"বাংলা ভাষা" বাংলা-ভাষাভাষীদের একটি অহংকারের নাম

ড. মো. আনোয়ার হোসেন:ভাষা সম্পর্কে পরিপূর্ণ এবং অবিতর্কিত সংজ্ঞা দেয়া কঠিন। তবে ভাষা মানুষের মস্তিস্কাদ্ভাবিত একটি বিশেষ ক্ষমতা যা অর্থবোধক বাকসংকেতে রূপায়িত হয়ে মানুষের মনের ভাব প্রকাশ করতে এবং বিভিন্ন মানুষের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপনে সহায়তা করে। মানব সৃষ্টির শুরু থেকে সভ্যতার ক্রমবিকাশের সাথে সাথে ভাষারও বিবর্তন ঘটেছে স্বতঃস্ফূর্তভাবে। এরই সঙ্গে জন্ম হয়েছে হরেক রকম ভাষার। সেখানে নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে সময়, অবস্থান, ভৌগোলিক প্রেক্ষাপটের মতো বহু গুরুত্বপূর্ণ কিছু নির্ধারক।

এসব নিয়ামকের কারণেই একটি দেশ বা অঞ্চলের মধ্যেই রয়েছে নানাবিদ বিচিত্র ভাষা যা অদ্যবদি আবিস্কার হয়নি। আবিস্কার না হওয়া পিছনে রয়েছে বহু কারণ। কিছু ভাষা অপ্রকাশিত, কিছু ভাষা আবিস্কৃত হওয়ার আগেই বিলুপ্তপ্রায়, কিছু ভাষা বদলাতে বদলাতে অন্য ভাষায় রুপান্তির হয়ে গেছে, আবার কিছু ভাষায় কথা বলেই গুটিকয়েক মানুষ। পাপুয়া নিউগিনিয় জনসংখ্যা প্রায় ৪০ লাখ হলেও আলাদা আলাদা ভাষা রয়েছে প্রায় ৮৩২টি। তবে ধারণা করা হয় পৃথিবীতে মাতৃভাষার সংখ্যা প্রায় সাত হাজার। মাতৃভাষীর সংখ্যায় চীনা ভাষা প্রথম হলেও ইংরেজী ভাষায় পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি মানুষ কথা বলে। বিশ্বের মোট জনসংখ্যার প্রায় ১৫ শতাংশ কথা বলেন এই ভাষায়। তবে মাতৃভাষা হিসেবে ইংরেজির অবস্থান তৃতীয়। অন্যদিকে মাতৃভাষা হিসেবে বাংলার অবস্থান পঞ্চম এবং বিশ্বে ব্যবহৃত ভাষা হিসেবে এর অবস্থান সপ্তম।

১৮৬১ সালে মাইকেল মধুসূদন দত্ত বাংলা ভাষায় রচনা করেন মেঘনাদবধ কাব্য এবং ১৯১৩ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গীতাঞ্জলি  কাব্যগ্রন্থটির জন্য সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। সেই প্রথম বাংলা ভাষার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। কালের বিবর্তনে বিভিন্ন কবি, সাহিত্যিক, লেখক, ভাষাবিদ, ভাষাপ্রেমী তথা সকল বাংলা ভাষাভাষীদের অবদানে বাংলা ভাষা আজ বিশ্ব দরবারে সমাদৃত । ১৯৪৭ পরবর্তী বাংলা ভাষাভাষীদের অতিক্রম করতে হয়েছে চরম ক্রান্তিকাল। ভাষার অস্তিত্ব রক্ষার জন্য ঝরাতে হয়েছে বুকের তাজা রক্ত। ১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে দুর্বার আন্দোলনে সালাম, জব্বার, শফিক, বরকত ও রফিকসহ নাম না জানা অনেক ভাষা শহীদের রক্তের বিনিময়ে বাঙালি জাতি পায় মাতৃভাষার মর্যাদা । তারই পথ ধরে শুরু হয় বাঙালির স্বাধীকার আন্দোলন এবং একাত্তরে ৯ মাস পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত হয় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। তাই একুশে ফেব্রুয়ারি একদিকে শোকাবহ হলেও অন্যদিকে এটি আমাদের জাতীয় জীবনে প্রেরণার উৎস যার রয়েছে গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। কারণ পৃথিবীর একমাত্র জাতি আমরা যারা ভাষার জন্য জীবন দিতে পেরেছি।

আজ সেই ২১ শে ফেব্রুয়ারি।  মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। ভাষা আন্দোলনের ৬৯ বছর পূর্ণ হল আজ। মায়ের ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে একুশে ফেব্রুয়ারি ছিল ঔপনিবেশিক প্রভুত্ব ও শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে বাঙালির প্রথম প্রতিরোধ এবং জাতীয় চেতনার প্রথম উন্মেষ। রক্তরাঙা অমর একুশে ফেব্রুয়ারি রক্তের প্লাবনের মধ্য দিয়ে আজ সারা বিশ্বে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের গৌরবময় আসনে আসীন। ইউনেস্কো ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ঐতিহাসিক মহান একুশের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণা দেয়। ২০০০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে দিবসটি জাতিসংঘের সদস্যদেশসমূহে যথাযথ মর্যাদায় পালিত হচ্ছে। ২০১০ সালের ২১ অক্টোবর বৃহস্পতিবার জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৬৫তম অধিবেশনে এখন থেকে প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করবে জাতিসংঘ। এ সংক্রান্ত একটি প্রস্তাব সর্বসম্মতভাবে পাস হয়েছে। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালনের প্রস্তাবটি সাধারণ পরিষদের ৬৫তম অধিবেশনে উত্থাপন করে বাংলাদেশ। মে মাসে ১১৩ সদস্যবিশিষ্ট জাতিসংঘের তথ্যবিষয়ক কমিটিতে প্রস্তাবটি সর্বসম্মতভাবে পাস হয়।

ভাষা নিয়ে এখন সারা দেশে শুরু হয়েছে একধরনের অরাজকতা। অনেক সময় মনে হয় ইংরেজী শব্দের ব্যবহার ছাড়া বাংলা ভাষায় মনের ভাব প্রকাশ কার বা মতবিনিময় করা প্রায় অসাধ্য একটি কাজ। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় হতে শুরু করে টক শো, বক্তৃতা, একাডেমিক আলোচনা অথবা সংসদের বিতর্ক সব জায়গাতেই একই অবস্থা। এমনকি স্বাভাবিক আলাপ চারিতায়ও নিয়ন্ত্রনহীন ভাবে ব্যবহার করা হয় অনাবশ্যক ইংরেজি শব্দ। এমনকি শুদ্ধ বানান নির্বাচন নিয়েও সমস্যার অন্ত নেই। একেক স্থানে একেক বানান। রক্তে অর্জিত ভাষার এ মাসে শুদ্ধ ভাষা চর্চা শুরু হোক। ইংরেজী আমাদের প্রয়োজন। জাতির স্বার্থেই প্রয়োজন। তার জন্য বাংলা ভাষাকে কুলষিত করে নয় নিশ্চয়ই ! সারা বিশ্বে যখন বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির একাডেমিক চর্চা বৃদ্ধি পাচ্ছে তখন আমাদের এমন অবস্থা।   

আমাদের মনে রাখতে হবে, পৃথিবীর আর কোনো জাতি ভাষার জন্য জীবন দেয়নি। ভাষার দাবিতে আর কোনো দেশে মরণপণ সংগ্রাম-লড়াই-আন্দোলন হয়নি। আমাদের প্রিয় মাতৃভাষা, প্রিয় বাংলা ভাষাকে নিয়ে আমাদের ভালোবাসা, অহংকার আর গর্ব তাই অন্য যে কোন ভাষাভাষীর তুলনায় অনেক অনেক বেশি।
===============================
ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা,এফএমপিএইচটি বিভাগ
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট, গাজীপুর-১৭১০
E-mail: This email address is being protected from spambots. You need JavaScript enabled to view it.