ফিশারিজ গ্র্যাজুয়েটদের চাকরি নিচ্ছে অন্যরা, শিক্ষার্থীদের ক্ষোভ!

বাংলাদেশে মৎস্য সেক্টরে অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করেছে। স্বাদু পানির মাছ উৎপাদনে আমরা বিশ্বে ৩য়, ইলিশ উৎপাদনে বিশ্বে ১ম, তেলাপিয়া উৎপাদনে ৪র্থ। এই অবদানের পিছনে রয়েছে ফিশারিজ গ্রাজুয়েটদের বিশাল অবদান। কিন্তু যে সব সেক্টরে মাৎস্য বিজ্ঞানের গ্রাজুয়েটরা চাকরির সুযোগ পাবার কথা সেখানে প্রাণিবিজ্ঞানের গ্রাজুয়েটরা চাকরির সুযোগ পেলেও মাৎস্য বিজ্ঞানের গ্রাজুয়েটরা সব জায়গায় আবেদন করতে পারছে না। এ নিয়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের মাৎস্যবিজ্ঞান শিক্ষার্থী ও গ্রাজুয়েটদের অভিযোগগুলো শুনেছেন আবুল বাশার মিরাজ..........

সামিউর রহমান নাবিল (শিক্ষার্থী, মাস্টার্স ইন একোয়াকালচার, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়):
সামগ্রিক দিক বিবেচনায় অর্থনৈতিক ভাবে মৎস্য খাত খুবিই গুরুত্বপূর্ণ একটি খাত। স্বাদু পানির মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ ৫ম, ইলিশ উৎপাদনে ১ম, মৎস্য উৎপাদনে ৩য়,সামুদ্রিক মাছ উৎপাদনে বিশ্বে ১১তম।জিডিপির ৩.৫৭% অর্জিত হচ্ছে মৎস্য সেক্টর থেকে। ব-দ্বীপ পরিকল্পনা-২১০০ এর বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে মৎস্য খাত খুবিই গুরুত্বপূর্ণ যা দেশের উন্নয়নে বিশাল প্রভাব ফেলবে। উক্ত গুরুত্ব বিবেচনায় মৎস্য সেক্টরকে যুগোপযোগী করে গড়ে তোলার জন্য মৎস্য স্নাতকদের অর্জিত জ্ঞান ও দক্ষতাকে যথাযথ ভাবে কাজে লাগানোর বিকল্প নেই। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীনে মৎস্য অধিদপ্তরের টেকনিক্যাল পদ হওয়ায় মৎস্য স্নাতকরাই নিয়োগ পাওয়ার যোগ্য দাবিদার। দেশে প্রায় ১৭টি বিশ্ববিদ্যালয় হতে প্রায় ১২০০ মৎস্য স্নাতক বের হচ্ছে যাদের কর্মসংস্থানের কথা বিবেচনা করে হলেও উক্ত পদসমূহে নিয়োগ প্রদান করা উচিৎ সেই সাথে নিয়োগ বিধিমালা -২০২০ এর সংশোধন করা জরুরী। নতুবা একটি বৈষম্যের সৃষ্টি হবে যা মৎস্য সেক্টরের উন্নয়ন কার্যক্রমের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলবে।

জিহাদ হোসাইন (শিক্ষার্থী, মাস্টার্স ইন একোয়াকালচার, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়): মাৎস্য বিজ্ঞান স্নাতক গণ বিশ্ববিদ্যালয়ে মাছের রোগবালাই, মাছের জিনতত্ব ও প্রজনন,মৎস্য চাষ, মৎস্য প্রযুক্তি,সামুদ্রিক মাছের বংশবৃদ্ধি ও মাছের স্টক এসেসমেন্ট, ব্রডস্টক ও হ্যাচারী ম্যানেজমেন্ট, মৎস্য খাদ্য প্রস্তুত ও মাছের পুষ্টিগুণ, মৎস্য প্রযুক্তি সম্প্রসারণ বিষয়সহ বিভিন্ন বিষয়ে তত্ত্বীয় ও ফিল্ড ভিজিটের মাধ্যমে জ্ঞান আহরণ করে থাকেন। সম্প্রতি বিপিএসসি প্রকাশিত নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে মৎস্য অধিদপ্তরের পদ সমূহের কার্যক্রমের সাথে মৎস্য গ্রাজুয়েটদের অর্জিত জ্ঞান ও দক্ষতা সামঞ্জস্যপূর্ণ। মৎস্য স্নাতকদের এ সকল কার্যক্রমে সম্পৃক্ত করতে পারলে মৎস্য সেক্টরে অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন সম্ভব। তাছাড়া জাতিসংঘ ঘোষিত এসডিজি-২০৩০ এর ১৪ নম্বর সূচকে সমুদ্র সম্পদকে টেকসইভাবে ব্যবহার করার কথা উল্লেখ আছে। যার ৩৫% মৎস্য সম্পদ,এই সম্পদের যথোপযুক্ত ও টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে মৎস্য অধিদপ্তরে নতুন পদ সৃজনের মাধ্যমে ফিশারিজ স্নাতকদের অবদান রাখার সুযোগ সৃষ্টি করার অনুরোধ করছি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও দপ্তরকে।

তপতী বর্মন তিথি (মাৎস্যবিজ্ঞান অনুষদ, হাবিপ্রবি): আমরা মাৎস্যবিজ্ঞানে অনার্স, মাস্টার্স করার পরেও নিজেদের সেক্টরের চাকুরির আশা রাখতে পারি না। প্রাইভেট সেক্টরে আমাদের অংশগ্রহণের সুযোগ নাই বললেই চলে। আবার সরকারি, আধা-সরকারি প্রতিষ্ঠানে আসন সংখ্যা খুবই সীমিত। পিএসসি নন ক্যাডার ভুক্ত চাকরিতেও আমাদের আবেদনের সুযোগ দেওয়া হয়নি। প্রতিবছর মাৎস্যবিজ্ঞান থেকে স্নাতক অর্জনকারী শিক্ষার্থীদের প্রায় ৪০ শতাংশ শিক্ষার্থী আমরা মেয়েরা। দেশের বর্তমান চাকরির অবস্থা অনুসারে আমরা ধরে নেই, সাবজেক্ট রিলেটেড চাকুরি আমাদের হবে না। অর্জিত জ্ঞানের প্রয়োগই আমরা ঘটাতে পারিনা যা অত্যন্ত দুঃখজনক।

হাসান মাহমুদ নূর, (বিএসসি এ্যান্ড এমএসসি ইন ফিশারিজ,  যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়): বাংলাদেশে মৎস্য সেক্টরে আজকে যে অভাবনীয়  সাফল্য এসেছে, সেই সাফল্যের সবচেয়ে বড় দাবিদার মৎস্য বিজ্ঞানে পড়াশোনা করা গ্রাজুয়েটরা। দেশের ১৭ টি বিশ্ববিদ্যালয়ে মৎস্য বিজ্ঞানের উপর স্নাতক ও স্নাতকোত্তর কোর্স চালু আছে যেখানে প্রায় ১৬০-১৭০ ক্রেডিট মৎস্যের উপরই পড়ানো হয় এবং প্রতি বছর প্রায় ১৪০০ ছাত্র ছাত্রী বের হোন। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয়, হাতে গোনা কয়েকটি মৎস্য ক্যাডার সার্ভিসের পোস্ট ব্যতিত, সংশ্লিষ্ট সেক্টরে চাকরির সুযোগ একদম নেই বললেই চলে। এমতাবস্থায় অতি সম্প্রতি মৎস্য অধিদপ্তরের অধীনে ১০ তম গ্রেডের ২০১ টা পোস্টে চাকরির নিয়োগ বিজ্ঞাপ্তি প্রকাশিত হয়।

আশ্চর্যের বিষয় হলো, সরাসরি মৎস্য সম্পর্কিত পোস্টে নিয়োগ হলেও নিয়োগ বিধিমালার দোহাই দিয়ে সেখানে মৎস্য গ্রাজুয়েটদের আবেদন করার কোন সুযোগই রাখা হয়নি যেটা অত্যন্ত দুঃখজনক ও বেদনাদায়ক। সরকারি চাকরির এমন প্রতিযোগিতাপূর্ন বাজারে নিজ সেক্টরেই যদি মৎস্য গ্রাজুয়েটরা কাজ করার সুযোগ না পান, তাহলে সাফল্যের শীর্ষে উঠা মৎস্য সেক্টরের উন্নয়নে নিশ্চিতভাবে বাঁধা পড়বে। সব দিক বিবেচনা করে, সংশ্লিষ্ট সকল দপ্তরের কাছে আমাদের নিবেদন থাকবে, মৎস্য সেক্টরে মৎস্য গ্রাজুয়েটদের কাজ করার সুযোগ দিন এবং চলমান নিয়োগে প্রকৃত মৎস্য বিজ্ঞানের উপর উচ্চতর ডিগ্রি নেওয়া ছাত্র ছাত্রীদের আবেদনের সুযোগ দিয়ে এই সেক্টরকে বাঁচিয়ে রাখুন।

রাকিবুল ইসলাম রাকিব (শিক্ষার্থী, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়): বাংলাদেশ বর্তমানে মাছ উৎপাদনে সারপ্লাস।  দেশের জনগণের চাহিদা মিটিয়ে বর্তমানে মাছ বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করা হচ্ছে। বাংলাদেশ এখন মাছ উৎপাদনে বিশ্বের রোল মডেল। দক্ষ ফিশারিজ স্নাতকদের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলেই এই অভূতপূর্ব অর্জন সম্ভব হয়েছে। যদি এমন অবস্থায় মৎস্য সেক্টরের চাকরিতে মৎস্য স্নাতকদের বঞ্চিত করা হয় তাহলে তা হবে মৎস্য স্নাতকদের ন্যায্য অধিকারে আঘাত। যা পরবর্তীতে দেশের অর্থনীতিতে চরমভাবে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। তাই দেশের অর্থনীতি ও দেশের জনগণের জীবন জীবিকার চাকা সচল রাখতে মৎস্য স্নাতকদের ন্যায্য অধিকার দিতে হবে।

পূজা রাণি সাহা শিক্ষার্থী (মৎস্য বিজ্ঞান বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়): মাৎস্যবিজ্ঞানের স্নাতকরা নিজস্ব সেক্টরে চাকুরী ক্ষেত্রে বরাবরেই অবহেলিত। স্বল্পসংখ্যক সার্কুলার, সীমিত পদ সংখ্যা যেন নিয়মিত ব্যাপার। পিএসসির বর্তমান সার্কুলারে দেখছি মৎস্যবিজ্ঞান স্নাতকদের চাকরির আবেদনের সুযোগ রাখা হয়নি। স্নাতকদের এমন অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে মেয়ে মৎস্যস্নাতকদের অবস্থা আরও করুণ। পাবলিক ভার্সিটি ফিসারিজে পরে যতটা গর্ববোধ করি, ঠিক ততটাই হতাশ হই চাকুরির ক্ষেত্র দেখে। প্রাইভেট জবে নারীদের অংশগ্রহনের সুযোগ রাখার পাশাপাশি মৎস্য স্নাতকদের নিজস্ব সেক্টরে নিয়োগবৃদ্ধি এখন সময়ের দাবি।