অন্য কোন কারণে টিকা নিতে পারছে না, ফলে তারা বাকীদের উপর নির্ভর করছে যারা এভাবে টিকা নিচ্ছে এবং ঐ রোগের প্রাদুর্ভাব কমাতে সাহায্য করছে। এখন কোভিড-১৯ বিশ্বব্যাপি ছড়িয়ে পড়ায় আমাদের সবার জন্যেও টিকা নেয়া চরম সঙ্কটময়, অত্যাবশ্যকীয় ও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাড়িয়েছে। এই কারণে শিশুদের অন্যান্য টিকা দেয়াও চরম হুমকির দিকে যাচ্ছে বা ব্যাপক হারে কমে গিয়েছে, যা-কিনা তাদের প্রতিরোধমূলক রোগ সত্ত্বেও তাতে অসুস্থতা ও মৃত্যু হার আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। তাই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) বিভিন্ন দেশে জরুরিভিত্তিতে ঐ প্রয়োজনীয় টিকাদান কর্মসূচী নিশ্চিতভাবে চালিয়ে যেতে বলেছে, যাতে কোভিড-১৯ এর চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও শিশুরা তাদের টিকার স্বাস্থ্য সেবা নিয়মিত পেতে থাকে।

৪। একটি টিকা কাজ করে কিভাবে ?
টিকা দেহের প্রাকৃতিক রক্ষাকবচ সহযোগে কাজ করে এর প্রতিরক্ষা মজবুত করে রোগ-জীবানু আক্রমন কমায় বা ঝুঁকি কমায়। আপনি যখন একটি টিকা নিচ্ছেন, আপনার প্রতিরোধক সিস্টেম সাড়া দিচ্ছে যেভাবেঃ
-বহিরাগত জীবানু সনাক্ত (recognize)  করে; যেমন: ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়া।
-এন্টিবডি-সমূহ উৎপন্ন করে, যা শরীরে প্রাকৃতিকভাবে প্রোটিন থেকে উদ্ভুত, যা প্রতিরোধক সিস্টেম কে রোগের বিরুদ্ধে কাজে লাগায়।
-রোগ ও তার বিরুদ্ধে কিভাবে কাজ করতে হবে তা স্মরণে রাখে যেন, ভবিষ্যতে যখনই আপনি ঐ জীবানুর সম্মুখিন হবেন, তখন অসুস্থ হবার আগেই আপনার প্রতিরোধক সিস্টেম তাকে দ্রুত ধ্বংস করতে পারে।

তাই টিকা হলো একটি নিরাপদ ও চট-জলদি পথ, যেখানে দেহে কোনরুপ অসুস্থতা ছাড়াই রোগ-প্রতিরোধকতা সৃষ্টি করে। আমাদের প্রতিরোধক সিস্টেম কে সেভাবেই কাঠামোগত করা হয়েছে। কেউ একবার টিকার এক বা একাধিক ডোজ নিলে বছর, দশক, এমনকি জীবনব্যাপী তার রোগ-প্রতিরোধকতা থাকে। আর সে কারনেই টিকা এতো কার্যকরী। দেহে জীবানুর আক্রমনে রোগ প্রকাশ পেয়ে অসুস্থ হয়ে চিকিৎসা নেবার আগেই টিকা আমাদেরকে তাৎক্ষণিক সূরক্ষা দেয় বা রক্ষা করে \

৫। টিকা একজন ব্যক্তি ও সমাজ কে রক্ষা করে কিভাবে ?
যখন কেউ একটি রোগের টিকা নিচ্ছে, তখন তার রোগ সংক্রমনের ঝুঁকি কমে যাচ্ছে - ফলে তার মাধ্যমে ঐ ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়া খুব কমই অন্যদের মাঝে ছড়াচ্ছে (transmit)। এভাবে সমাজে (community) অধিক সংখ্যায় টিকার আওতায় আসলে খুব কমই সঙ্কটাপন্ন (vulnerable) অবস্থায় থাকবে এবং একজন আক্রান্তের মাধ্যমে রোগ-জীবানু (pathogen) অন্যদের কাছে পরিবহনের সম্ভাবনাও থাকবে খুব কম; যার ফলে যতই সংক্রমণ কমে যাবে, ততই অন্যদের যারা (বয়স বা স্বাস্থ্যগত বা অন্য রোগের কারণে) টিকা নিতে পারছে না, তাদের রক্ষা করে চলছে। দলগত প্রতিরোধকতা ((herd immunity) আবার সামাজিক প্রতিরোধকতা (population immunity) হিসেবেও পরিচিত, যেটা পরোক্ষভাবে কোন একটি সংক্রমিত (infectious) রোগ থেকে সূরক্ষা দেয়, যেটা ঘটে যখন সমাজে প্রতিরোধকতা বিকাশ লাভ (immunity develop) করে- হয় টিকাদান কর্মসূচীর মাধ্যমে, আর না হয় আগের কোন সংক্রমণের মাধ্যমে। দলগত প্রতিরোধকতা বলতে এটা বুঝায় না যে, টিকা ছাড়াই অথবা আগে সংক্রমিত হয় নাই তবুও তারা প্রতিরোধ সক্ষমতা পেয়ে গেছে বা সূরক্ষিত রয়েছে; বরং দলগত প্রতিরোধকতা কার্যকরী হবে তখনই, যখন প্রত্যেক ব্যক্তি যে কিনা তখনও সূরক্ষিত নয় কিন্তু সে সবচেয়ে বেশি সূরক্ষিত (high proportionate immunity)  সমাজের মধ্যে বসবাস করে, যে কিনা ঐ ব্যক্তির চেয়ে বেশি রোগের ঝুঁকি কমায়, যে অপেক্ষাকৃত অ-প্রতিরোধক বা সবচেয়ে কম সূরক্ষিত (small proportionate immunity) সমাজের মধ্যে বসবাস করে। বেশি সূরক্ষিত সমাজে, অ-সূরক্ষিত (non-immune) ব্যক্তিবর্গ অন্য সমাজে যেভাবে থাকত, তার তুলনায় তারা ঐ রোগের কম ঝুঁকিতে থাকে, কিন্তু তারা ব্যক্তিগতভাবে সূরক্ষিত (personally immune) নয়। এমনকি ঐ সমাজে দলগত প্রতিরোধকতা সর্বাগ্রে অর্জিত হবার পরও এবং অসূরক্ষিত (unimmunized) ব্যক্তিদের রোগের ঝুঁকি কমার পরও ঐ রোগের পুন: সংক্রমণের ঝুঁকি আবারও বাড়তে পারে, যদি টিকাদানের পরিধি (coverage) নিয়মিত ও ক্রমশ না বাড়ে। যখন টিকাদানের পরিধি থাকে তুঙ্গে (very high), কেবল তখনই অসূরক্ষিত ও সূরক্ষিত (truly immune) উভয়ে রোগ হবার ঝুঁকি বা রোগ না হবার সম্ভাবনা সমান থাকতে পারে।

৬। আমার টিকা নেয়া উচিত কেন ?
টিকা ছাড়া আমরা বিভিন্ন রকম গুরুতর রোগে অসুস্থ (illness) বা বিকলাঙ্গ (disability) হই। এই রোগের অধিকাংশই জীবনহানী-কারক (life-threating)। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসেবে, প্রতি বছর ২-৩ মিলিয়ন শিশুর জীবন বাঁচায় এই টিকা। যদিও কিছু অপরিচিত রোগসমুহ আছে, তবুও যেসব জীবানুর মাধ্যমে তা হয়, সেগুলো অংশত বা সারা বিশ্বে নিয়মিত পরিবাহিত (circulate) হচ্ছে। আজকের বিশ্বে সংক্রমণ রোগসমূহ সহজেই নিজ সীমানা অতিক্রম (cross-borders) করছে এবং সূরক্ষিত নয় এমন যে কাউকে আক্রমন (infect) করছে। তাই দু’টি কারণে- আমাদের নিজেদের সূরক্ষায় এবং আমাদের চারপাশে যারা আছে তাদের সূরক্ষায় টিকা নেয়া উচিত। কেননা সবাই (শিশু, বৃদ্ধ, গুরুতর রোগে অসুস্থ বা এর প্রতি এলার্জিগ্রস্থ ব্যক্তি ইত্যাদি) টিকা নিতে পারছে না বলে, যারা টিকা নিচ্ছে তাদের উপর তারা নির্ভরশীল এবং এটা নিশ্চিত করতে হচ্ছে যে, টিকা-প্রতিরোধক্ষম (vaccine-preventable) রোগ থেকে তারা নিরাপদ থাকছে \

৭। আমার (বা সন্তানের) টিকা নেয়া উচিত কখন ?
টিকা আমাদের সবাইকে জন্ম হতে শৈশব, কৈশর ও বৃদ্ধ বয়সসহ বিভিন্ন বয়সে তথা জীবনভর রক্ষা করে চলেছে। পৃথিবীর অনেক দেশেই আপনি একটি টিকাপত্র (vaccination card) পেয়ে থাকবেন যেখানে আপনি বা আপনার সন্তান ইতোমধ্যেই কোন টিকা নিয়েছেন আর কোন টিকা বা বুষ্টার ডোজ নিতে বাকী আছে তার উল্লেখ থাকবে। তবে এটা গুরুত্বপূর্ণ যে, আপনি অবশ্যই নিশ্চিত হবেন ঐ টিকাগুলো সবই হালনাগাদ করা হয়েছে। টিকা নিতে দেরী করলে, আমরা ক্রমশ মারাত্মকভাবে অসুস্থ্য হওয়ার ঝুঁকিতে পড়তে থাকি। আমরা মারাত্মকভাবে অসুস্থ্য হওয়ার আগ পর্যন্ত টিকা নেব না মনে করে (যেমন- কোন রোগের প্রাদুর্ভাবের পরও) অপেক্ষা করতে থাকলে, পরবর্তিতে টিকা ও এর নির্দেশিত সব ডোজ নেবার পরেও, তাদের কাজ করতে খুব বেশি সময় হয়তো পাওয়া যাবে না। এক্ষেত্রে সঠিক টিকাও ব্যর্থায় পর্যবশিত হতে পারে।

৮। টিকা খুব কম বয়সে শুরু করা হয় কেন ?
প্রাত্যাহিক জীবনে শিশুরা বিভিন্ন স্থানে, নানা মানুষের সাথে, কোন না কোন স্থানে রোগের সম্মুখিন হচ্ছে এবং যেটা তাদের সাংঘাতিক ঝুঁকিতে ফেলতে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশকৃত টিকা কর্মসূচী যেন আগে-ভাগেই বাঁচ্চা ও শিশুদের রক্ষা করতে পারে সেভাবেই রুপায়ণ (designed) করা হয়েছে। বাঁচ্চা ও শিশুরা প্রায়ই উপর্যপুরি রোগে ডুবে থাকে, কারণ তখনও তাদের রোগ প্রতিরোধক সিস্টেম পুরোপুরিভাবে উন্নত (developed) হয়নি এবং তাদের দেহ খুব কমই রোগের বিরুদ্ধে লড়তে সচেষ্ট থাকে। তাই এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ যে, রোগের বিরুদ্ধে বাঁচ্চাদের জন্য সুপারিশকৃত সময়েই টিকা দেয়া দরকার। কোন টিকাই নির্ধারিত সময়ের চেয়ে দেরিতে দেওয়া যায় না, তবে অনাকাঙ্খিতভাবে, কোন টিকা নিতে দেরি হলে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শক্রমে তা আপনার বা আপনার শিশুর জন্য প্রযোজ্য হবে কিনা তা জেনে নিতে হবে।

৯। টিকা নিতে পারে আসলে কে ?
প্রায় সবাই টিকা নিতে পারে। তারপরও কিছু চিকিৎসাবস্থার কারণে কতকের কিছু নির্দিষ্ট টিকা নেয়া উচিত নয় অথবা টিকা নেয়ার পূর্বে অপেক্ষা করা উচিত। সেই অবস্থাগুলো হলোঃ

  • দুরারোগ্য অসুস্থতা অথবা চলমান চিকিৎসা (যেমন-কেমোথেরাপি) যা প্রতিরোধক সিস্টেম-এ প্রভাব রাখে
  • টিকার উপাদানের প্রতি তীব্র ও জীবন-নাশক এলার্জি, যা সচারাচর দেখা যায় না
  • কঠিন অসুস্থতা এবং যদি সেকারণে টিকা নেবার দিনে অনেক জ্বর থাকে।

এই প্রভাবকসমূহ বিভিন্ন টিকার জন্য ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে। যদি আপনি না জানেন যে, আপনার বা আপনার সন্তানের নির্দিষ্ট কোন টিকা নিতে হবে, তবে আপনার নিকটস্থ ডাক্তারদের সাথে যোগাযোগ করুন। তারা আপনার বা আপনার সন্তানের জন্য পছন্দসই টিকা নেবার সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করবে \

১০। টিকা প্রস্তুত ও পরীক্ষা করা হয় কিভাবে ?
সাধারণ টিকাসমূহ যুগ যুগ ধরে প্রস্তুত হয়ে আসছে যেগুলো লক্ষ লক্ষ মানুষ প্রতিবছরই নিরাপদে নিচ্ছে। সকল ঔষধের মতোই, প্রতিটি দেশে প্রতিটি টিকা প্রবেশের আগেই ব্যাপক (extensive) ও কঠোর (rigorous) পরীক্ষণের মধ্য দিয়ে নিশ্চিত করা হয় যে এটা নিরাপদ। একটি পরীক্ষামূলক টিকা (experimental vaccine) প্রথমে কতক প্রাণির উপর পরীক্ষা করে এর রোগ নিরাময়ের নিরাপত্তা (safety) ও প্রবণতা (potentials) মূল্যায়ন করা হয়। তারপর সেটা মানবদেহে ৩ টি ধাপে পরীক্ষা (clinical trials) করা হয় এভাবেঃ

  • ধাপ-১ঃ টিকাটি অল্প-সংখ্যকের উপর প্রয়োগ করে দেখা হয়, এটি নিরাপদ (safe) কিনা, প্রতিরোধক-সাড়া (immune response) দিচ্ছে কিনা এবং তার সঠিক মাত্রা (right dosage) কি হতে পারে
  • ধাপ-২ঃ এখানে টিকাটি শত-সংখ্যকের উপর প্রয়োগ করা হয়, নিবিড় পর্যবেক্ষণে রেখে তাদের কোন পাশ্ব-প্রতিক্রিয়া (side effects)  এবং পুনরায় প্রতিরোধক-সাড়া দিচ্ছে কিনা লক্ষ্য করা হয়। এই ধাপে, রোগের ফলাফল disease outcomes) সম্পর্কিত বেশকিছু তথ্য বেরিয়ে আসলেও, রোগের উপর টিকার কার্যকারিতার নির্ভূল প্রতিচ্ছবি (clear picture) তখনও যথেষ্ট নয়। তবে এই ধাপে, যাদের জন্য টিকা উদ্ভাবন করা হচ্ছে তাদের মতোই (বয়সে ও লিঙ্গে) এই অংশগ্রহণকারীদেরও রাখা হয়। এখানে কাউকে যথেচ্চ টিকা দিয়ে, কিংবা না দিয়ে তুলনামূলক চিত্র দেখা হয় যাতে করে টিকা সম্পর্কে একটি স্বচ্ছ উপসংহারে আসা যায়।
  • ধাপ-৩ঃ এবার টিকাটি হাজার-সংখ্যকের উপর প্রয়োগ করা হয়, কেউ অনুসন্ধানী টিকা ((investigational vaccine) হিসেবে, আবার কেউ ঠিক আগের ধাপের মত টিকা নেয়। উভয় দলের থেকে প্রাপ্ত তথ্যসমূহ সতর্কতার সাথে তুলনা করে দেখা হয় যে, টিকাটি নিরাপদ কিনা এবং যে রোগের বিরুদ্ধে রুপায়িত হয়েছে তার জন্য যথেচ্চ কার্যকরী কিনা।

একবার টিকার ফলাফল পরীক্ষিত ও সহজলভ্য হলে টিকাটি কোন জাতীয় রোগ-প্রতিরোধক কর্মসূচীতে (national immunization programme) অন্তর্ভূক্তির আগেই একটি ধারাবাহিক পদক্ষেপের প্রয়োজনীয়তাসহ, কার্যকারিতার পুনর্বিচার (efficacy reviews),  নিরাপত্তার, এবং নিয়মতান্ত্রিক উৎপাদনের (regulatory manufactures) জন্য জনস্বাস্থ্য পলিসি অনুমোদনের দরকার হয়।

১১। একটি টিকাতে কী আছে ?
একটি টিকার সমস্ত উপাদান (ingredients) ঐ টিকার নিরাপদ ও কার্যকর ব্যবস্থা নিশ্চিত রাখতে মূখ্য ভূমিকা পালন করে। সেগুলো হলো-

  • এন্টিজেন (antigens) হলো দেহের বাইরে থেকে এর রক্তস্রোতের মধ্যে প্রবিষ্ট পদার্থ যা রোগজীবানু-প্রতিরোধক পদার্থ সৃষ্টি করে, যা কিনা একটি মৃত বা দূর্বল ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়ার গঠন, যা আমাদের দেহকে ভবিষ্যতে প্রবেশ করতে পারে এমন রোগ-জীবানু চিনতে ও তাদের বিরুদ্ধে লড়তে শেখায়।
  • এড্জুভেন্ট (adjuvants) হলো কার্যকরী, দরকারী, উপকারী, উপযোগী, সাহায্যকারী, সহায়তাকারী, সমর্থনকারী বা হিতকরী পর্দাথ যা আমাদের প্রতিরোধক-সাড়াকে আরো উন্নতিসাধন-জোরদার (boost-up) করে। তার মানে হলো এরা টিকার কার্যাদি উত্তমভাবে সম্পন্ন করতে সহায়তা করে।
  • প্রিজারভেটিভ (preservatives) হলো একরকম সংরক্ষক, সংরক্ষণকর পর্দাথ বা সংরক্ষণকর ব্যবস্থা যা টিকাকে দীর্ঘকালব্যাপি কার্যকরী থাকতে নিশ্চিত করে।
  • স্ট্যাবিলাইজার (stabilizers) হলো একরকম পর্দাথ যা টিকাকে পরিবহন ও গুদামজাতকরণ সময়ে এর গুনাগুণ ও কার্যকারীতা অক্ষুন্ন রাখে।

টিকার উপাদানসমূহ লেবেলে যেভাবে উল্ল্যেখ করা থাকে তাতে অপরিচিত লাগতে পারে। যাহোক, টিকাতে ব্যবহৃত উপাদানের অনেকাংশই প্রাকৃতিকভাবে আমাদের শরীরে, আমাদের পরিবেশে এবং আমরা যা খায় তাতে থাকে। টিকার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে, টিকার সমস্ত উপাদান - টিকা নিজেও - ধারাবাহিকভাবে পরীক্ষিত (tested)  ও নজরদারীতে (monitored) রাখা হয়।

১২। টিকার পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া আছে কী ? না শুধুই নিরাপদ ?
হা, টিকা আসলেই নিরাপদ। টিকা নিলে শরীরের সাথে তার হালকা আন্তঃ ক্রিয়া-বিক্রিয়া (mild reactions) কয়েকদিন চলতে থাকে। ফলে অন্যান্য ঔষধের মতো টিকার পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া থাকতে পারে; যেমন: হাতে-পায়ে চুলকানি, হালকা জ্বর, ইনজেকশন স্থানে ব্যাথা বা লালভাব ইত্যাদি, যেগুলো পরিমানে খুব কম বা অস্থায়ীভাবে হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে টিকাতে স্থায়ী এবং অনেক বেশি পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া হতে পারতো, কিন্তু সচরাচর তা হয় না। যেকোন লাইসেন্সধারী টিকা ব্যবহারের অনুমোদন প্রাপ্তির আগেই ট্রায়াল এর বিভিন্ন ধাপে কঠোরভাবে পরীক্ষিত (rigorously tested) এবং একবার টিকাদান শুরু হলে তার নিয়মিত চাহিদা পুনরায় যাচাই (reassessed) করা হয়। বিজ্ঞানীগণ প্রতিনিয়ত টিকাতে স্বাস্থ্য ঝুঁকি ঘটতে পারে এমন বিভিন্ন উৎস হতে যেকোন আলামত-তথ্য নজরদারী করতে থাকে। মনে রাখুন, একটি টিকার চেয়ে, তা দিয়ে সাংঘাতিক ক্ষত সৃষ্টি বা ক্ষতিগ্রস্থ হওয়া আরও অনেক দূরের ব্যাপার।

উদাহরণস্বরুপঃ টিটেনাস (tetanus) রোগে চরম ব্যাথা, পেশি খিঁচুনি (spasms) বা দাঁতি-লাগা (lockjaws) ও রক্তজমাট বাঁধা ঘটে এবং হাম (measles) রোগে মস্তিষ্কে প্রদাহ (encephalitis) ও অন্ধত্ব (blindness) পর্যন্ত ঘটে। টিকাতে নিরাময়যোগ্য এমন অনেক রোগই (টিকা না নেয়ার জন্য) তার মৃত্যুর কারণ হতে পারে। তাই টিকাদানের গুরুত্ব, তার ঝুঁকির চাইতেও চরমভাবে অগ্রগণ্য (outweigh), এবং টিকা ছাড়াও অনেক অসুস্থতা ও মৃত্যু ঘটতে পারে।

১৩। বাঁচ্চাকে একসাথে একাধিক টিকা দেয়া যাবে কি ?
বিজ্ঞানসম্মত তথ্য-প্রমান প্রতিয়মান করে যে, একসাথে একাধিক টিকা দেয়া বা নেয়াতে কোন বিরুপ প্রতিক্রিয়া negative effect) নাই। প্রতিদিন বাচ্চারা প্রতিনিয়ত হাজার হাজার বর্হিবস্তুর (foreign substances) সংস্পর্শ্বে আসছে যেগুলো তাদের প্রতিরোধক-সাড়া জাগাতে ট্রিগার (trigger)-এর ভূমিকা রাখছে। খাদ্য গ্রহনের মাধ্যমে খুব সহজ পথে নতুন নতুন জীবানু (new germs) দেহে প্রবেশ করছে এবং অনেক ব্যাকটেরিয়া নাকে ও মুখে বাস করছে। যখন একসাথে একটি সমন্বিত টিকা (combined vaccine) যথা-ডিপথেরিয়া, পার্চুসিস ও টিটেনাস দেয়া সম্ভব হচ্ছে, তখন বাচ্চাদের জন্য কম ইনজেকশন কম অস্বস্থিকর অবস্থা ঘটছে। এটার মানে হলো, আপনার বাচ্চা কোন মারাত্মক রোগের সংস্পর্শ্বে বা ঝুঁকিতে আসার আগেই সঠিক সময়ে সঠিক টিকা নিতে পারছে।

১৪। টিকা ও অটিজম এর মধ্যে কোন যোগসূত্রতা আছে কি ?
না, টিকা ও প্রতিবন্ধী (autism or autistic) ব্যাধির মধ্যে কোন যোগসূত্রতা নাই। এটা অনেক গবেষণায় বিপুল সংখ্যক জনতার মধ্যে অধ্যায়ন ও অনুসন্ধান পরিচালনা করে প্রদর্শিত হয়েছে। ১৯৯৮ সালে, এক গবেষণায় উঠে এসেছিল যে, measles-mumps-rubella (MMR)-এর টিকা ও অটিজম এর মধ্যে সম্ভাব্য যোগসূত্রতা আছে এবং তখন এটা মারাত্মকভাবে দ্বিধান্বিত (flawed) ও প্রতারণাপূর্ণ (fradulent) হিসেবে জনগণ জেগে উঠেছিল। গবেষণা পত্রটি যে জার্নালে প্রকাশিত হয়েছিল, সেখান থেকে পরবর্তিকালে সেটা প্রত্যাহার (retracted)  করা হয়েছিল এবং যে ডাক্তার এটা প্রকাশ করেছিল, তিনি তার মেডিকেল লাইসেন্স হারিয়েছিল। দুর্ভাগ্যবশত, এই প্রকাশনা জনমনে ভয়ের সঞ্চার করেছিল এবং বেশকিছু দেশে টিকাদানের হারও কমে গিয়েছিল, এবং এইসব রোগের প্রাদুর্ভাবও (outbreaks) বেড়ে গিয়েছিল।\

যাহোক, অবশ্যই সবাই নিশ্চিত করব যে, আমরা টিকার উপর বিশ্বাসযোগ্য-সত্য, বিজ্ঞানসম্মত-তথ্য এবং ঐ টিকা যেসব রোগ নিরাময় করে একমাত্র তারই প্রচার-প্রসার করতে নানান পদক্ষেপ গ্রহন করব, অন্যথায় নয়। পুরো বিষয়টি মনযোগ সহকারে, অত্যন্ত ধৈর্য্য সহকারে পড়া ও বোঝার জন্য এবং অন্যদেরও বেশি করে শেয়ার করার জন্য, আমি সবাইকে জানাচ্ছি আমার আন্তরিক মোবারকবাদ, ধন্যবাদ।
(জনস্বার্থে সংগৃহিত, সংযোজিত ও ভাষান্তরীত)
লেখক:(মৎস্যবিদ ও ফিশারীজ এক্সপার্টাইজ)
মার্কেটিং ম্যানেজার, এগ্রো ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্রাস্ট(এআইটি ফিড)