পুষ্টিতে ঠাসা দেশের অবহেলিত জাতীয় ফল

কৃষিবিদ ড. এম. মনির উদ্দিন: কাঁঠাল মুলত ভারতীয় উপ-মহাদেশের ফল যা গ্রীস্মমন্ডলীয় দেশ বিশেষ করে বাংলাদেশ, ভারত, মিয়ানমার, শ্রীলংকা, মালয়শিয়া, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, ফিলিপাইনসহ অন্যান্য গ্রীস্মমন্ডলীয় দেশে জন্মায়। সারাদেশেই কম বেশী উৎপাদন হওয়ায় কাঁঠাল বাংলাদেশের জাতীয় ফল হিসেবে বিবেচিত।

কাঁঠালের বৈজ্ঞানিক নাম Artocarpus heterophylus। কাঁঠাল উৎপাদনে বিশ্বে ভারতের পরেই বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়। দেশে এমন কোনো জেলা নেই যেখানে কাঁঠাল হয়না। লালমাটি কাঁঠাল উৎপাদনের জন্য সর্বোত্তম। আর এ জন্য সবচেয়ে বেশী কাঁঠাল উৎপাদন হয় মধুপুর ও ভাওয়াল গড় এলাকা ও তিন পার্বত্য জেলায়।

কাঁঠালের খুব বিস্তৃত কৃষি-বাস্তুসংস্থানীয় অভিযোজন ক্ষমতা রয়েছে যার কারনে দেশের প্রতিটি গ্রামেই কাঁঠাল গাছ দেখা যায়। ফল ব্যতীত কাঁঠাল গাছের অন্য সব অংশের অর্থনৈতিক মুল্য রয়েছে। দেশে বিশেষ কিছু এলাকায় কাঁঠাল বেশী পরিমানে হয়ে থাকে যার মধ্যে মধুপুর ও ভাওয়াল গড়, পার্বত্য জেলা বান্দরবন, খাগড়াছড়ি ও রাঙ্গামাটি, ময়মনসিংহ, নরসিংদী, পঞ্চগড়, দিনাজপুর, রাজশাহী, বগুড়া, কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, সিলেট উল্লেখযোগ্য। ২০ বছর আগে কাঁঠাল ও আম এদেশের প্রধান ফল ছিল। সময়ের ব্যবধানে দেশের ফল উৎপাদনে এক নীরব বিপ্লব সাধিত হয়েছে। এখন কাঁঠালের মৌসুমে বাহারী রকমের আম, লিচু, আনারস, পেয়ারাসহ বিভিন্ন রকম ফলের উৎপাদন বেড়েছে যার কারনে চাহিদা কমেছে জাতীয় ফল কাঁঠালের। ২০১৬ সালে, মাথাপিছু ফল খাওয়ার পরিমান ছিল প্রতিদিন ৩৫.৮ গ্রাম যা এখন বেড়ে ২০২২ সালে দাড়িয়েছে ৯৫.৪ গ্রাম (ঐওঊঝ, ২০২২)। দেশে এখন ৭২ প্রজাতির ফলের চাষ হচ্ছে যা আগে ছিল ৫৬ প্রজাতির।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী দেশে বছরে প্রায় ১৯ লাখ টন কাঁঠাল উৎপাদিত হয় এবং পুষ্টি সমৃদ্ধ এই ফলটির ৪০-৫০ শতাংশ পর্যন্ত নষ্ট হয়ে যায়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় ১৫ লাখ টন কাঁঠাল উৎপাদিত হয়। অন্য সুত্র মতে, ২০২১ সালে ৬৫,৩৬৪ হেক্টর জমিতে ১৮.৬৯ লাখ টন কাঁঠাল উৎপাদিত হয়েছে যার ফলন হেক্টর প্রতি ২৮.৫৯ টন। আগের বছরের তুলনায় উৎপাদন বেড়েছে ৩,৪৯০ টন। কাঁঠাল দেশের ফল উৎপাদনের প্রায় ২২ শতাংশ। ২০২১-২০২২ অর্থবছরে, দেশের মোট ফল উৎপাদন ছিল ১.২২ কোটি টন। দেশের ৩২.১ মিলিয়ন পরিবারের বসতবাড়ীতে অবহেলা ও অযতেœ জন্মায় এই জাতীয় ফল।

কাঁঠাল হলো শীর্ষ শ্রেনীর ফল যার মধ্যে পুষ্টির মাত্রা সর্ব্বোচ্চ। দেশের মানুষের খাদ্য তালিকায় কাঁঠাল ফাইবার, ভিটামিন, প্রোটিন, খনিজ এবং ক্যালরির উৎস হিসেবে গ্রামীন ও শহরের মানুষের পুষ্টিতে অবদান রাখে। তাছাড়াও কাচা ও পাকা উভয় কাঁঠালের মধ্যে যে সব পুষ্টি উপাদান পাওয়া যায়-ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, সোডিয়াম, আয়রণ, ফসফরাস, পটাশিয়াম, কপার, ম্যাঙ্গানিজ, ভিটামিন-এ, থায়ামিন, রিবোফ্লোবিন, ভিটামিন-সি, পাইরিডক্সিন, নায়াসিন, ফলিক এসিড উল্লেখযোগ্য। বিভিন্ন প্রকার ডালে ২০-২৬ শতাংশ প্রোটিন থাকে, গরুর মাংসে প্রোটিন ২৬-২৭ শতাংশ, মুরগীর মাংসে ৩১ শতাংশ, মাছে ১০-১৭ শতাংশ, আর কাচা কাঁঠালে প্রোটিন পাওয়া যায় ১০ শতাংশ। তাই, কাঁঠাল হতে পারে মাছ বা মাংসের বিকল্প খাদ্য উৎস।

গবেষণায় দেখা গেছে যে, আমাদের শরীরের অর্ধেকেরও বেশী ক্যালরি আসে মাত্র নয়টি উদ্ভিদ প্রজাতি থেকে যদিও আনুমানিক ২৭,৫০০টি ভোজ্য উদ্ভিদ সারাবিশ্বে রয়েছে। অব্যবহ্নত ধরনের খাদ্যের বৈচিত্র্য আনা হলো খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা উন্নত করার একটি অন্যতম উপায়। আর তার সহজ এক উদাহরন হলো কাঁঠালের খাদ্যপণ্যের উৎপাদনের মধ্যে বৈচিত্র্য নিয়ে আসা। বর্তমানে জলবায়ুর পরিবর্তনজনিত ও বিভিন্ন শারীরিক সমস্যার কারনে এক শ্রেনীর মানুষের বিশেষ করে চল্লিশর্ধো মানুষের অনেকেই পাকা কাঁঠাল খেতে পারছেন না। অন্যদিকে আঠাযুক্ত হওয়ার কারনে নুতন প্রজন্মের মধ্যেও পাকা কাঁঠাল খাওয়ার প্রবণতা অনেক কম। আর এ সমস্ত কারনে কাঁঠালের এই ব্যাপক পরিমান অপচয় হয়ে থাকে।

এই সকল বিষয় বিবেচনায় নিয়ে দেশের গবেষকরা কাঁঠাল দিয়ে এমন কিছু খাদ্যপন্য তৈরী করার চেষ্টা করছেন যা কয়েক মাস পর্যন্ত সংরক্ষন করা যাবে। আরেকটি বাস্তবতা হচ্ছে, বাংলাদেশে শুধু পাকা কাঁঠাল খাওয়ার জন্য ব্যবহ্নত হয়। যেহেতু পাকা কাঁঠাল খাওয়ার প্রবণতা বিভিন্ন কারনে কমে গিয়েছে তাই এর বিকল্প অর্থ্যাৎ কাচা কাঁঠালের ব্যবহার বাড়াতে হবে। সাপ্রতিক গবেষণাগুলোতে উঠে এসেছে, কাচা কাঁঠালের মধ্যে ১০ শতাংশ পর্যন্ত প্রোটিন পাওয়া যায় যা মাংস বা মাছের বিকল্প হিসেবে খাওয়ার সুযোগ রয়েছে। কাচা কাঁঠালের ব্যবহার যত বেশী খাদ্য হিসাবে গ্রহন করা হবে তত বেশী এই ফলের অপচয় কমে আসবে। কাঁঠাল উৎপাদনের বড় এ্কটি অংশ যদি কাচা হিসেবে ব্যবহার বাড়ানো যায় তা একদিকে যেমন খাদ্য নিরাপত্তায় সহায়ক হবে সেইসাথে মানুষের পুষ্টি নিরাপত্তায়ও ব্যাপক ভুমিকা রাখবে।

অনেক মানুষের ধারনা যে, কাঁঠাল শুধু পাকলেই খাওয়া যায়। কাচা কাঁঠাল যে বিভিন্নভাবে প্রক্রিয়াজাত পণ্য তৈরী করে খাওয়া যায় এবং কাচা কাঁঠালে যে প্রচুর পরিমানে প্রোটিনসহ নানা ধরনের ভিটামিন ও খনিজ পদার্থ রয়েছে তা আমরা জানিনা। প্রোটিনের বিকল্প হিসেবে কাচা কাঁঠাল আমাদের খাদ্য তালিকায় যুক্ত হতে পারে। পাকা কাঠালের পাল্প বা কোয়া খাওয়া হয়। কাঁঠাল স্বাদের দিক দিয়ে দুই রকমের হয়ে থাকে। প্রথমত, খাজা কাঁঠাল যার পাল্প কিছুটা শক্ত প্রকৃতির, খেতে কচ কচ করে এবং অনেকের কাছে এই কাঁঠাল বেশী পছন্দের। অন্যটি গালা কাঁঠাল যার পাল্প নরম ও রসালো এবং এটি রস করে খাওয়ার জন্য খুবই উপযোগী। কাঁঠালের বীজ একটি সুস্বাদু ও পুষ্টিকর খাদপণ্য যা বিভিন্নভাবে খাওয়া যায়। গ্রামীন এলাকায় কাঁঠালের বীজ সিদ্ধ করে ভর্তা বানিয়ে ভাতের সাথে খাওয়া একটি বহল প্রচলিত পদ্ধতি। অন্যান্য তরকারীর সাথেও কাঁঠালের বীজ ব্যবহার করা হয়। আবার বীজ ভেজে খাওয়া যায় যার অন্যরকম একটি স্বাদ রয়েছে।

সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইন্সটিটিউট (বারি) কাঁঠাল থেকে বিভিন্ন ধরনের সুস্বাদু খাবার তৈরী করে সফল হয়েছে যার মধ্যে রয়েছে কাঁঠালের জ্যাম, আচার, চাটনি, চিপস, কাটলেট, আইসক্রিম, দই, মাংসের বিকল্প হিসেবে কাচা কাঁঠালের সব্জি বা তরকারী রান্না করে খাওয়া, কাঁঠালের পাউডার, কাঁঠালের বীজের পাউডার এবং অন্যান্য বিভিন্ন প্যাকেটজাত পণ্য যাতে করে গ্রাহকরা সারাবছর কাঁঠালের তৈরী বিভিন্ন পণ্য বাজারে পেতে পারেন। অর্থ্যাৎ কাঁঠাল থেকে ৩০টিরও বেশী বিকল্প খাদ্যপণ্য তৈরী করে সারাবছর ব্যবহার করা যেতে পারে। বর্তমানে বাজারে কাচা কাঁঠালের ভেজিটেবল রোল, কাটলেট, সিংগারা তৈরী করে বাজারে বিক্রয় হচ্ছে। আবার পাকা কাঁঠালের রস দিয়ে আইসক্রিম, কেক, ফ্রুট রোল-আপ তৈরী হচ্ছে।

আর্ন্তজাতিক বাজারে কাঁঠালের উৎপাদিত বিভিন্ন পণ্যের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, কাঁঠাল রপ্তানী ক্রমেই বাড়ছে। ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে কাঁঠাল রপ্তানী হয়েছে প্রায় ১,০০০ টন। হবিগঞ্জের বড় ও ভালমানের কাঁঠাল রপ্তানী হয় কাতার, ওমান, বাহরাইন, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশ, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাস্ট্রসহ বিভিন্ন দেশে। প্রক্রিয়াজাত কাঁঠালও রপ্তানীর তালিকায় রয়েছে। ২০১৯ সালে বাংলাদেশ ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোতে প্রক্রিয়াজাত কাঁঠাল পণ্য রপ্তানী শুরু করে এবং এর মাধ্যমে দেশের রপ্তানীর পরিসরে বৈচিত্র্য আসে। বাংলাদেশ কৃষিভিত্তিক পণ্য উৎপাদনকারী এবং বণিক সমিতির (ইঅচচগঅ) অধীনে ২০১৯ সালে বেশ কয়েকটি কোম্পানী ইউরোপীয় ইউনিয়নের কয়েকটি দেশে কাঁঠাল থেকে তৈরী অসমেটিক ডিহাইড্রেটেড খাবার ও কাঁঠালের বীজের গুড়া রপ্তানী করেছে।

একজন পুর্নবয়স্ক মানুষ পাকা কাঁঠালের ১০-১২টি কোয়া খেলে তার অর্ধেক দিনের আহার হয়ে যায়। কাঁঠাল পাকার পর বেশীদিন সংরক্ষন করা য়ায় না। তাই এর বিকল্প ব্যবহার বাড়ানোর মাধ্যমে সকল শেনীর মানুষের পুষ্টিমান উন্নয়নে ভুমিকা রাখতে পারে। কাঁঠালের বীজ ও ফল শুকিয়ে বেকিং ময়দা তৈরী করা যায় যা যে কোন সব্জি বা তরকারীতে ব্যবহার করে খাদ্যের মান বাড়ানো যায়। বিএআরসি (ইঅজঈ) কাঁঠালের বার্গারের ফুড ভেল্যু পরীক্ষা করে যা পেয়েছে তাতে কাচা কাঁঠালের তৈরী বার্গারের প্রতি ১০০ গ্রাম কাঁঠালের প্যাটিতে ৯.৭৮ গ্রাম কার্বোহাইড্রেট, ১০.৮৭ গ্রাম প্রোটিন, ৮.৪৭ গ্রাম চর্বি, ১৯.৩২ গ্রাম ডায়েটারি ফাইবার এবং ১৫৯ কিলোক্যালরি শক্তি থাকে। নিরামিষভোজীদের জন্য কাঁচা কাঁঠালের বিভিন্ন প্রক্রিয়াজাত খাদ্য যোগান দিতে পারে শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় প্রোটিন ও চর্বি। অথচ যথাযথ প্রক্রিয়াজাতের মাধ্যমে এই ফলের বিভিন্ন খাদ্যপণ্য দেশের মানুষের পুষ্টিমান উন্নয়নের পাশাপাশি বিশ্বের অপুষ্টিতে ভোগা শিশুদের পুষ্টি উন্নয়নে অবদান রাখতে পারে।

গেইন বাংলাদেশ পুষ্টি সমৃদ্ধ এই জাতীয় ফলটিকে ঘিরে দেশের শিশু, কিশোর, য়ুবক, মহিলাদের পুষ্টিমান উন্নয়নের জন্য এক উজ্জল সম্ভাবনা দেখছে। গেইন বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর ড. রুদাবা খন্দকার আশা পোষন করেন যে, কাচা ও পাকা কাঁঠাল থেকে বৈচিত্র্যময় নানা ধরনের খাদ্যপণ্য তৈরীর মাধ্যমে শিশুসহ সকল শ্রেনীর মানুষের পুষ্টিমান উন্নয়নে সফল ভুমিকা রাখতে সহায়ক হবে এবং কাঁঠালকে নিয়ে এর বহুমুখী ব্যবহার বাড়ানোর জন্য গেইন পরিকল্পনা করছে। সেইসাথে গেইন বাংলাদেশের পোর্টফলিও লিড ও ফুড টেকনোলজি স্পেশালিস্ট ড. আশেক মাহফুজ বলেন, যেহেতু কাঁঠালের বড় একটি অংশ পাকার পর সঠিক প্রক্রিয়াজাত ব্যবস্থা না থাকায় নষ্ট হয়ে যাচ্ছে সেহেতু কাচা কাঁঠালের ব্যবহার যত বেশী বাড়ানো যাবে, এর অপচয় ততটাই কমে আসবে। তাই গেইন কাচা কাঁঠালকে কেন্দ্র করে বৈচিত্র্যময় খাদ্যপণ্য উৎপাদন ও সংরক্ষন প্রক্রিয়ার উপর জোর দেবে যাতে সারাবছর এই বিকল্প খাদ্যপণ্য বাজারে সহজলভ্য হয় এবং এই বিকল্প খাদ্য ব্যবহার বাড়ানোর মাধ্যমে দেশের মানুষের পুষ্টি নিরাপত্তায় অবদান রাখতে পারে।

সবশেষে এটা বলা যায় যে, দেশে প্রতিবছর উৎপাদিত প্রায় ১৯ লাখ টন কাঁঠালের বহুমুখী ব্যবহার বাড়ানোর মাধ্যমে দেশের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তায় বিরাট ভুমিকা রাখতে সক্ষম হবে এবং এজন্য সরকারী, বেসরকারী প্রতিষ্ঠানসমুহ এবং দেশের প্রাইভেট সেক্টরগুলোকে একসাথে মিলে কাজ করে যেতে হবে। আর এভাবেই দেশের জাতীয় ফলের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত হওয়ার মাধ্যমে এর অপচয় রোধ হবে।

-লেখক:এগ্রোনমিস্ট ও কনসালট্যান্ট, গেইন বাংলাদেশ