টাঙ্গাইলে এক জমিতে একাধিক ফসল চাষ করে সফল তরুণ কৃষিবিদ শাকিল

কে এস রহমান শফি, টাঙ্গাইল: টাঙ্গাইলের দেলদুয়ারে এক জমিতে শসা, বিদেশী জাতের ব্লাকবেরী তরমুজ ও বাঙ্গি চাষ করে সফল হয়েছেন তরুণ কৃষিবিদ শাকিল আহমেদ। ফলন ভাল হওয়ায় এলাকায় সাড়া ফেলেছে। এই সফলতা দেখতে আশেপাশের কৃষকরাও তার কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে আধুনিক প্রদ্ধতিতে সবজি চাষ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তিনি উপজেলার আতিয়া ইউনিয়নের গোমজানি গ্রামের আব্দুল করিমের ছেলে।

শাকিল আহমেদ জানান, ২০২০ সালে নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (নোবিপ্রবি) কৃষি বিভাগ থেকে বিএসসি শেষ করেন। প্রথম লকডাউনের কারণে পরিবারের সঞ্চয় করা অর্থ তখন প্রায় শেষের দিকে। পরিবারে অর্থনৈতিক মন্দা, টানাপড়েন। ভাবলেন বসে না থেকে কিছু একটা করা উচিত। লকডাউন শিথিলের পর বেসরকারি চাকরির জন্য আবেদন করা শুরু করেন। বেতন, কাজের চাপ এবং সময় সম্পর্কে জানার পর ভাবলেন বিএসসি শেষ করে চাকরিতে প্রবেশ করে ভালো বেতন আশা করা অবাস্তব। এরপর চাকরির চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে নিজ সাবজেক্ট সম্পর্কিত কিছু করার মনস্থির করেন, যেখানে তিনি নিজে কাজ করবেন এবং অন্তত দুজন লোক তার সঙ্গে কাজ করে উপকৃত হবে।

বসতবাড়িতে সবজি চাষ এবং পারিবারিক পুষ্টি চাহিদার প্রজক্ট নিয়ে বাসায় কাজ করে সাফল্যের দেখা পেয়েছেন শাকিল। ইউটিউবে কৃষি সমাচার চ্যানেলের ভিডিও থেকে স্কোয়াশ, শসা, তরমুজ ও বাঙ্গি চাষ সম্পর্কে ধারণা নিয়ে শাকিল তার বাবাকে জানান। বাবার আশ্বাস পেয়ে চিন্তা করেন ভিন্ন উপায়ে চাষাবাদ করার। কম পরিশ্রমে অধিক ফলনের লক্ষ্যে ভারত থেকে আনা উন্নত প্রযুক্তির আধুনিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ করেন তিনি। ফলে জমিতে অতিরিক্ত কোনো শ্রমিকের প্রয়োজন পড়েনি। প্রথমে তিনি স্কোয়াশ চাষ করে সফল হয়েছেন। এরপর তিনি শসা, তরমুজ ও বাঙ্গি চাষ করছেন।

প্রথমে তিনি ৪৫ শতাংশ জায়গার মধ্যে ২৩ শতাংশ জায়গায় ১২০০ শসা গাছ লাগিয়েছেন তিনি। ১৫ শতাংশ জায়গায় তরমুজ বাকি জায়গায় তিনি বাঙ্গি চাষ করেছেন। এই প্রজেক্টে তার ১৮ হাজার টাকা খরচ হলেও ইতিমধ্যে তিনি গত ১৪ দিনে প্রায় ৫০ হাজার টাকা শসা বিক্রি করেছেন। এ ছাড়াও প্রতিদিন সাড়ে তিন থেকে চার হাজার টাকা শসা বিক্রি হচ্ছে। আগামী সপ্তাহের মধ্যে বাঙ্গি ও ঈদের আগের সপ্তাহে তরমুজ তুলে বাজারে বিক্রি করবেন। এ ছাড়াও চারিদিকে নেট দিয়ে বেড়া দিয়ে করোলা ও ধুন্দুলের চাষ করেছেন। বেডের ফাঁকা জায়গার মধ্যে লাল শাক ও ডাটা চাষ করেও পাঁচ হাজার টাকা বিক্রি করেছেন। তার এই চাষ দেখতে নিজ গ্রামসহ আশে পাশের গ্রাম থেকে মানুষ দেখতে আসে। পোকা দমনের জন্য সেক্স ফেরোমন ফাঁদ ব্যবহার করা হচ্ছে।

শাকিল আহমেদ জানান, করোনায় গ্রামে যার যার বাড়িতে ফাঁকা জমি ছিল সবাইকে সবজি চাষে উদ্বুদ্ধ করেছেন তিনি এবং নিজ থেকে বীজ এবং পরামর্শ  দিয়েছেন। তার গ্রামে সবসময় সবাই এক ফসল করতেন এর আগে। ধান চাষাবাদ ছাড়া তারা অন্যকিছু করেননি। স্থানীয় কৃষকদের বুঝিয়ে কয়েকটি উঠান বৈঠক করে আলু এবং ভুট্টা চাষে উদ্ধুদ্ধ করেছেন তিনি। শসা, তরমুজ ও বাঙ্গি  প্রজেক্ট দেখে গ্রামের বেশ কয়েকজন কৃষক স্কোয়াশ চাষে আগ্রহী হয়েছেন। কৃষককে উন্নত কৃষি ব্যবস্থায় আগ্রহী করতে ধানের জন্য লাইন, লোগো,পার্চিং (এলএলপি) পদ্ধতি সম্পর্কে পরামর্শ প্রদান করেছেন।

ওই গ্রামের জাহিদুর রহমান, শহর আলী ও সেলিম আহমেদ বলেন, ‘আগে আমাদের গ্রামে শুধু ধান চাষ করা হতো। আগে কখনও তরমুজ চাষ করা হয়নি। সবজি চাষের কোন চিন্তা ছিলো না। শাকিলের আধুনিক পদ্ধতিতে চাষ দেখে প্রথমে পরিহাস করলেও এখন তার সফলতা দেখে আমরা গর্বিত। আমরা তার কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে তার মতো চাষ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তার চাষ পদ্ধতি দেখতে অনেক দূর থেকে লোক আসে।’

গ্রামীণ কৃষি নিয়ে বিস্তৃত পরিসরে কাজ করার স্বপ্ন শাকিলের। তিনি বলেন, বসতি জমি বাড়ছে। তবে কৃষি জমি দিন দিন কমছে। কৃষি নিয়ে বিশেষ করে গ্রামীণ কৃষি নিয়ে বড় পরিসরে কাজ করার ইচ্ছে আমার। আমি এবং তিন-চারজন বন্ধু মিলে এই কাজটি করতে চাই। কিভাবে কম খরচে অধিক ফসল উৎপাদন করা যায় তা নিয়ে কাজ করার পাশাপাশি দালাল, ফড়িয়াদের দৌরাত্ম্য কমিয়ে উৎপাদিত পণ্য সরাসরি ভোক্তাদের নিকট কিভাবে বিপণন করা সেটা নিয়েও কাজ করব। আগামী বন্যার আগে আরেকবার সবজি চাষ করা হবে। বন্যায় কুচুরি পানার উপর সবজি চাষ করার পরিকল্পনাও রয়েছে।

শাকিলের বাবা আব্দুল করিম বলেন, ‘তার প্রজেক্ট আমিও সহযোগিতা করি। তার ফলন দেখে আমি মুগ্ধ। আমি তার আরো সফলতা কামনা করছি।’

দেলদুয়ার উপজেলা কৃষি অফিসার মো. শোয়েব মাহমুদ বলেন, ‘এক জমিতে একাধিক ফসল চাষ করে তিনি সাড়া ফেলেছে। ফলনও বেশ ভাল হয়েছে। আমি আশা করি এলাকার যারা তরুণ রয়েছে শাকিলের দেখাদেখি কৃষি কাজে তারাও উদ্ধুদ্ধ হবেন। উপজেলা কৃষি অফিস থেকে তাদের পরামর্শ ও সহযোগিতা করা হচ্ছে। শাকিল এলাকায় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।’