আগস্ট মাস আমাদের কান্নার মাস

ড. মো. সিদ্দিকুর রহমান: আগস্ট মাস শোকের মাস। বাঙালির হৃদয়ের রক্তক্ষরণের মাস। এ মাসেই বাঙালি তাঁর শ্রেষ্ঠ সন্তানকে হারিয়েছে। মানুষ মরণশীল। জন্মিলে মরিতে হইবে সৃষ্টিকর্তার এক অমোঘ সত্যি। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড বা তাঁর মৃত্যু বাঙালিকে এতিম করে দিয়ে গেছে।

বঙ্গবন্ধু সশরীরে বেঁচে নাই এটা যেমন সত্যি তেমনি বেঁচে থাকলে আজ শত বছর ছুঁয়ে যেতেন। মাত্র পঞ্চান্ন বছর বেঁচেছিলেন ইতিহাসের এই রাখাল রাজা। কি এমন বয়স হয়েছিল? এখনকার গড় আয়ুর তুলনায় সেটা ছিল অল্প। এই অল্প কিছুদিন বেঁচে থেকে কি অবিশ্বাস্য সব অর্জনই না তিনি করেছিলেন। পাশাপাশি অনেক কষ্ট তাঁকে সহ্য করতে হয়েছিল। জেলজুলুম নির্যাতন ছিল তাঁর নিত্য সঙ্গী। সব কিছুই তিনি করেছিলেন বাংলার জন্য বাঙালির জন্য। বঙ্গবন্ধু যদি আর বিশটি বছর কাজ করার সুযোগ পেতেন। স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রধান ও একক নেতা হিসেবে, জাতির পিতা হিসেবে দেশের জন্য দুই দশক কাজ করার সুযোগ পেলে বাংলাদেশ অনেক আগেই বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতো।

পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্ট ঘাতকেরা তাঁকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করে। বঙ্গবন্ধুর বাংলায় বঙ্গবন্ধু বেঁচে নাই এ এক অবিশ্বাস্য ব্যাপার। সদ্য স্বাধীন দেশে যখন বঙ্গবন্ধু দেশ গড়ার কাজে নিজেকে এবং দেশবাসীকে আত্মনিয়োগ করার জন্য কোমর বেঁধে নেমেছিলেন, যখন একটি স্থিতিশীল অবস্থায় দেশ পৌঁছেছিল ঠিক তখনই চক্রান্তকারীরা দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে বঙ্গবন্ধুকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেয়। ভাবা যায়? স্বাধীনতার সাড়ে তিন বছরের একটু বেশী সময়ে মহান স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধুর বাংলায় বঙ্গবন্ধু বেঁচে নেই।

আগস্ট মাস আমাদের কান্নার মাস। এই মাসে আমরা হারিয়েছি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তাঁর পরিবারের সদস্য তিনপুত্র শেখ কামাল, শেখ জামাল ও শেখ রাসেল, পুত্রবধু সুলতানা কামাল, পারভিন রোজী, ছোট ভাই শেখ আবু নাসের, ভগ্নিপতি আব্দুর রব সেরনিয়াবাত, আওয়ামী যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা শেখ ফজলুল হক মণি এবং বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিবকে। দেশের বাইরে অবস্থান করার কারণে সেদিন প্রাণে বেঁচে যান বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। জাতির জনক কে হত্যার মধ্য দিয়ে বাঙালির ইতিহাসে অমোচনীয় কলঙ্ক লেপন করে বিপদগামী সেনারা। জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর পরিবার পরিজনদের শাহাদত বরণের এ দিনে মহান আল্লাহর কাছে আমরা তাঁদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি এবং সশ্রদ্ধ চিত্তে তাঁদের স্মরণ করছি।

বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে স্বাধীনতা বিরোধী কুচক্রী হায়নার দল ইতিহাসের চাকা পিছনে ঘুরিয়ে দেয়ার ষড়যন্ত্র শুরু হয়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে হত্যা করে তারা স্বাধীনতা বিরোধীদের পুনর্বাসনের কার্যক্রমে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। জাতি হতবিহবল হয়ে দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে নিন্দাজ্ঞাপনের মাধ্যমে এই ঘৃণীত কার্য প্রত্যক্ষ করতে থাকে।

বঙ্গবন্ধুকে দৈহিকভাবে হত্যা করা হলেও তাঁর মৃত্যু নেই। তিনি চিরঞ্জীব। কেননা একটি জাতি রাষ্ট্রের স্বপ্নদ্রষ্টা এবং স্থপতি তিনিই। যতদিন এ পৃথিবী থাকবে, ততদিন অমর তিনি। সমগ্র জাতিকে তিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রেরণায় প্রস্তুত করেছিলেন ঔপনিবেশিক শাসক-শোষক পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তাই চিরজীব তিনি এ জাতির চেতনায়। বঙ্গবন্ধু কেবল একজন ব্যক্তি নন, এক মহান আদর্শের নাম। যে আদর্শে উজ্জীবিত হয়েছিল গোটা দেশ। বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রেরণায় বাঙালিত্বে উজ্জীবিত করেছিলেন, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র আর ধর্মনিরপেক্ষ দর্শনে দেশের সংবিধানও প্রণয়ণ করেছিলেন স্বাধীনতার স্থপতি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। শোষক আর শোষিতে বিভক্ত বিশ্বস্ততায় বঙ্গবন্ধু ছিলেন শোষিতের পক্ষে।

শত্রুদের নীল নকসাকে নস্যাৎ করে শত বাধা সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে জাতি ঘুরে দাড়ায় এবং বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের দাবিতে সোচ্চার হয়। ১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধুর কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে ১৫ আগস্টের হত্যার বিচার শুরু হয়। ২০০৯ এ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর আদর্শ অনুসরণ করে বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক মহলে পরিচিতি করেছেন উন্নয়নের 'রোল মডেল' হিসেবে। শত বাধা বিপত্তি অতিক্রম করে করোনা মহামারির মধ্যেও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় সকলে ঐক্যবদ্ধ হয়ে নিষ্ঠার সাথে কাজ করে যাচ্ছে। নানা ষড়যন্ত্র সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। রায়ের আংশিক বাস্তবায়ন হয়েছে। জাতির প্রত্যাশা বাকী খুনিদের দেশে ফিরিয়ে এনে রায়ের পূর্ণ বাস্তবায়ন করা হউক।

লেখক: প্রফেসর, মেডিসিন বিভাগ, ভেটেরিনারি অনুষদ, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ