তীব্র শীতে বোরো বীজতলা রক্ষায় করণীয়

কৃষিবিদ মো. আবু সায়েম:শীতকালে নির্দিষ্ট সময় সারাদেশে বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলে ঘনকুয়াশা ও প্রচন্ড ঠান্ডা আবহাওয়া প্রবাহিত হয়ে থাকে। প্রতি বছরই বোরো বীজতলাসহ বিভিন্ন মাঠ ফসল ঠান্ডাজনিত আঘাতে ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে থাকে। প্রচন্ড ঠান্ডা ও ঘন কুয়াশার কবল থেকে বোরো বীজতলাসহ বিভিন্ন মাঠ ফসল রক্ষা করা জরুরি হয়ে পড়ে। প্রচলিত কিছু পদ্ধতি ও আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি উভয়ই মিলিয়ে সহজেই সম্ভাব্য ক্ষতির হাত হতে ফসল রক্ষা করা যায় শুধু তাই নয়, এমন কি অধিক ফলন নিশ্চিত করা সম্ভব। তাই শুরুতেই শৈত্য প্রবাহের ফলে বোরো বীজতলায় কী কী ধরণের ক্ষতির লক্ষণ দেখা দিতে পারে জেনে নেয়া দরকার।

শৈত্য প্রবাহের কারণে বোরো ধানের চারা হলুদাভ হয়ে ক্রমশঃ শুকিয়ে যায়। শীতের প্রকোপে চারা পোড়া বা চারা ঝলসানো রোগের জন্য মারা যেতে পারে। এছাড়াও চারা ধ্বসে বা বসে পড়া রোগ দেখা দিতে পারে। বৃহত্তর রংপুর ও দিনাজপুর অঞ্চলে শীতের স্থায়িত্ব ও তীব্রতা দেশের অন্য এলাকার তুলনায় অনেক বেশি। ফলে শৈত্য প্রবাহ শুরু হলে কৃষক ভাইদের বোরো ধান চাষাবাদে বাড়তি কিছু যত্ন নেয়া জরুরি।

তীব্র শীতের সময় সাধারণভাবে কাদাময় বা ভেজা বীজতলায় সব সময় পানি ধরে রাখতে হবে এবং স্বচ্ছ পলিথিনের ছাউনি দিয়ে বীজতলা ঢেকে রাখা দরকার। শৈত্য প্রবাহের সময় বীজতলা স্বচ্ছ পলিথিন দিয়ে সকাল ১০-১১টা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ঢেকে রাখতে হবে। বীজতলায় ১ থেকে ২ ইঞ্চি পানি ধরে রাখতে হবে, এক্ষেত্রে গভীর নলকূপের পানি ব্যবহার করা উত্তম। বীজতলার পানি সকালে বের করে দিয়ে আবার নতুন পানি দিতে হবে। প্রতিদিন সকালে রশি টানা দিয়ে বা অন্য কোন উপায়ে চারা থেকে কুয়াশার পানি বা শিশির ঝরিয়ে দিলে চারা শীত থেকে রক্ষা পায় এবং ভালোভাবে বাড়তে পারে।

ঠান্ডার কারণে বীজতলায় কিছু কিছু জায়গায় চারা ধ্বসে পড়ে বা বসে যেতে পারে। চারায় ধ্বসে বা বসে পড়া রোগ দেখা দিলে বীজতলা থেকে পানি সরিয়ে দিতে হবে এবং এক শতাংশ বীজতলায় ৫০ গ্রাম হারে এমওপি বা পটাশ সার প্রয়োগ করতে হবে। তীব্র শীতের সময় চারা পোড়া বা ঝলসানো রোগ দেখা দিতে পারে। চারা পোড়া বা ঝলসানো রোগ দমনের জন্য রোগের প্রাথমিক অবস্থায় অর্থাৎ শুরুর দিকে এমিস্টার টপ বা এ জাতীয় যেকোন ছত্রাকনাশক ২ মিলি লিটার এক লিটার পানিতে মিশিয়ে দুপুরের পর স্প্রে করতে হবে। বীজতলার চারা হলুদ হলে এক শতক জমিতে ২৮০ গ্রাম হারে ইউরিয়া সার প্রয়োগ করতে হবে। ইউরিয়া প্রয়োগের পর চারা সবুজ না হলে এক শতক জমিতে ৪০০ গ্রাম হারে জিপসাম সার প্রয়োগ করতে হবে।

চারা রোপণের সময় শৈত্য প্রবাহ থাকলে কয়েকদিন দেরি করে আবহাওয়া স্বাভাবিক হলে চারা রোপণ করতে হবে। রোপণের জন্য কমপক্ষে ৩৫-৪৫ দিনের চারা ব্যবহার করতে হবে। এ বয়সের চারা রোপণ করলে শীতে চারা কম মারা যায়, চারা সতেজ থাকে এবং ফলন বেশি হয়। রোপণের পর শৈত্য প্রবাহ হলে জমিতে ২ থেকে ৩ ইঞ্চি পানি ধরে রাখতে হবে। থোড় ও ফুল ফোটার সময় অতিরিক্ত ঠান্ডা আবহাওয়া থাকলে জমিতে ২ থেকে ৩ ইঞ্চি পানি ধরে রাখলে থোড় সহজে বের হয় এবং চিটার পরিমাণ কম হয়। ভেজা বা কাদাময় বীজতলার পাশাপাশি অনেকে আবার বোরো মৌসুমে শুকনা বীজতলায় চারা উৎপাদন করে থাকেন।

ইতিমধ্যে যারা শুকনা বীজতলা করেছেন তীব্র শীতের সময় তাদের বীজতলাগুলো সার্বক্ষণিক স্বচ্ছ পলিথিন দিয়ে ঢেকে রাখতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে বীজতলায় রসের অভাব হয়েছে কিনা। বীজতলায় রসের অভাব হলে ¯েপ্র করে হালকা সেচের ব্যবস্থা করতে হবে। প্রচলিত পদ্ধতির পাশাপাশি কৃষিতে আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে। কৃষিতে আধুনিক ও লাগসই যন্ত্রের ব্যবহার এখন সময়ের দাবী।

রাইস ট্রান্সপ্লান্টারের মাধ্যমে চারা রোপণ তারই অংশ। তবে এ কাজের জন্য ট্রে-তে সুস্থ্য-সবল ও রোগমুক্ত চারা উৎপাদন করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ট্রে-তে অংকুরিত বীজ ফেলানোর ৫ থেকে ৭ দিন পর্যন্ত এবং তীব্র শৈত্য প্রবাহ চলাকালীন সময় সার্বক্ষণিক স্বচ্ছ পলিথিন দিয়ে ঢেকে রাখতে হবে। এরপর প্রতিনিয়ত বিকেল ৪টা হতে সকাল ৯টা পর্যন্ত স্বচ্ছ পলিথিন দিয়ে ঢেকে রাখতে হবে। এছাড়া শুকনা মাটিতে পাতা ঝলাসানো রোগটি বেশি হয় কাজেই ট্রে-তে পরিমাণমত পানি দিয়ে ভিজিয়ে রাখতে হবে।

সর্বোপরি, মনে রাখতে হবে শীতের তীব্রতা ও চারার বয়স বিবেচনায় সমন্বিত ব্যবস্থাপনা গ্রহণ করলে সুস্থ্য-সবল-নিরোগ চারা উৎপাদন করে বেশি ফলন ফলানো সম্ভব।

লেখক:অতিরিক্ত উপপরিচালক (এলআর), কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর প্রেষণে পিএইচডি গবেষক, হাবিপ্রবি, দিনাজপুর।