
সমীরণ বিশ্বাস: অপরাজিতা দুর্গা: শক্তি, সংস্কৃতি ও কৃষির রক্ষাকর্ত্রী। বাংলা সংস্কৃতির গভীরে প্রোথিত এক অনন্য প্রতীক হলেন দেবী দুর্গা। তিনি শুধু একটি ধর্মীয় চরিত্র নন, বরং এক সাংস্কৃতিক শক্তি, এক সংগ্রামী চেতনার প্রতিমূর্তি। তাঁর নামের মধ্যেই নিহিত রয়েছে সংকট থেকে মুক্তির বার্তা, ‘দুর্গা’ অর্থ ‘যিনি দুর্গতি থেকে রক্ষা করেন’। পৌরাণিক কাহিনিতে তিনি দুর্গম নামক অসুরকে বধ করে মানবজাতিকে রক্ষা করেছেন, আর সেই থেকেই তিনি হয়ে উঠেছেন অপরাজিতা, অজেয়, অদম্য এক নারীর প্রতীক।
দেবী দুর্গার পৌরাণিক পরিচয় ও রূপবৈচিত্র্য:
দেবী দুর্গার পরিচয় বহুমাত্রিক। তিনি চণ্ডিকা, অম্বিকা, যোগমায়া, বৈষ্ণবী, মহামায়া, কাত্যায়নী, মহিষাসুর সংহারিণী নারায়ণী ইত্যাদি নামে পূজিতা হন। তাঁর দশভুজা রূপটি সবচেয়ে জনপ্রিয়, যেখানে প্রতিটি হাতে রয়েছে একেকটি অস্ত্র, প্রতীক শক্তি, সাহস, জ্ঞান ও রক্ষা। তাঁর বাহন সিংহ (কখনো বাঘ) এবং মহিষাসুর বধের দৃশ্য তাঁর যুদ্ধজয়ী রূপকে তুলে ধরে। এই রূপে তিনি শুধু অসুরনাশিনী নন, বরং মানবসমাজের প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে সংগ্রামের প্রতীক।
ধর্মীয় ব্যাখ্যায় দুর্গা:
হিন্দু ধর্মে দুর্গা পরমা প্রকৃতি, সৃষ্টির আদি শক্তি। তিনি শিবের স্ত্রী পার্বতী, কার্তিক ও গণেশের জননী এবং কালীর এক রূপ। শাক্ত ধর্মে তিনি সর্বোচ্চ আরাধ্য দেবী, বৈষ্ণব ধর্মে তাঁকে বিষ্ণুর অনন্ত মায়া হিসেবে দেখা হয়, আর শৈব ধর্মে তিনি শিবের অর্ধাঙ্গিনী। পুরাণে যেমন মার্কণ্ডেয়, দেবী, কালিকা ও মৎস্যপুরাণে তাঁর বর্ণনা পাওয়া যায়, তেমনি মহাভারতের বিরাট পর্বেও তাঁর উল্লেখ রয়েছে। কেনোপনিষদে হৈমাবতীকে দুর্গা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, আর ভাগবতে শ্রীকৃষ্ণের যোগমায়াকে দুর্গা বলা হয়েছে।
বাংলার মঙ্গলকাব্যে ও আগমনী গানে দুর্গা:
বাংলা সাহিত্যে দুর্গার উপস্থিতি এক আবেগঘন সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞতা। মঙ্গলকাব্য ও আগমনী গানে তিনি শিবজায়া পার্বতী রূপে পিতৃগৃহে আগমনের আনন্দময় দিনগুলোতে সপরিবারে অবস্থান করেন। এই বর্ণনায় দুর্গা হয়ে ওঠেন এক আদর্শ নারী, এক মমতাময়ী মা, এক কন্যা, যার আগমন ঘিরে বাংলার ঘরে ঘরে উৎসবের আবহ। এই উৎসব শুধু ধর্মীয় নয়, বরং পারিবারিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মিলনের প্রতীক।
দুর্গোৎসবের ইতিহাস ও ভৌগোলিক বিস্তার:
বাংলায় দুর্গোৎসবের সূচনা সম্ভবত দ্বাদশ-ত্রয়োদশ শতাব্দীতে। জনশ্রুতি অনুসারে রাজশাহীর তাহিরপুরের রাজা কংস নারায়ণ প্রথম শারদীয়া দুর্গা পূজার মহা আড়ম্বরের সূচনা করেন। বাংলার পাশাপাশি অসম, উড়িষ্যা, ঝাড়খণ্ড ও বিহারের কিছু অঞ্চলে দুর্গা পূজা প্রচলিত। ভারতের অন্যান্য স্থানে এটি নবরাত্রি উৎসব হিসেবে উদ্যাপিত হয়। বছরে দুবার দুর্গোৎসব পালিত হয়, শারদীয়া (আশ্বিন মাসে) ও বাসন্তী (চৈত্র মাসে)। এই উৎসব শুধু ধর্মীয় নয়, বরং এক সামাজিক ঐক্যের উৎস।
দুর্গা: শক্তির প্রতীক:
দেবী দুর্গা মূলত শক্তির প্রতীক। তিনি নারী শক্তির সর্বোচ্চ রূপ, যিনি অসুর শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে মানবজাতিকে রক্ষা করেন। তাঁর রূপে রয়েছে সংগ্রাম, সাহস, আত্মবিশ্বাস ও সৃজনশীলতা। এই শক্তি শুধু ধর্মীয় নয়, বরং সামাজিক ও সাংস্কৃতিক। নারীর ক্ষমতায়ন, মাতৃত্বের মর্যাদা এবং নারীর সৃজনশীল ভূমিকার প্রতীক হিসেবে দুর্গা আজও প্রাসঙ্গিক।
কৃষি ও দুর্গার সম্পর্ক:
বাংলার কৃষিজীবনের সঙ্গে দুর্গার সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়। শরৎকালে যখন ধান গাছে শিষ ধরে, মাঠে সোনালি সম্ভাবনার আভা ছড়িয়ে পড়ে, তখনই দুর্গা পূজা অনুষ্ঠিত হয়। এই সময়টি প্রকৃতির উর্বরতা ও সৃষ্টির প্রতীক। কৃষক যেমন খরা, বন্যা, কীটপতঙ্গ ও সামাজিক শোষণের সঙ্গে লড়াই করেন, তেমনি দুর্গা লড়াই করেন অসুর শক্তির সঙ্গে। এই মিলন দুর্গাকে কৃষকের সংগ্রামের অনুপ্রেরণা করে তোলে।
দুর্গা পূজা: এক সাংস্কৃতিক শক্তি:
দুর্গা পূজা শুধু ধর্মীয় উৎসব নয়, বরং এক সাংস্কৃতিক শক্তি। উৎসবকালে গ্রামীণ সমাজে সমবেত শ্রম ও আনন্দের পরিবেশ সৃষ্টি হয়, যা কৃষকদের মানসিক শক্তি জোগায়। নারীর শক্তি, মায়ের ক্ষমতা ও প্রকৃতির সৃজনশীলতাকে দুর্গারূপে দেখা হয়। এতে বোঝা যায়, কৃষি কেবল অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড নয়, বরং সংস্কৃতি, বিশ্বাস ও সামাজিক ঐক্যের অংশ।
আধুনিক কৃষি ও দুর্গার প্রতীকী গুরুত্ব:
আজকের দিনে জলবায়ু পরিবর্তন, কৃষি সংকট ও প্রযুক্তির চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড়িয়ে কৃষি আবারো সংগ্রামের জায়গায় এসে পৌঁছেছে। এই প্রেক্ষাপটে দুর্গার প্রতীকী শক্তি আমাদের মনে করিয়ে দেয়, কৃষির প্রতিটি বাধা জয় করা সম্ভব সম্মিলিত চেষ্টায়। দুর্গা হয়ে ওঠেন এক সাংস্কৃতিক রক্ষাকর্ত্রী, যিনি কৃষিকে শুধু জীবিকা নয়, বরং জীবনের উৎস হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন।
অপরাজিতা দুর্গা শুধু একটি পৌরাণিক চরিত্র নন, তিনি বাংলার সংস্কৃতি, কৃষি, সমাজ ও নারীত্বের এক প্রতীক। তাঁর রূপে আমরা দেখি সংগ্রাম, সৃজন, শক্তি ও ঐক্যের প্রতিচ্ছবি। তিনি আমাদের শেখান, সংকটের মুখে দাঁড়িয়ে কীভাবে সম্মিলিতভাবে জয়ী হওয়া যায়। তাই দুর্গা পূজা শুধু পূজা নয়, এটি এক সাংস্কৃতিক আন্দোলন, এক আত্মিক শক্তির উৎস, যা বাংলার মাটি, মানুষ ও মননের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত।
লেখক: সমীরণ বিশ্বাস, কৃষি ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ , ঢাকা।
























