রাজধানীতে জলাবদ্ধতার কারণ ও প্রতিকার

সমীরণ বিশ্বাস: সাধারণভাবে ৪০ মিলিমিটারের বেশি বৃষ্টি না হলে ঢাকায় জলাবদ্ধতা হওয়ার কথা নয় ৷ কিন্তু এখন সাধারণ বৃষ্টিতেই ডুবে যায় দেড় কোটির বেশি মানুষের ঢাকা শহর৷ সৃষ্টি হয় ভোগান্তির ৷ রাজধানীতে জলাবদ্ধতা টানা বৃষ্টিতে নাজেহাল অবস্থা দেখা দিয়েছে রাজধানী ঢাকার অর্ধশতাধিক এলাকায়।

পানি নিষ্কাশনের অধিকাংশ চ্যানেল অকার্যকর হয়ে পড়ায় এমন পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে। ফলে রাস্তাঘাট থেকে শুরু করে মানুষের বাসাবাড়ি ও দোকানপাটেও পানি উঠে যাচ্ছে। সড়কে যান চলাচলে সমস্যা হচ্ছে। কাজেও যোগ দিতে পারছেন না কর্মব্যস্ত মানুষ। ফলে ঢাকা এলাকার বাসিন্দাদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ভয়াবহ দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। বিচ্ছিন্ন পরিকল্পনা নয়, বরং কোন এলাকার পানি কোন পথ দিয়ে বের করে দিতে হবে, তা নিয়ে সব সংস্থাকে একসঙ্গে একটি মহাপরিকল্পনা করতে হবে। বৃষ্টি না হলে ঢাকায় জলাবদ্ধতা হওয়ার কথা নয় ৷ কিন্তু এখন সাধারণ বৃষ্টিতেই ডুবে যায় দেড় কোটির বেশি মানুষের ঢাকা শহর৷ সৃষ্টি হয় ভোগান্তির৷

দেখা গেছে ঢাকায় ২৪ ঘন্টায় বৃষ্টিপাত ৮১ মিলিমিটার হলে তৈরি এ জলাবদ্ধতা ছয়-সাত ঘন্টা স্থায়ী হয়৷ ঠিক তখন নগরবাসী পানিবন্দি হয়ে ঘরে কাটায় ৷ কিন্তু নগরবাসী ঘরে থাকলেও পানিতো তার স্বভাব-ধর্মে ঢুকে পড়ে বাড়ি ঘরেও ৷ বাংলামটর, শান্তিনগর, ইস্কাটন, মগবাজার, কারওয়ান বাজারের মত এলাকায় অনেক বাড়ির নিচতলায় পানি ঢুকে যায় ৷ আর মিরপুরেতো কথাই নেই ৷ মোহাম্মদপুর এলাকেতেও একই অবস্থা ৷ ঢাকা শহরের নিচু এলাকাগুলো যেমন, রামপুরা, বাড্ডার মত এলাকাতো বৃষ্টি হলেই জলাবদ্ধতার শিকার হয়৷

ঢাকার ড্রেনেজ সিস্টেম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে:
একটু বৃষ্টি হলেই ঢাকায় কেন জলাবদ্ধতা তৈরি হয় ? আর এর জবাবে যা জানা গেল তার মূল কথা হলো, ঢাকার বৃষ্টির পানি সহজে সরতে পারেনা ৷ সামনে আরো বেশি জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হবে ৷ ঘরে ঘরে পানি ঢুকবে ৷ কারণ অপরিকল্পিত ঘর বাড়ি নির্মানের জন্য ঢাকা শহরের ড্রেনেজ সিস্টেম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে ৷ পানি সরতে পারছেনা ৷ আবার ড্রেন যা আছে তাও কার্যকর নয় ৷ বক্স কালভার্টের গভীরতা ছিলো নয় ফুট থেকে ১১ ফুট৷ এখন আছে দেড় ফুট থেকে দুই ফুট ৷

ঢাকা ওয়াসার ৬৫ কিলোমিটার খোলা খাল ও বক্সকালভার্ট আছে ৷ কিন্তু এসবের কিছুই তেমন কাজে আসেনা ৷ এর সাথে যুক্ত হয়েছে রাজধানীবাসীর বর্জ্য ৷ এক গবেষণায় দেখা গেছে, রাজধানী ঢাকায় প্রতিদিন ছয় হাজার ১১০ টন গৃহস্থালি বর্জ্য উৎপাদিত হচ্ছে ৷

বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় যত চ্যালেঞ্জ:
ঢাকায় বর্জ্য ব্যবস্থাপনাই দুই সিটির বড় চ্যালেঞ্জ। গত কয়েকদিন ধরে থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছে। ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় ব্যাপক উদ্যোগ নিলেও ড্রেনেজ সিস্টেমের কারণে তা সফলতার মুখ দেখতে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। আর নগরবাসীর অসচেতনতাও এর জন্য অনেকটা দায়ী। বর্জ্য এবং পলি ব্যাগ তারা নির্ধারিত জায়গা বা ডাস্টবিনে না ফেলে ড্রেনে ফেলায় তা ড্রেনেজ ব্যবস্থাকেও অনেকটা অচল করে দেয়। বর্জ্য প্রতি বছরই অনেক জায়গায়ই ড্রেন আটকে দেয়। কমিউনিটি পর্যায়ের ড্রেন নিয়ে কোনো কাজ হচ্ছে না।

জলাবদ্ধতায় বিদ্যুতের ছোবল:
অতিবৃষ্টি এবং জলাবদ্ধতার সাথে যুক্ত হয়েছে ,২১ সেপ্টেম্বর রাত ১০ টার দিকে ঝিলপাড় বস্তি এলাকার সড়কে এ দুর্ঘটনা । বিদ্যুতের ছেঁড়া তারের সংস্পর্শে যাওয়ায় ১ জন শিশু, ১ জন নারী ও ২জন পুরুষ মারা যায় একই পরিবারের ৪ জন সদস্য।

জলবায়ু পরিবর্তন:
দ্রুত বাড়ছে সমুদ্রের উচ্চতা এবং তাপমাত্রা ৷ তাতে ক্রমশ জোয়ারের পানির নীচে তলিয়ে যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন জনপদ ৷ জলবায়ু পরিবর্তনের ধাক্কা লাগছে সারা দেশ জুরে ৷ অতিবৃষ্টিতে জলবাদ্ধতার সমস্যা দেখা দিচ্ছে ৷ জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অসময়ের অনাকাঙ্ক্ষিত অতিবৃষ্টি ঢাকা শহরে জলাবদ্ধতার আরেকটি বিশেষ কারণ ।

রাজধানীতে জলাবদ্ধতার শিকার এলাকা:
মিরপুর সাংবাদিক কলোনি, কাজীপাড়া, শেওড়াপাড়া, সেনপাড়া,মনিপুরীপাড়া, তেজতুরী বাজার, হাতিরঝিলের আশপাশ, মেরুল বাড্ডা, ধানমন্ডি সাতাশ, আজিমপুর-নিউমার্কেট, পুরান ঢাকা, আরামবাগ-ফকিরাপুল,মতিঝিলিএবং রাজারবাগ।

কেন এই জলাবদ্ধতা:
গোপীবাগে ঢাকা ওয়াসার তিনটি পাম্প রয়েছে। এগুলোর প্রতিটির সক্ষমতা প্রতি ঘণ্টায় ১৮ হাজার কিউবিক মিটার। সচিবালয়, গুলিস্তান ও বঙ্গভবনসহ আশপাশের এলাকায় ঘণ্টায় ৩০ থেকে ৩৫ মিলিমিটার বৃষ্টি হলে এসব পাম্প দিয়ে যে পরিমাণ পানি অপসারণ করা যায় তাতে জলজট হবে না। এর বেশি হলে জলাবদ্ধতা দেখা দেয়।ভারী বর্ষণের পানি দ্রুত নিষ্কাশন করতে হলে ওয়াসার পাম্পের ক্যাপাসিটি বাড়াতে হবে।

রাজধানীতে বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনের জন্য সাড়ে ৮ কিলোমিটার বক্স কালভার্ট এবং ৩৫০ কিলোমিটার স্টর্ম সুয়ারেজ লাইন রয়েছে। বৃষ্টির পানি এই দুই মাধ্যমে বিভিন্ন নিচু এলাকা, জলাশয়, খাল বা নদীতে গিয়ে পড়ে। বক্স কালভার্ট ও ড্রেন দেখাশোনার দায়িত্ব ঢাকা ওয়াসার। পাশাপাশি ঢাকায় প্রায় ২ হাজার ৪০০ কিলোমিটার ড্রেন রয়েছে। এর মধ্যে দুই সিটি করপোরেশনের ২ হাজার এবং ওয়াসার ৪০০ কিলোমিটার ড্রেন রয়েছে। এই ড্রেনের মাধ্যমেই বৃষ্টির পানি বক্স কালভার্ট বা স্টর্ম সুয়ারেজ লাইনে নিয়ে ফেলা হয়।
ঢাকাকে জলাবদ্ধতামুক্ত করতে হলে বৃহৎ কর্মপরিকল্পনা নিতে হবে। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পরিকল্পনা দিয়ে জলাবদ্ধতার সাময়িক সমাধান হলেও টেকসই সমাধান হবে না। কোন এলাকার পানি কোন পথ দিয়ে কীভাবে আউট করতে হবে সে বিষয়ে আগে সব সংস্থার যৌথ পরিকল্পনা করতে হবে। এরপর কাজ শুরু করতে হবে। তা না হলে একেক এলাকা নিয়ে একেক বছর সমস্যায় থাকতে হবে। রাজধানীতে জলাবদ্ধতা

বছর বছর খালগুলো পরিষ্কার করা। শ্যাওড়াপাড়া এলাকায় ড্রেন নির্মাণ ধির গতি। আর ঢাকার উন্মুক্ত জায়গা নেই বললেই চলে। যে কারণে বৃষ্টি হলেই সেই পানি বাসাবাড়ির ছাদ হয়ে রাস্তায় চলে আসে। এই পানিগুলো আবদ্ধ করে রাখার মতো কোনও উন্মুক্ত জায়গা নেই। যদি থাকতো তাহলে কিছু পানি ভূগর্ভে চলে যেতো। বাকি পানি ড্রেন ও নালা দিয়ে খাল হয়ে আশপাশের নদীতে চলে যেতো। তখন জলাবদ্ধতা হতো না। তাই জলাবদ্ধতা নিরসনে কৃত্রিমভাবে ড্রেন নির্মাণ করে সেগুলো সচল রাখতে হবে। সাথে সাথে দখলি খাল উদ্ধার করতে হবে।

ঢাকার জলাবদ্ধতার নেপথ্যে খাল দখল:
ঢাকা শহরে একসময় ৬৫টি খাল ছিল। ২০০৮ সালের এক জরিপে দেখা যায়, রাজধানীতে একসময় ৪৪টি খাল ছিল। যার মধ্যে ৩৫টি খাল শুকিয়ে গেছে। বর্তমানে ২৬টি খাল আছে শুধু তালিকায়, বাস্তবে নেই। ১৩টি খালের প্রস্থ ১০ ফুটের বেশি নয়। রাজধানীতে জলাবদ্ধতার নেপথ্যে এর খালগুলোর অবৈধভাবে দখল ও ভরাট হয়ে যাওয়াকে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, খাল, জলাধার ও নিম্নাঞ্চল দখল ও ভরাটের কারণে ঢাকা শহরে জলাবদ্ধতা হচ্ছে। প্রাকৃতিক পানি নিষ্কাশন নালাগুলোয় দখলদারিত্ব চলছে। ঢাকার জলাবদ্ধতা সমস্যা সমাধানের জন্য চারপাশের নদী ও খালগুলোকে দখলমুক্ত করে নব্যতা ও পানি ধারণের ক্ষমতা বাড়াতে হবে। রাজধানীর বেশিরভাগ খালের অস্থিত্ব হারিয়ে গেছে। খালের উপর অবৈধভাবে স্থাপনা গড়ে ওঠার কারণে দেখে বোঝার উপায় নাই যে এখানে একসময় খাল ছিল। আবার যেগুলোর অস্তিত্ব আছে, সেগুলোর নদীর সাথে সংযোগ নেই। পরিচ্ছন্নতার অভাবে ময়লা-আবর্জনা জমে বন্ধ হয়ে গেছে পানির প্রবাহ। ফলে স্বাভাবিক বৃষ্টিতেই তলিয়ে যায় অলিগলি থেকে শুরু করে প্রধান সড়কগুলো। একটু ঝুম বৃষ্টি হলেই নগর জীবনে নামে সীমাহীন দুর্ভোগ।

ঢাকার জলাবদ্ধতার কারণ ও প্রতিকার:
যেসব কারণ ঢাকার জলাবদ্ধতা ও নগর বন্যার জন্য দায়ী মনে করা হয় সেগুলোর হল :
১. নগরীতে যতগুলো প্রাকৃতিক খাল আছে তার অনেকাংশ দখল ও ভরাট হওয়ার কারণে বৃষ্টির পানি দ্রুত নিষ্কাশন হতে পারছে না।
২. জলাশয় ও ডোবা বৃষ্টির পানির আধার হিসেবে কাজ করে থাকে। অবৈধভাবে অনেক জলাশয় ভরে সেখানে ঘরবাড়ি, আবাসন প্রকল্প, অফিস ভবন অথবা শপিংমল করা হয়েছে।
৩. ঢাকা অতিদ্রুত নগরায়ণের ফলে বৃষ্টির পানির সব অংশই নর্দমা ও প্রাকৃতিক খালের মধ্যে যাচ্ছে এবং মাটির নিচে তেমন পানির প্রবাহ যেতে পারছে না।
৪. কার্যকর বর্জ্য ব্যবস্থাপনার অভাবে ময়লা-আবর্জনায় নর্দমা ও প্রাকৃতিক খাল ভরাট হয়ে বৃষ্টির পানি প্রবাহের ক্ষমতা অনেকাংশেই হ্রাস পেয়েছে।
৫. ড্রেনেজ ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যুক্ত একাধিক সংস্থার মধ্যে কার্যকর সমন্নয়হীনতা এ সংকটকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
৬. গ্রিন গ্যাস নিঃসরণের মাত্রা বৃদ্ধির কারণে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বৃষ্টির তীব্রতা ও বন্যার সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে বলে অনেক গবেষণায় প্রকাশিত হয়েছে।
৭. নগর বন্যার কার্যকর আগাম সতর্কতা ব্যবস্থা না থাকায় আগাম পরিকল্পনা, রেগুলেটর ও পাম্প পরিচালনায় সমন্নয়হীনতা দেখা দেয়।
৮. অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও কার্যকর পরিকল্পনার অভাবে অল্প বৃষ্টিতেই জলাবদ্ধতা ও নগর বন্যা দেখা দিচ্ছে।
৯. রেগুলেটর ও স্লুইস গেট নষ্ট হয়ে যাওয়া ও সঠিকভাবে পরিচলনা না করার কারণে ধীরগতিতে পানি নিষ্কাশন হচ্ছে।
১০. ঢাকার চারদিকের নদীগুলো ভরাট হওয়ার কারণে নদীর পানি ধীরগতিতে নামছে ও নগর বন্যার স্থায়িত্ব বাড়ছে।
১১. রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিংয়ের মাধ্যমে বাড়ির ছাদের বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ ও তা মাটির নিচে প্রবাহ করার ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।
১২. প্লাস্টিক ব্যাগ ও সিঙ্গেল ব্যবহারের প্লাস্টিক অবশ্যই জরুরিভিত্তিতে নিষিদ্ধ করতে হবে।
১৩. ঢাকার চারদিকের নদী ইন্টেলিজেন্ট ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে খনন করা ও নাব্যতা বৃদ্ধি জরুরি।
১৪. নাগরিক সচেতনতা বাড়ানো, যাতে ময়লা-আবর্জনা নর্দমা ও প্রাকৃতিক খালে না ফেলা হয়। বাড়ি তৈরির বালু, ইট, পাথর ও খোয়া অবশ্যই ঢেকে রাখা দরকার।
১৫. জলাবদ্ধতা ও নগর বন্যা ব্যবস্থাপনার জন্য একটি উচ্চপর্যায়ের কারিগরি কমিটি করা প্রয়োজন।

নগরীর জলাবদ্ধতা ও নগর বন্যা রোধে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়ার এখনই উপযুক্ত সময়। অন্যথায় আমাদের অল্প বৃষ্টিতেই নগর বন্যার কবলে প্রতিনিয়ত পড়তে হবে, যা নগরবাসীর কাম্য নয়।

লেখক: সমীরণ বিশ্বাস, লিড-এগ্রিকালচারিস্ট, ঢাকা।