ভূট্টায় বিধ্বংসী "ফল আর্মিওয়ার্ম" দমন ব্যবস্থাপনা

সমীরণ বিশ্বাস: আমাদের দেশে পোল্ট্রি শিল্পে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হয় ভুট্টা। পোল্ট্রি ফিডে চাহিদার সিংহভাগ আমদানি করতে হয় অথচ আমরা আমাদের দেশে উৎপাদন বৃদ্ধি করা গেলে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় করার সুযোগ রয়েছে। এচি এখন অন্যতম একটি অর্থকরী কৃষিপণ্য। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর এ ব্যাপারে যথেষ্ট উদ্যোগী কৃষকরাও উচ্চমূল্য পাওয়ার কারণে এর চাষের পরিধি বাড়াচ্ছে। তবে বর্তমান সময়ে "ফল আর্মিওয়ার্ম" নামের এই পোকাটি ভুট্টা চাষীদের কাছে আতঙ্ক হয়ে দাঁড়িয়েছে। কাজেই এ পোরকার বিস্তারিত সম্পর্কে কৃষকদের জানা এমন জরুরী তেমনি কৃষি কর্মকর্তাদের মাঠ পর্যায়ে গিয়ে পরামর্শ দেওয়া প্রয়োজন।

ফল আর্মিওয়ার্ম হলো Lepidoptera order (Bangla) এর একটি ক্ষতিকর কাটুই পোকা যার বৈজ্ঞানিক নাম Spodopterafrugiperda (bangla)। এই পোকার সংক্রমন সবথেকে বেশি দেখা যায় আমেরিকা মহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। সম্প্রতি ভারতের কর্নাটক এবং তামিলনাড়ু রাজ্যে এই পোকার আক্রমনে ব্যাপক ফসলহানির সম্ভাবনা রয়েছে। বিশ্বব্যাপী ভুট্টার একটি মারাত্মক ক্ষতিকর ও বিধ্বংসী পোকা হলো ফল আর্মিওয়ার্ম বা সাধারণ কাটুই পোকা অত্যন্ত ক্ষতিকর, বিকল্প পোষকের উপস্থিতি এবং সেই সাথে দমন ব্যবস্থাপনা কঠিন হলেই কেবল একটি পোকা মারাত্মক ক্ষতিকর বা মুখ্য ক্ষতিকর পোকা হয়ে উঠে। এ তিন বৈশিষ্ট্যের প্রতিটিই রয়েছে এ পোকার মধ্যে। এটি মূলত আমেরিকা মহাদেশের পোকা হলেও ২০১৬ সালে আফ্রিকা এবং ২০১৮ সালে দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে বিশেষত ভারত, শ্রীলঙ্কায় এ পোকার আক্রমণ দেখা দেয়। উদ্বেগের বিষয় হলো ২০১৮ সালের নভেম্বর মাসে স্থাপনকৃত ফেরোমোন ফাঁদে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের উত্তর ও পশ্চিমাঞ্চলের জেলাসমূহে এ পোকার উপস্থিতি দেখা যায়। তবে বর্তমানে বাংলাদেশে ভুট্টা উৎপাদনকারী প্রায় সব জেলাতেই এ পোকার উপস্থিতি লক্ষ করা যাচ্ছে।

পোকা চেনার উপায়ঃ
•  দেহের উপরিভাগে দুই পাশে লম্বালম্বিভাবে গাঢ় রঙের দাগ রয়েছে।
• মাথায় উল্টা Y অক্ষরের মধ্যে জালের মতো দাগ রয়েছে।
• পোকাটির পৃষ্ঠ দেশের ৮ম খণ্ডে ৪ টি কালো দাগ রয়েছে।

ক্ষতির ধরণঃ
• পোকাটি কীড়া অবস্থায় গাছের পাতা ও ফল খেয়ে থাকে।
• পূর্নাঙ্গ পোকা ফসলের ব্যাপক ক্ষতি করে থাকে।

জৈব ব্যবস্থাপনা
১. প্রাথমিক অবস্থায় পোকাটির অবস্থান শনাক্ত করা এবং সেই সাথে তাদের নিয়ন্ত্রণ করার জন্য ফল আর্মিওয়ার্ম পোকার ফেরোমন ফাঁদ ব্যবহার করতে হবে। এক্ষেত্রে ভুট্টা বা অন্যান্য পোষক ফসলের জমিতে বিঘাপ্রতি ৫-৬টি ফাঁদ পাততে হবে। সেইসাথে সার্বক্ষণিক পরিদর্শন করতে হবে।
২. ক্ষতিকর-রাক্ষুসে এ পোকাকে নিয়ন্ত্রণ করতে প্রথমত ভুট্টা লাগানোর সময়  বীজ শোধন করতে হবে।
৩. গাছের দুই-তিন পাতা অবস্থা হতেই আক্রান্ত গাছ হতে ডিম বা সদ্য ফোটা দলাবদ্ধ কীড়া সংগ্রহ করে পিষে মেরে ফেলতে হবে অথবা এক ফুট গর্ত করে মাটিতে পুঁতে ফেলতে হবে।
৪. এছাড়া হাত বাছাই ভুট্টার মোচা আসা পর্যন্ত চালিয়ে যেতে হবে। সার্বক্ষণিক ফসলের মাঠ পরিদর্শন করা এবং লক্ষণ অনুসারে পোকাটি সনাক্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া।
৫. আক্রান্ত গাছ ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকায় (৯০-১০০ ফুট এলাকা জুড়ে) অতিদ্রুত জৈব বালাইনাশক স্পোডোপটেরা নিউক্লিয়ার পলিহাইড্রোসিস ভাইরাস (এসএনপিভি) এক লিটার পানিতে ০.২ গ্রাম হারে মিশিয়ে আক্রান্ত গাছ ভালোভাবে ভিজিয়ে স্প্রে করতে হবে। এভাবে ৭ দিন পর পর ২ থেকে ৩ বার জৈব বালাইনাশক এসএনপিভি স্প্রে করতে হবে।
৬. সম্ভব হলে  উপকারী পোকা ব্রাকন হেবিটর  আক্রান্ত এলাকায় ছেড়ে দিতে হবে। এরা ফল আর্মিওয়ার্মের কীড়ার গায়ে ডিম পাড়ে। ফলে ঐ কীড়াগুলো ভুট্টার ক্ষতি করতে পারে না।
৭. পরবর্তী ফসলে ভুট্টা বা অন্যান্য পোষক ফসল চাষ না করে ধান চাষ করলে এ পোকার আক্রমণ কমে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
৮. আফ্রিকাতে স্থানীয় প্রযুক্তি হিসেবে আক্রান্ত ভুট্টা গাছের গোড়ার মাটি বা ছাই ও মরিচ বাটা বা গুঁড়া পানিতে মিশিয়ে কাদা বানিয়ে বদনা বা মগ দিয়ে খোলে বা পাতার ফাঁকে ফাঁকে ঢুকিয়ে দেয়া হয়। ৩-৪ দিনের মধ্যেই কীড়াগুলো মারা যায়। তবে এ বিষয়ে বিস্তর গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে।

রাসায়নিক ব্যবস্থাপনা
যদিও এ পোকা দমনে রাসায়নিক কীটনাশক তেমন কার্যকর নয়। তবে একান্ত প্রয়োজনে জেনেজয়েট ৫ ডব্লিউডিজি বা জেনেথ্রিন ১০ ইসি নিয়ম মত ব্যবহার করতে হবে।
লেখক: সমীরন বিশ্বাস, লিড-এগ্রিকালচারিস্ট, মদিনা টেক লিমিটেড, ঢাকা।