সাশ্রয়ীমূল্যে ডিম, দুধ, মাছ ও মাংসের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে অবিলম্বে সয়াবিন মিল রপ্তানি বন্ধ করুন-ফিআব

এগ্রিলাইফ২৪ ডটকম:সাশ্রয়ী মূল্যে দেশের মানুষের জন্য ডিম, দুধ, মাছ, মাংসের উৎপাদন ও যোগান নিশ্চিত করছে দেশীয় পোল্ট্রি, মৎস্য ও ডেইরি খাত। দেশের ১৭ কোটি মানুষের স্বাস্থ্য ও নিরাপদ পুষ্টি এবং পোল্ট্রি, ডেইরি ও মৎস্যখাতের সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত প্রায় ২ কোটি মানুষের জীবন ও জীবিকা আসে এসব খাত থেকে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় হাঁস-মুরগি, মৎস্য ও গবাদিপশুর খাদ্য তৈরির অত্যাবশ্যকীয় একটি উপকরণ ‘সয়াবিন মিল’ রপ্তানির অনুমতি প্রদান করায় খামারি ও উদ্যোক্তাদের মাঝে উদ্বেগ-উৎকন্ঠা সেই সাথে অসন্তোষ বিরাজ করছে। অবিলম্বে সয়াবিন মিল রপ্তানি বন্ধে যুক্তিসঙ্গত এবং গ্রহণযোগ্য দাবি মানা না হলে খামারি, উদ্যোক্তা ও সংশ্লিষ্ট সেক্টরগুলোর সবাইকে সাথে নিয়ে আগামীতে বৃহত্তর কর্মসূচী গ্রহণ করা হবে।  

আজ বুধবার (২২ সেপ্টেম্বর) রাজধানীর স্থানীয় একটি হোটেলে আয়োজিত ‘মিট দ্যা প্রেস’ অনুষ্ঠানে উপস্থিত সাংবাদিকদের নিকট এসব কথা তুলে ধরেন ফিড ইন্ডাষ্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশ (ফিআব) নেতৃবৃন্দ। তাদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সয়াবিন মিল বন্ধে কৃষি মন্ত্রণালয় এবং মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের মতামতকে উপেক্ষা করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তে তারা অত্যন্ত মর্মাহত ও দুঃখ প্রকাশ করে বলেন  সয়াবিনের উচ্চমূল্যে দেশের প্রায় ৫০টি ফিডমিল ইতিমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে এবং আরো অনেক বন্ধ হওয়ার পথে।

সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পেশ করেন সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক মো. আহসানুজ্জামান। সময় ফিড ইন্ডাষ্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশ-এর সভাপতি এহতেশাম বি. শাহজাহান, বাংলাদেশ পোল্ট্রি ইন্ডাষ্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিল (বিপিআইসিসি) ও সভাপতি, ওয়ার্ল্ড’স পোল্ট্রি সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশন-বাংলাদেশ শাখা (ওয়াপসা-বিবি)-এর সভাপতি মসিউর রহমান, বাংলাদেশ পোল্ট্রি ইন্ডাষ্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিল (বিপিআইসিসি)-এর সহ-সভাপতি শামসুল আরেফিন খালেদ, ফিআব সদস্য সাইফুল আলম খান এবং আবু লুৎফে ফজলে রহিম খান।

ফিআব নেতৃবৃন্দ বলেন, বাংলাদেশ হতে নেপাল ও ভারতে সয়াবিন মিল রপ্তানি শুরুর সাথে সাথে তারা বাণিজ্য, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ, কৃষি ও খাদ্য মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানসমূহে অবিলম্বে সয়াবিন মিল রপ্তানি বন্ধের জন্য আবেদন জানান। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়, কৃষি মন্ত্রণালয়, খাদ্য মন্ত্রণালয় হতে সয়াবিন মিল রপ্তানি বন্ধের সুস্পষ্ট মতামতসহ বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে চিঠি প্রদান করলেও এগুলোর কোন কিছুই আমলে না নিয়ে একতরফা ভাবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় রপ্তানির সিদ্ধান্তে অনঢ় রয়েছে এবং ভারত ও নেপালে সয়াবিন মিলের রপ্তানি চালু রয়েছে। শুধু তাই নয়, কৃষি সম্প্রসারন অধিদপ্তর সয়াবিন মিল বন্ধের আদেশ প্রদান করলেও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের হস্তক্ষেপের কারণে তা পুনরায় প্রত্যাহার করা হয়েছে যা অত্যন্ত হতাশাব্যঞ্জক।

সংবাদ সম্মেলনে আরো বলা হয়, বাণিজ্য উন্মুক্ত থাকা সত্ত্বেও নিজের দেশের স্বার্থ, দেশীয় শিল্পের সুরক্ষার স্বার্থে অনেক দেশই আমদানিযোগ্য বিভিন্ন পণ্যের ওপর নানা ধরনের কর ও শুল্ক আরোপ করার মাধ্যমে আমদানি নিরুৎসাহিত করে থাকে অনেক সময় রপ্তানিও বন্ধ করে দেয়। ভারতেও অভ্যন্তরীণ সংকট ও মূল্য বৃদ্ধি হলে চাউল, পেঁয়াজসহ অন্যান্য পণ্যের রপ্তানি বন্ধ করে দেয়া হয়; অথচ আমাদের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় অন্য দেশের শিল্পের স্বার্থে রপ্তানি উন্মুক্ত করে দিয়ে কার্যত দেশীয় ডিম, দুধ, মাছ, মাংস ও ফিড উৎপাদনকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিচ্ছে।

ফিআব নেতৃবৃন্দ বলেন, দেশের ফিড মিলগুলোতে ব্যবহৃত কাঁচামালের অধিকাংশই বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করতে হয়। বর্তমানে চাহিদাকৃত ‘সয়াবিন মিল’ দেশীয় সয়াবিন তৈল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো ছাড়াও ভারত, আমেরিকা, ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা প্রভৃতি দেশ থেকে আমদানি করা হয়ে থাকে। আমাদের দেশে ‘সয়াবিন মিল’ এর মোট চাহিদা বছরে প্রায় ১৮-২০ লক্ষ মেট্রিক টন। এর মধ্যে ৭৫-৮০ ভাগ দেশীয় সয়াবিন তৈল উৎপাদকারি প্রতিষ্ঠান হতে এবং অবশিষ্ট ২০-২৫ ভাগ আমদানির মাধ্যমে সংগ্রহ করা হয়। দেশের মানুষের পুষ্টি চাহিদা পূরণের কথা বিবেচনায় নিয়ে সাশ্রয়ীমূল্যে সয়াবিন তৈল, পোল্ট্রি, মৎস্য ও গরুর খাদ্যের প্রধান উপাদান সয়াবিন মিলের সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য সরকার শূণ্য শুল্কে বা করমুক্ত সুবিধায় ‘সয়াবিন সীড’ আমদানির অনুমতি প্রদান করেছেন। ‘সয়াবিন সীড’ থেকে সয়াবিন তৈল বের করার পর অবশিষ্ট খৈল থেকে তৈরি হয় ‘সয়াবিন মিল’ যার প্রধান ক্রেতা এদেশের ফিড ইন্ডাষ্ট্রিগুলো। তবে দু:খজনক গলেও সত্য দেশের মানুষের স্বার্থে শূণ্য শুল্ক সুবিধায় আনা সেই সয়াবিন সীড থেকে উৎপাদিত সয়াবিন মিলই এখন ৩-৪টি সয়াবিন তৈল উৎপাদনকারি প্রতিষ্ঠান অতিরিক্ত মুনাফার স্বার্থে রপ্তানি হচ্ছে। অতীতে কখনও ভারতে সয়াবিন সীড কিংবা সয়াবিন মিল রপ্তানি হয়নি বরং ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রায় প্রতি বছর উল্লেখযোগ্য পরিমান সয়াবিন মিল আমদানি করা হয়ে থাকে। অতীতে চাহিদা মেটাতে সিংহভাগ সয়াবিন মিল বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করা হলেও এলসি করা, অতিরিক্ত জাহাজ ভাড়া, চট্টগ্রাম বন্দরে পণ্য খালাসে জটিলতা, ল্যাব টেস্টের জটিলতা, বিলম্ব মাশুল, ইত্যাদি নানাবিধ জটিলতার কারণে সয়াবিন মিল আমদানির পরিমান সাম্প্রতিক বছরগুলো ক্রমান্বয়ে  হ্রাস পেয়েছে।

সংবাদ সম্মেলনে আরো উলেলখ করা হয়, বর্তমানে ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা থেকে সয়াবিন মিল আমদানি করতে হলে এলসি করা থেকে শুরু করে বন্দরে মাল এসে পৌঁছানো পর্যন্ত সময় লাগে প্রায় ৫০ দিন। যুক্তরাষ্ট্র থেকে সময় লাগে ৭০ দিন। ভারত থেকে সড়কে ৭-১০ দিন, কনটেইনারে ১৫-২০ দিন। বিশ্ববাজারে এবং সেই সাথে পাশ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারতে সয়াবিন মিলের দাম বেড়ে যাওয়ায় সে দেশের পোল্ট্রি, ডেইরি ও মৎস শিল্প রক্ষা করতে এবং স্বল্পতম সময়ে বাংলাদেশ থেকে সয়াবিন মিল আমদানির জন্য আগ্রহ বেড়েছে ভারত, নেপাল প্রভৃতি দেশের ফিড প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর। আমাদের উদ্বৃত্ত থাকলে রপ্তানি করতে কোন অসুবিধাই ছিলনা কিন্তু দেশের চাহিদা যখন দেশীয়ভাবে পূরণ করা যাচ্ছে না; তখন রপ্তানির সিদ্ধান্ত কেন এমন প্রশ্ন তুলে ধরেন ফিআব নেতৃবৃন্দ?

ফিআব নেতৃবৃন্দ আশা করেন  ঢাকাসহ সারাদেশের সংবাদপত্র, অনলাইন, টিভি, রেডিওসহ সব ধরনের গণমাধ্যম এ শিল্প রক্ষায় এগিয়ে আসবেন। জাতীয় প্রয়োজনে আমাদের গণমাধ্যম অতীতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুকে এজেন্ডা হিসেবে গ্রহণ করেছে। সয়াবিন মিল রপ্তানি বন্ধের ইস্যুটিকেও এজেন্ডা হিসেবে গ্রহণ করার জন্য গণমাধ্যমের প্রতি আহবান জানান ফিআব নেতৃবৃন্দ।

দীর্ঘদিন ধরে করোনাকালীন সংকটের মধ্যে রয়েছেন দেশের জনগণ। দেশের চিকিৎসক ও পুষ্টি বিজ্ঞানীরা এ সময় অধিক পরিমানে মাছ, মাংস, দুধ ও ডিম গ্রহণের পরামর্শ প্রদান করছেন। খামারিদের সাথে নিয়ে এ শিল্পকে বাঁচিয়ে রেখে দেশের মানুষের প্রোটিনের চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে সরকারকে সার্বিকভাবে সহযোগিতা করে যাচ্ছে দেশের এ খাতের উদ্যোক্তারা। বর্তমানে কর্মসংস্থান সংকুচিত হওয়ায় সাধারন মানুষের ক্রয় সক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে। এমতাবস্থায় সাশ্রয়ীমূল্যের প্রাণিজ আমিষের মূল্যবৃদ্ধি হলে ‘খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা’ উভয়ই হুমকীর মুখে পড়বে বলে মনে করেন দেশের খামারী ও ভোক্তারা।