‘পারিবারিক বিনোদন, পুষ্টি চাহিদা পূরণ, এবং অবসর কাটানোর এক মিলনমেলা ছাদ বাগান’

মো. আব্দুর রউফ:ছাদে বা বারান্দায় বাগান কোনো নতুন ধারণা নয়। অতি প্রাচীন সভ্যতায়ও ছাদে বা বারান্দায় বাগানের ইতিহাস চোখে পড়ে। এই ইট কাঠের নাগরিক সভ্যতার শহরগুলো থেকে খুব দ্রুতই হারিয়ে যাচ্ছে সবুজ। গাছপালা কমে যাওয়ায় পরিবেশের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়ে মানুষের জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। অধিকাংশ শহরের প্রায় ৬০ শতাংশ পরিমাণ জায়গা দখল করে আছে ফাঁকা ছাদ, যা তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে বেশ সহায়ক। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন এসব ছাদে সুষ্ঠভাবে বাগান করা হলে তাপমাত্রা অনেকাংশেই কমানো সম্ভব।

শৌখিন মানুষরা তাদের ঘরবাড়িতে সবুজকে ধরে রাখার জন্য একান্ত নিজস্ব ভাবনা আর প্রচেষ্টায় নিজ নিজ বাড়ির ছাদে তৈরি করেছে ছাদ বাগান। সময়ের সাথে এ বাগান এখন আর শৌখিনতায় আটকে নেই। নিরাপদ সবজি দিয়ে পারিবারিক পুষ্টি চাহিদা পূরণ, পারিবারিক বিনোদন এবং অবসর কাটানোর এক মিলনমেলায় পরিণত হয়েছে এ ছাদ বাগানগুলো। ছাদ বাগানগুলোতে বাণিজ্যিক ভাবে উৎপাদন শুরু না হলেও ধীরে ধীরে পারিবারিক পুষ্টি চাহিদা পূরণে ছাদ বাগান গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।

আমাদের দেশে প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ নয় বরং একান্ত ব্যক্তিগত উদ্যোগেই ছাদ বাগানের সূচনা। তবে পরিকল্পিত ছাদ বাগান করতে হবে কারণ অপরিকল্পিত ছাদ বাগান কেবল সময় ও অর্থ অপচয় করে না, সেই সাথে ভবনেরও নানা ক্ষতি করে। ছাদ বাগান করার জন্য প্রয়োজন টব, বড় বড় ড্রাম কিংবা ট্রে। কেউ কেউ আবার ছাদে স্থায়ী কাঠামো নির্মাণ করে তাতে রোপন করেন নানা ফুল, ফল ও সবজি। অনেক সময় বসতবাড়ির অব্যবহৃত বালতি ও বোতলেও ছোটখাটো গাছ রোপণের জন্য ব্যবহার করা যায়। ঠিকমতো উদ্ভাবনী শক্তি দিয়ে এসব অব্যবহৃত জিনিস বাগানে ব্যবহার করা গেলে হতে পারে এক নতুন নান্দনিকতা।

সে লক্ষ্যে আমরা আমাদের বসত বাড়ির আশেপাশে অথবা ছাদে বা ব্যালকনিতে পরিকল্পিত ভাবে শাকসবজি, ফুল, ফল, মসলা প্রভূতি উদ্যান ফসল চাষাবাদ করতে পারি। ছাদ বাগানে শাকসবজি জাতীয় ফসলের মধ্যে লালশাক, পুইশাক, পালংশাক, কলমীশাক, ডাটাশাক, ঢেঁড়স, বেগুন, বরবটি, করলা, ক্যাপসিকাম, টমেটো, লেটুস, লাউ, শিম ইত্যাদি এবং ফল জাতীয় ফসলের মধ্যে আম, লেবু, পেয়ারা, কমলা, মাল্টা, ড্রাগনফল, আনারস, ডালিম ইত্যাদি চাষাবাদ করা যায়। এছাড়াও মসলা ও ভেষজ জাতীয় ফসল যেমন মরিচ, পেঁয়াজ, আদা, রসুন, ধনেপাতা, অ্যালোভেরা, থানকুনি ইত্যাদি এবং ফুল জাতীয় উদ্ভিদ যেমন গোলাপ, গাঁদা, জবা, বেলী, জারবেরা, বাগান বিলাস ইত্যাদি খুব সহজে চাষাবাদ করা সম্ভব।

২ঃ১ অনুপাতে মাটির সাথে জৈব সার মিশিয়ে কয়েক দিন রেখে দিতে হবে। যদি রাসায়নিক সার মেশানোর দরকার হয় তাহলে তা বীজ বা গাছ লাগানোর সময় মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে। মাটির সাথে কিছু কোকোপিট (নারিকেলের ছোবরার গুড়া) মিশালে ভালো হয়। এতে মাটি ভেজা থাকবে তবে স্যাঁতস্যাঁতে হবে না। কোকোপিট পানি ধরে রাখে এতে টবে পানি কম দিলেও হয়। এছাড়াও কোকোপিটে কিছু পুষ্টি উপাদান আছে, যা গাছের বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।

বীজ বা চারা ভালো হতে হবে কারণ ভালো বীজ বা চারায় সঠিক ফলন পাওয়া সম্ভব। গাছ বেশি রোপণ করলে ফলন বেশি, এটি ভুল ধারণা। অল্প জায়গায় বেশি গাছ লাগানো যাবে না। এক সাথে বেশি গাছ লাগালে প্রয়োজনীয় পুষ্টি পায় না। সেক্ষেত্রে একটি টবে বা ড্রামে একটি গাছ লাগাতে হবে এবং প্রয়োজনীয় দূরুত্বে এক টব বা ড্রাম থেকে অন্য টব বা ড্রাম রাখতে হবে এবং টব বা ড্রামের পানি নিষ্কাসনের ব্যবস্থা রাখতে হবে। ছাদ বাগানের টব বা ড্রামে রোপিত গাছ খুটি দিয়ে বেঁধে দিতে হবে। প্রয়োজনমতো গাছে পানি সেচ ও উপরি সার প্রয়োগ করতে হবে। কেচোঁ সার, ট্রাইকোডারমা, কুইক কম্পোস্ট অথবা বাজারে প্রাপ্ত অন্যান্য জৈব সার ব্যবহার করাই উত্তম। প্রতি বছর না হলেও ১ বছর পরপর টব বা ড্রামের পুরনো মাটি পরিবর্তন করে নতুন গোবর মিশ্রিত মাটি দিয়ে পুনরায টব বা ড্রামটি ভরে দিতে হবে। এসময় লক্ষ্য রাখতে হবে গাছ যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয়।

রোগাক্রান্ত ও মরা ডালগুলো সময়মতো ছাটাই করতে হবে। রোগ বালাই দমনে যথাসম্ভব রাসায়নিক কীটনাশক ব্যবহার না করাই উত্তম। জৈবিক পদ্ধতিতে শতভাগ দমন করা যেতে পারে। একান্তই সম্ভব না হলে পরামর্শ মোতাবেক অনুমোদিত মাত্রায় বালাইনাশক ব্যবহার করা যেতে পারে।
ছাদ বাগান জনপ্রিয় করার জন্য বর্তমান সরকার অনেক উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। ইতোমধ্যে ঢাকা সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে ঘোষণা দিয়েছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) আওতাধীন এলাকার ভবনগুলোতে ছাদ বাগান করলে হোল্ডিং কর থেকে ১০ শতাংশ অর্থ সহায়তা দেওয়া হবে। এরকম উদ্যোগ যারা ছাদ বাগান করতে চায় তাদেরকে অনুপ্রানিত করবে। যারা ছাদ বাগান করেন তাদের অধিকাংশই ফেইসবুকে ছোট ছোট গ্রুপ করে নিজেদের মধ্যে বীজ ও গাছ বিনিময় করেন এবং ছাদ বাগান করতে আগ্রহীদের সকল সহায়তা করে থাকেন।

খুব সহজে স্বল্প খরচে বাড়ির ছাদে বা বেলকনিতে বাগান করে তাজা শাকসবজি ও ফুল-ফল পেতে পারি। অবসরসময়ে ছাদ বাগানে কাজ করে ছাদকে সবুজ চত্ত্বর বানানো যায় এবং অবসরসময় কাটানোর জন্য ছাদ বাগান বেশ উপযোগী। বাড়ির পরিবেশ সুশীতল ও শান্তিময় রেখে নগরের পরিবেশ দূষণমুক্ত রাখাসহ জীব বৈচিত্র্য সংরক্ষণে ছাদ বাগান হতে পারে অন্যতম মাধ্যম।

লেখক:বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, উদ্যানতত্ত্ব বিভাগ, বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা)