১৩ ফেব্রুয়ারি কৃষিবিদ দিবস: "বঙ্গবন্ধুর অবদান কৃষিবিদ ক্লাস ওয়ান"

কৃষিবিদ ড. মো. হুমায়ুন কবীর:কৃষি বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রিধারী ব্যক্তিকে কৃষিবিদ বলা হয়। কৃষিবিদদের জন্য জাতীয়ভাবে আমাদের দেশে একটি আলাদা দিবসের প্রচলন হওয়াতে আমরা কৃষিবিদরা গর্বিত। যতই দিন যাচ্ছে ততই বাংলাদেশের কৃষিখাত গুরুত্ব পাচ্ছে। আর কৃষিখাত গুরুত্ব পাওয়া মানেই কৃষিবিদদের জন্য গৌরবের। কারণ আজ বাংলাদেশের কৃষিক্ষেত্রে যে প্রভূত‚ত উন্নতি সাধিত হয়েছে তার পুরোটার কৃতিত্বই কৃষিবিদদের। কৃষিবিদ একটি মহান পেশা। এ পেশায় বাংলাদেশের মাটির গন্ধ মিশে রয়েছে। এ পেশা দেশের কৃষিকে পরিচালিত করছে। করছে দেশের কৃষককুলকে। দেশের খাদ্য উৎপাদনে অনন্য উদাহরণ সৃষ্টি করে চলেছে। কেউ গবেষণায়, কেউ সম্প্রসারণে, কেউ প্রশিক্ষণে, কেউ শিক্ষায় ব্যাপক অবদান রেখে চলেছেন।

কীভাবে এলো কৃষিবিদদের জন্য এমন একটি মহান দিন, সেটি জানার জন্য একটু পিছনে যেতে হবে। আমরা জানি ১৯৬১ সালের ১৮ আগস্ট কৃষির পূণ্যভূমি হিসেবে পরিচিত তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ময়মনসিংহে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল দেশের একমাত্র মহান ও গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান পূর্ব পাকিস্তান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক ছাত্র, শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারি অংশ নিয়ে দেশ স্বাধীনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। অনেকে জীবন দিয়ে শহীদও হয়েছেন। স্বাধীনতার পর কৃষি শিক্ষার এ গর্বিত উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে অনন্য প্রতিষ্ঠা লাভ করে।  

তখন কৃষিবিদদের সরকারি চাকুরিতে প্রবেশের ক্ষেত্রে দ্বিতীয় শ্রেণির মর্যাদা দেওয়া হতো। পাশাপাশি একই সময় ও সমযোগ্যতাসম্পন্ন প্রকৌশলী ও চিকিৎকদেরকে প্রথম শ্রেণির মর্যাদা দেওয়া হতো। অথচ ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার থেকে কৃষিবিদগণের অবদান ও যোগ্যতা কোনভাবেই কম নয়। সেজন্য বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে স্বাধীন বাংলাদেশে সরকার গঠিত হওয়ার পর তাঁর নিকট কৃষিবিদদের এ যুক্তিসঙ্গত দাবি উত্থাপিত হলে তিনি সে ব্যাপারে একমত পোষণ করেন। কারণ তিনি মনে করতেন বাংলাদেশের মাটি হলো সোনা। আর এ সোনার খনি থেকে সোনার ফসল উৎপাদনের জন্য কৃষিকেই সর্বাগ্রে গুরুত্ব দিতে হবে। সেজন্য তিনি কৃষি, কৃষক, কৃষিবিদ এবং বাংলাদেশের উন্নয়নকে সমার্থক ভাবতেন।

তারই অংশ হিসেবে তিনি ১৯৭৩ সালের ১৩ ফেব্রেুয়ারি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যায় চত্বরে এক সমাবর্তন অনুষ্ঠানে কৃষিবিদদের প্রাণের দাবি মেনে নেন। তিনি ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ারদের পাশাপাশি কৃষিবিদদেরও সরকারি চাকুরিতে প্রথম শ্রেণির মর্যাদায় ভূষিত করেন। আনন্দে ফেটে পড়ে গোটা দেশের কৃষিবিদ সমাজ। সেই থেকেই আত্ম মর্যাদায় সম্মানিত ও বলিয়ান হয়ে তারা নতুন উদ্যমে ঝাঁপিয়ে পড়ে কৃষির উন্নতির মাধ্যমে দেশ গঠনের কাজে। তারই ধারাবাহিকতায় আজ আমরা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। যে দেশের কোন আশা ছিলনা, ছিল শুধু একটি তলাবিহীন ঝুড়ির তকমা। সেখান থেকে আজ কৃষিতে দেশ কোথায় এসেছে সেটি ভাবতে দেশের প্রতিটি সাধারণ মানুষের মত কৃষিবিদ হিসেবে আমিও গর্ব বোধ করি।

সেজন্য ১৩ ফেব্রেুয়ারি দিনটি কৃষিবিদদের জন্য অত্যন্ত আনন্দময় গৌরবের দিন। ১৯৭৩ থেকে ২০১২ সাল। এ সুদীর্ঘকাল অনেক চড়াই-উৎড়াইয়ের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধুর এ সোনার বাংলাকে যেতে হয়েছে। এরমধ্যে এ নিয়ে অনেক ষড়যন্ত্রও হয়েছে। যখন দেখা গেছে কৃষিবিদদের বেশিরভাগই বঙ্গবন্ধু ও তাঁর অনুসারি। সেজন্য কৃষিবিদদেরকে পুনরায় দ্বিতীয় শ্রেণিতে নামিয়ে দেওয়ার প্রক্রিয়াও শুরু করা হয়েছিল। তবে সচেতন আন্দোলনের মুখে সেগুলো অপউদ্যোগ ব্যর্থ হয়েছে। যাহোক দীর্ঘদিন পরে হলেও যেসকল কৃষিবিদগণ মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন আবার যেসকল কৃষিবিদ বর্তমান বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার দল ও সরকারকে কৃষিক্ষেত্রে উন্নয়নের শিখরে নিয়ে যাওয়ার জন্য কাজ করে চলেছেন তাঁদেরই সক্রিয় উদ্যোগে ২০১২ সালের ১৩ ফেব্রেুয়ারি থেকে পালিত হয়ে আসছে জাতীয়ভাবে কৃষিবিদ দিবস।

এখানেও একটি মিরাকল। কৃষির গুরুত্ব বিবেচনায় কৃষিবিদদেরকে প্রথম শ্রেণির পদমর্যাদা দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু আর সেই দিবসটি পালনের সুযোগ করে দিলেন তাঁরই সুযোগ্য কন্যা বর্তমান কৃষিবান্ধব মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কৃষকরত্ন শেখ হাসিনা। সেজন্য ২০১২ সাল থেকেই প্রতিবছর ১৩ ফেব্রেুয়ারি কৃষিবিদ দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। যেহেতু বঙ্গবন্ধুই কৃষিবিদদেরকে প্রথম শ্রেণির মর্যাদায় উন্নীত করেছিলেন সেজন্য কৃষিবিদদের মাঝে ‘বঙ্গবন্ধুর অবদান কৃষিবিদ ক্লাস ওয়ান’ শ্লোগানটি খুবই জনপ্রিয়। সারাদেশেই কৃষিবিদদের একটি নেটওয়ার্ক রয়েছে। কৃষিবদগণের জন্য রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ পেশাজীবী সংগঠন। কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশ (কেআইবি) এখন মদশ-বিদেশে অন্যতম পেশাজীবী প্রাতিষ্ঠানিক সংগঠন হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ স্থান করে নিয়েছে।

কাজেই প্রতিবছরের ন্যায় এবারো বিভিন্ন দপ্তর, সংস্থা, সংগঠন, জেলা, উপজেলা পর্যায়ে কৃষিবিদ দিবসটি গুরুত্বের সাথে পালন করা হচ্ছে। এমন একটি দিনের সাথে আমাদের পেশাগত গুরুত্ব আরো বৃদ্ধি পাবে। কৃষিবিদগণ কৃষিকে যে পর্যায়ে নিয়ে গেছেন তার অনন্য একটি উদাহরণ হলো করোনাকাল। কারণ দেশের অর্থনীতির অন্যান্য সকল সেক্টর যেখানে তেমনভাবে উঠে দাঁড়াতে পারেনি সেখানে কৃষি সেক্টরের প্রত্যেকটি খাত, উপখাত সাফল্যের সাথে উৎপাদন অব্যাহত রেখে দেশের চলমান খাদ্য চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানির কথা চিন্তা করতে পারছে। তার মাধ্যমে শুধু অভ্যন্তরীণ খাদ্য নিরাপত্তাই নয় বিশ্বের দুর্ভিক্ষ মোকাবেলাতেও প্রস্ততি রয়েছে। কাজেই কৃষিবিদদের মর্যাদা দান বিফলে যায়নি তা আজ প্রমাণিত। আগামীতেও কৃষিবিদগণ এমনিভাবে দায়িত্ব পালন করে যাবেন- এটিই এ দিবসের অঙ্গীকার।

লেখক: ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়
email: This email address is being protected from spambots. You need JavaScript enabled to view it.