নওগাঁয় গ্রামীণ ঐতিহ্যবাহী পৌষ পার্বণ মেলা অনুষ্ঠিত

মাহবুবুজ্জামান সেতু: নওগাঁর মান্দায় গ্রামীণ ঐতিহ্যবাহী পৌষ পার্বণ মেলা অনুষ্ঠিত হয়েছে। সোমবার দিনব্যাপী উপজেলার ভালাইন ইউনিয়নের তানইল গ্রামের লিলাবাজার সংলগ্ন আদিবাসী পাড়ার জঞ্জালির মন্ডবে, কালিকাপুর ইউনিয়নের ছোটমুল্লুক গ্রামের জয়বাংলা মোড়ে, প্রসাদপুর ইউনিয়নের গোবিন্দপুর গ্রামে বিনয় বাজারের উত্তর পার্শ্বের বিলের মধ্যে সন্যাস তলা এবং তেঁতুলিয়া ইউনিয়নের গোঁসাইপুর গ্রামে এ মেলা অনুষ্ঠিত হয়। এতে বিভিন্ন রকমের দেশীয় সংস্কৃতি তুলে ধরা হয়।

জয়বাংলা মোড়ের পৌষ পার্বণ মেলা পরিদর্শন করেন ৪৯-নওগাঁ-৪ মান্দা আসনের নব-নির্বাচিত সংসদ সদস্য,জেলা আওয়ামীলীগের সাংস্কৃতি বিষয়ক সম্পাদক ও সাবেক ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ এস.এম ব্রহানী সুলতান মামুদ (গামা)। এসময় মান্দা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোজাম্মেল হক কাজী এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতাকর্মীসহ স্থানীয় গন্যমান্য ব্যাক্তিবর্গ উপস্থিত ছিলেন।

এব্যাপারে ২ নং ভালাইন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান গোলাম মোস্তফা বলেন, গ্রামীণ ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে প্রতিবছর এইদিনে এ মেলার আয়োজন করা হয়ে থাকে। এবারেও করা হয়েছে। আগামীতেও এ ধারা অব্যাহত থাকবে বলে প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন তিনি।

তানইল আদিবাসী পাড়ার গ্রামীণ ঐতিহ্যবাহী মেলাটি স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছে ‘ পুষনার মেলা’ নামেও পরিচিত। মেলাটি বসছে ১০০ বছরের বেশি সময় ধরে। তানইল, চকবাবন,বৈলশিং,মোয়াই,বেজোড়া,বৈদ্যপুর,নিমবাড়িয়া,আয়াপুর, লিপাড়া,তুড়ুকগ্রামসহ আশপাশের বিভিন্ন এলাকা থেকে আগত আবাল,বৃদ্ধ,বণিতা,নারী-পুরুষ এ মেলায় এসে দেশীয় সংস্কৃতি উপভোগ করে থাকেন। মেলাগুলো হিন্দু সম্প্রদায়ের হলেও এসব মেলায় মুসলমানসহ অন্যন্য সম্প্রদায়ের লোকজনের ব্যাপক উপস্থিতি লক্ষ্যনীয়। মেলায় গিয়ে দেখে বোঝার উপায় নেই যে, কে হিন্দু; আর কে মুসলিম। সৌহার্দ্য এবং সম্প্রীতির মেলবন্ধন এসব গ্রামীণ ঐতিহ্যবাহী মেলা। অসাম্প্রদায়িক চেতনার দেশে যা, বছরের পর বছর চলমান রয়েছে। এরই ধারাবাহিকতা অব্যাহত রেখেছেন স্থানীয় এলাকাবাসী।

মেলায় একই উপজেলার বৈলশিং গ্রাম থেকে বিভিন্ন রকমের ফুল বিক্রয়ের জন্য আসেন আশিক। তিনি বলেন, বাবা-দাদার সময় থেকে এই মেলায় ফুল বিক্রি করে আসছেন তাঁরা। তিন দিনব্যাপী আয়োজিত এ মেলায় দূরদূরান্ত থেকে লোকজন আসে। এজন্য বেচাকেনা খুব ভালো হয়।

গতকাল সোমবার সন্ধ্যায় তানইল আদিবাসী পাড়ার গ্রামীণ ঐতিহ্যবাহী মেলায় গিয়ে দেখা যায়, পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসেছেন দূরদূরান্ত থেকে আসা ব্যবসায়ীরা। মিষ্টি, খেলনা, চুড়ি, ফিতা, আলতা থেকে গৃহস্থালির নানা জিনিস বিক্রি হচ্ছে এখানে। মিষ্টি, জিলাপি বানানো হচ্ছে হচ্ছে ১০টির ও বেশি দোকানে। বিক্রিও হচ্ছে বেশ। তিন দিনব্যাপী আয়োজিত এ মেলা চলবে আজ মঙ্গলবার সন্ধ্যা পর্যন্ত।

সোমবার সন্ধ্যায় মেলায় আসেন তানইল আদিবাসী পাড়ার উকিল চন্দ্র এবং সাগরসহ অনেকে । তারা বলেন, ‘ বহু বছর যাবৎ ঐতিহ্য ধরে রেখেছে মেলাটি। এখন গ্রামগঞ্জেও আধুনিক সব পণ্যের দোকানপাট গড়ে উঠেছে। তারপরও কাঠের আসবাবসহ গৃহস্থালির প্রয়োজনীয় পণ্য কিনতে মানুষ এই মেলায় আসে। তিনদিন ব্যাপী আয়োজিত এ মেলায় আমরা প্রতিবারই আসি। এবারেও এসেছি।

এ মেলা ঘিরে জামাতা ও আত্মীয়স্বজনকে আমন্ত্রণ করে আপ্যায়ন করার রেওয়াজ রয়েছে স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে। বাড়িতে বাড়িতে বানানো হয় বাহারি পিঠা। মেলা থেকে মিষ্টি কিনে এনে মেয়ে, জামাতা ও আত্মীয়স্বজনদের খাওয়ানোর রেওয়াজ ধরে রেখেছে এলাকাবাসী।

তানইল গ্রামের বাসিন্দা সোহাগী (৭০) বলেন, ‘হামাকে জন্মের পর থ্যাকা এই ম্যালা দ্যাকা আয়োচি। হামাকে বাপ-দাদারাও কবার পারেনি কদ্দিন থ্যাকা এই ম্যালা শুরু হচে। আগে এই ম্যালাত মাটির তৈরি বাসন-কুশন পাওয়া যাতো। একনো মাটি দিয়া বানানা বাসন-কুশন লিয়্যা কিছু কিছু দোকান বসে, কিন্তু আগের মতো লয়। মাটির হাঁড়ি-পাতিল ট্যাঙ্গ্যা থোওয়ার জুন্নে পাটের শিকা পওয়া যাতো আগে। সেগল্যা শিকা এ্যাকন আর পাওয়া যায় না।’

মেলা আয়োজক কমিটির সভাপতি নরেন্দ্রনাথ, বলেন, প্রতিবছর পৌষ সংক্রান্তির আগের দিনে মেলাটি বসে। চলে তিন দিন ধরে। ১০০ বছরের বেশি সময় ধরে একই দিনে মেলাটি বসছে। দূরদূরান্তের মানুষ এখনো আসে মেলায় যোগ দিতে। সে কারণে সব ধরনের সুবিধা রাখতে আয়োজক কমিটি সব রকমের প্রস্তুতি নিয়ে থাকেন। এবারও সে রকম প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। আগামীতেও এর ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকবে বলেও জানান তিনি।