ওমরাহ সফর-২০২৩: স্বপ্ন ও স্মৃতি- (৬ষ্ঠ পর্ব) " বুড়ির গল্পটি অনেকেই জানেন,তারপরও লিখছি"

মাহফুজুর রহমান: বুড়ির গল্পটি অনেকেই জানেন,তারপরও লিখছি । আমাদের রাসুল (সঃ) যে পথ দিয়ে প্রতিদিন যাতায়াত করতেন, সেপথে কাটা বিছিয়ে রাখতো এক বিধর্মী বুড়ি।কারণ মহানবী (সঃ) ইসলাম প্রচার করছেন, তাই তাকে অপছন্দ করতো বুড়ি এবং কাটা পায়ে ফুটে যাতে তিনি কষ্ট পান সেটাই ছিল তার উদ্দেশ্য।

যাই হোক প্রতিদিন এভাবে কাটা বিছিয়ে রাখতো সেই বুুড়ি এবং মহানবী (সঃ) এর পায়ে ফুটলে তিনি ব্যাথা পেতেন, বুড়ি সেটা দেখে মজা পেত এবং দূর থেকে দেখে হাসতো।মহানবী (সঃ) তার পায়ের কাটা খুলে, পথ থেকে দুরে ফেলে দিতেন যাতে তা অন্যের পায়ে না বিঁধে। এভাবে বেশ কিছুদিন পর হঠাৎ মহানবী (সঃ) খেয়াল করলেন তার চলার পথে আর কাটা নেই, তিনি একটু অবাক হলেন তারপর খোঁজ নিয়ে জানতে পারলেন যে সেই বুড়ি অসুস্থ।তখন তিনি তাকে দেখতে গেলেন এবং তার সেবা-শুশ্রুষা করলেন। মহানবীর এই মহানুভবতা দেখে বুড়ি অবাক হলেন এবং নিজের কর্মকান্ডের জন্য অনুতপ্ত হয়ে ক্ষমা চাইলেন। সেই বুড়ির বাড়ি পরিদর্শন করলাম আমরা। তায়েফের আরও কিছু স্থান জিয়ারাহ করে আমরা মক্কার উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে যায়। মক্কা থেকে তায়েফের দূরত্ব প্রায় ১২০ কিঃমিঃ। এবং আমরা পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে যাতায়াত করায় একটু বেশি সময় ব্যয় হলেও আমরা তায়েফের প্রকৃত সৌন্দর্য্য উপভোগ করতে পারি। আলহামদুল্লিাহ।

ওমরাহ, জিয়ারাহ এবং কাবায় যাওয়া-আসা এভাবেই আমাদের মক্কায় কেটে যায় নয়দিন। এর মধ্যে জান্নাতুল মুয়াল্লা জিয়ারাহ করি আমরা। যেখানে রাসূল (সঃ) এর দাদা আব্দুল মুত্বালিব, মা আমেনা এবং রাসূলের প্রিয়তম স্ত্রী খাদিজা (রা.) এর কবর। জহুরুল ভাইয়ের কল্যাণে জেদ্দা সমুদ্র সৈকতের অনাবিল সৌন্দর্য্যও উপভোগ করার সুযোগ হয় আমাদের। আলহামদুলিল্লাহ। এরপর আমাদের পরবর্তি গন্তব্য প্রিয় নবী (সঃ) এর শহর মদিনার উদ্দেশ্যে।

১১ই মে দুপুর ২টায় আমাদের যাত্রা শুরু হলো। মদিনার কথা মনে পড়তেই হৃদয়পটে ভেসে আসতে শুরু করেছে মদিনার নানান ইতিহাস। মদিনা মুনাওরাহ মুসলিম উম্মাহর কাছে দ্বিতীয় পবিত্রতম শহর এবং আল্লাহর রাসূল (সঃ) এর প্রিয়তম আবাসভূমি। তিনি বলতেন, ‘হে আল্লাহ! আপনি মদিনাকে আমাদের কাছে প্রিয় করে দিন, যেমনিভাবে প্রিয় করেছেন মক্কাকে, বরং তার চেয়েও বেশি প্রিয় করে দিন।’ (সহীহ বুখারী, হাদীস: ১৮৮৯)। মদিনা থেকেই মূলত বিশ্বব্যাপী ইসলাম ধর্মের প্রসার ঘটে। ইসলামের সর্বপ্রথম আনুষ্ঠানিক ইবাদতস্থল মসজিদে কুবা এবং দ্বিতীয় পবিত্রতম মসজিদ মসজিদে নববী এ শহরে অবস্থিত। তা ছাড়া, রাসূল (সঃ) মদিনার মাটিতে আজও শুয়ে আছেন। এরকম আরো বহু কারণে মদিনা মুসলমানদের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। হিজরতের পরে রাসূল (সঃ) শহরটির নাম মদিনা মুনাওরাহ রাখেন। এর আগে তার নাম ছিল ইয়াসরিব।

স্থানীয় সময় রাত দশটার কিছু আগে আমরা মদিনায় পৌঁছায়। মসজিদে নববী থেকে আমাদের হোটেলের দূরত্ব খুব একটা বেশি নয়। পায়ে হেটে গেলে ৪/৫মিনিটের দূরত্ব। নবীর রওজায় সালাম পৌছানোর তর সইছিলোনা আমাদের। হোটেলে লাগেজ রেখে একটু ফ্রেশ হয়েই আমরা মসজিদে নববীর দিকে রওনা করি। আমার পিয়ারা নবী ঘুমিয়ে আছেন তার প্রিয় দুই সাথী হযরত আবু বকর রা. ও হযরত ওমর রা. কে দুইপাশে নিয়ে। রিয়াজুল জান্নাহ নামক স্থানে। রিয়াজুল জান্নাহতে আজ আমরা প্রবেশ করতে পারবো না। কারন এখানে প্রবেশ করার জন্য আলাদা অনুমতি নিতে হয়। যেটি আমরা পেয়েছি পরদিন রাত ১.৩০ মিনিটে। উক্ত সময়েই শুধুমাত্র আমরা সেখানে প্রবেশ করতে পারবো। ৩০৯ নং গেট দিয়ে হারাম শরিফে প্রবেশ করি আমরা। সুবিশাল চত্বর। সারি সারি দাড়িয়ে আছে ছাতাগুলো। যদিও এখন বন্ধ অবস্থায় আছে। ছাতা সাধারনত দিনের বেলায় খোলা থাকে। কি প্রশান্তির যায়গা। দূর থেকেই রাসূল (সঃ) এর রওজার উপরের সবুজ মিনার দেখা যাচ্ছে। চোখ জুড়ানো মন ভ’লানো সে দৃশ্য। আমরা হারাম শরিফের এই সৌন্দর্য্য দেখতে দেখতে মসজিদে নববীর মূল চত্বরের দিকে এগিয়ে যায়। ৬নং গেট দিয়ে আমরা মসজিদে নববীতে প্রবেশ করি। সারি সারি পিলারের সাথে অসাধারন কারুকার্য। ছোট বেলায় যেটি প্রথম দেখেছিলাম বিটিভির আজানের সময়। তখন বিটিভিতে আজান প্রচারের সময় মসজিদে নববীর এই দৃশ্য দেখানো হতো। মসজিদে নববীর এক পাশে রিয়াজুল জান্নাহ। যেখানে শায়িত আছেন আমার নবী। আমরা নবীর রওজার পাশে যেয়ে নবীকে সালাম জানাই। অসাধারন একটি মসজিদ এই সমজিদে নববী। হৃদয়ের সাথে মনও জুড়িয়ে যাবে আপনার।

রাসূল (সঃ) এর হাতেগড়া মসজিদ এই মসজিদে নববী। নবী (সঃ) মদিনায় আগমনের পর সবচেয়ে প্রথম ও গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল একটি মসজিদ নির্মাণ করা। হযরত মুহাম্মদ(সাঃ) যেখানে অবস্থান করছিলেন, তার নিকটেই দুই ইয়াতিমের কিছু অনাবাদী জমি ছিল। নগদ মূল্যে তাদের কাছ থেকে এই জমিটি খরিদ করা হলো। তারই ওপর মসজিদের নির্মাণ কাজ শুরু হলো। হযরত (সাঃ) সাধারণ মজুরের ন্যায় সবার সাথে মিলে কাজ করলেন। স্বহস্থে তিনি ইট-পাথর বয়ে আনলেন। মসজিদটি অত্যন্ত সাদাসিদা ভাবে নির্মিত হলো। কাঁচা ইটের দেয়াল, খেজুর গাছের খুঁটি এবং খেজুর পাতার ছাউনি - এই ছিল এর উপকরণ। মসজিদের কিবলা হলো বায়তুল মুকাদ্দিসের দিকে। কেননা, তখন পর্যন্ত মুসলমানদের কিবলা ছিল ঐ দিকে। অতঃপর কিবলা কা’বামুখী হলে তদনুযায়ী মসজিদের সংস্কার করা হলো। মসজিদের একপাশে একটি উঁচু চত্বর নির্মিত হলো। এর নাম রাখা হলো ‘ সুফফা’। যে সব নও মুসলিমের কোন বাড়ি-ঘর ছিলো না। এটি ছিল তাদের থাকবার জায়গা। সেই খেজুর গাছের দ্বারা নির্মীত মসজিদ এখন কয়েকধাপে সংষ্কার হয়ে বর্তমান ইসলামি শিল্পনৈপুণ্যের এক অনুপম নিদর্শন।

পরদিন সকাল। আমরা আজ মদিনার ঐতিহাসিক কিছু স্থান জিয়ারাহ করবো। তবে শুক্রবার হওয়ায় আমাদের প্রথম টার্গেট হলো মসজিদে নববীতে জুম্মার নামাজ আদায় করা। ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে নাস্তা শেষ করে আমরা মসজিদে নববীর দিকে অগ্রসর হই। দশ লক্ষ মুসল্লি এখানে এক সাথে নামাজ আদায় করতে পারে। আমরা আজানের পূর্বেই মসজিদে প্রবেশ করি। কাবার ন্যায় এখানেও মেহমানদের জন্য জমজমের পানি পান করার সুব্যবস্থা রয়েছে।আমরা প্রবেশ করেই পানি পান করলাম। আজান হলো এবং পরপরই খুতবা শুরু হলো। অসাধারন সুললীত কন্ঠে খুতবা দিচ্ছেন খতিব সাহেব। মসজিদুল হারাম এবং মসজিদে নববীতে জুম্মার নামাজ আদায়েরও এক বিশেষ ফজিলত রয়েছে। আল্লাহ আমাদের এই সুযোগ করে দেওয়ায় আবারও আমরা আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করি আলহামদুলিল্লাহ। নামাজ শেষ করে হোটেল এ ফিরে দুপুরের খাবার গ্রহণকরি। আগে থেকেই আমাদের জন্য নিজের গাড়ী নিয়ে অপেক্ষা করছিলে সৌদি প্রবাসী প্রিয় মেহেরুল ভাই। অমায়িক একজন মেহমান প্রিয় মানুষ আমাদের মেহেরুল ভাই । আমরা হোটেল থেকে নেমে তার গাড়িতে চেপে রওনা হয়ে যায় নবীর শহর জিয়ারাহ এর উদ্দেশ্যে। সরাসরি আমরা চলে যায় ওহুদের ময়দানে। আহহা! ওহুদের স্মৃতি মনে হতেই আমার প্রিয় নবীর আহত হবার কথা মনে পড়ে যায়। বেদনায় ভারী হয়ে ওঠে হৃদয়।-চলবে
-লেখক:জেনারেল ম্যানেজার, এগ্রোভেট ফার্মা