বাংলাদেশের কৃষিতে নারীর অবদান

সমীরণ বিশ্বাস: জ্ঞানের লক্ষ্মী, গানের লক্ষ্মী, শস্য-লক্ষ্মী নারী, সুষমা-লক্ষ্মী নারীই ফিরিছে রূপে সঞ্চারী। শস্যক্ষেত্র উর্বর হলো, পুরুষ চালাল হাল, নারী সেই মাঠে শস্য রোপিয়া করিল সুশ্যামল। নর বাহে হাল, নারী বহে জল, সেই জল মাটি মিশে ফসল হইয়া ফলিয়া উঠিল সোনালী ধানের শীষে। 

যে নারী কৃষির অগ্রদূত, যে নারী আমাদের কৃষি সমাজ সংসারকে মহিমান্বিত করেছে জীবনের সবটুকু বিনিয়োগ দিয়ে তার কষ্টগাথা আসলেই এখনো অমানবিক। এ দেশে ৮৫% নারীর উপার্জনের স্বাধীনতা নেই। মাত্র ১৫% নারী নিজের ইচ্ছায় উপার্জনের স্বাধীনতা পান। আর যারা আয় করেন তাদের প্রায় ২৪% এরই নিজের আয়ের ওপর নিয়ন্ত্রণ নেই।

দেশে বর্তমান জনসংখ্যার অুনপাত পুরুষ: মহিলা হলো ১০৬:১০০। আমাদের এ দেশে ৯২% পরিবার পুরুষ শাসিত আর মাত্র ৮% পরিবার মহিলা শাসিত। শহরের তুলনায় গ্রামের মহিলাদের প্রভাব একটু বেশি। সাধারণভাবে শিক্ষার হার পুরুষ ৪৫.৫% আর মহিলা ২৪.২%। শহরে একটু ভিন্ন। শহরে ৫২.৫% আর গ্রামে ২০.২০%। একই পরিমাণ সময় একসঙ্গে কাজ করার পর পুরুষরা মহিলাদের চেয়ে বেশি মজুরি পান, অথচ দেখা যায় মহিলারা পুরুষের তুলনায় বেশি কাজ করেন। মোট মহিলাদের মধ্যে ৭১.৫% কৃষি কাজে নিয়োজিত আর সে তুলনায় ৬০.৩% পুরুষ কৃষি কাজে নিয়োজিত। মোট কৃষি ৪৫.৬% বিনামূল্যে মহিলারা শ্রম দেন আর বাকি ৫৪.৪% অংশ শ্রম টাকার বিনিময়ে কেনা হয়। জমির মালিকানায় পুরুষের আছে ৮১%। আর নারীর মাত্র ১৯%।

কৃষিতে নারীর সংশ্লিষ্টতা অবদান ব্যাপক ও বিস্তৃত। এর মধ্যে কিছু উল্লেখযোগ্য হলো; বীজ সংরক্ষণ; বীজ বাছাই, শোধন ও অঙ্কুরোদগম বীজ শোধন; বীজতলায় বীজ বপন; চারা তোলা; চারা রোপণ; কৃষি পঞ্জিকা পুষ্টিসম্মত রান্না কৌশল; খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ; কর্তন উত্তর কৌশল; শস্য সংরক্ষণ; কৃষি উৎপাদন পরিকল্পনা; কৃষি শ্রমিক ব্যবস্থাপনা; জৈবকৃষি; মুরগি পালন; হাঁস পালন; ছাগল পালন; গরু পালন; দুধ দোহন; গরু মোটাতাজাকরণ; ডিম ফোটানো; হাঁস-মুরগি পালন; বসতবাড়িতে শাকসবজি ফল ফুল চাষ; ভেষজ চাষ; কবুতর পালন; কোয়েল পালন; নার্সারি ব্যবস্থাপনা; মাতৃগাছ ব্যবস্থাপনা; মৌচাষ ; শীতল পাটি হোগলা তৈরি; অঙ্গজ বংশবিস্তার; বায়োগ্যাস কার্যক্রম; বনসাই/অর্কিড/ক্যাকটাস চাষ; কুল বার্ডিং; খাঁচায় মাছ চাষ; পুকুরে আধুনিক উপায়ে মাছ চাষ; জ্যাম জেলি আচার কেচাপ স্যুপ আমসত্ত্ব তালসত্ত্ব; মাছের সাথে হাঁস-মুরগির চাষ; ভাসমান সবজি চাষ; ঘাস চাষ; উন্নত চুলায় রান্না; কুটির শিল্প; মাশরুম চাষ; আলুর কলার চিপস; চানাচুর তৈরি; ছাদে বাগান; বাহারি মাছ; পারিবারিক শাকসবজি সংগ্রহ; পারিবারিক শাক ফলমূল সংরক্ষণ; জ্বালানি সংগ্রহ; কৃষি বনায়ন; সামাজিক বনায়ন- এর সবগুলোতেই নারী সংশ্লিষ্ট।

কৃষিতে নারীর অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা বিশ্ব খাদ্য দিবসের প্রতিপাদ্য হিসেবে বেছে নিয়েছিল ১৯৮৪ ’’কৃষিতে নারী’’ ১৯৯৯ ’’অন্ন জোগায় নারী’’ এ স্লোগান নির্ধারিত হয়েছিল।

নারী শ্রম শক্তির মধ্যে ৬৮ শতাংশই কৃষি, বনায়ন ও মৎস্য খাতের সাথে জড়িত। কর্মক্ষম নারীদের মধ্যে কৃষিকাজে সবচেয়ে বেশি নারী নিয়োজিত রয়েছেন। যা দিন দিন আরো ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে।এখানে একটি কথা বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, বর্তমানে বাংলাদেশে ব্যাপক পরিমাণ যুবতী নিজেকে আধুনিক কৃষিতে আত্মনিয়োগ করছেন। পাশাপাশি এদেশে তৈরি হচ্ছে উল্লেখযোগ্য কৃষি নারী উদ্যোক্তা। ফসলের প্রাক বপন প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে ফসল উত্তোলন, বীজ সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াজাতকরণ এমন কি বিপণন পর্যন্ত অনেক কাজ নারী এককভাবেই করে। বলা চলে কৃষি ও এর উপখাতের মূল চালিকাশক্তি হচ্ছে নারী। কৃষিতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নারীর শ্রম ও অংশগ্রহণ বিশ্বব্যাপী সর্বজনবিদিত।

আধুনিক কৃষি তথা কৃষিতে ডিজিটালাইজেশনেও বাংলাদেশের নারী কৃষকরা প্রতিনিয়ত এগিয়ে চলছে। বাংলাদেশের বর্তমানে ১৪ শতাংশ নারী ইন্টারনেট ব্যবহার করেন এবং ৬৪ শতাংশ গ্রামীণ নারী মোবাইল ফোন ব্যবহার করে। এছাড়া বর্তমানে বাংলাদেশের নারী কৃষাণীরা বিভিন্ন রকমের আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতি ব্যবহারেও দিন দিন সচেষ্ট হচ্ছে।

১৯৯৯-২০০০ থেকে ২০০৯-২০১০ সময়ে দেশে কৃষি, বন ও মৎস্য, পশুপালন, হাঁস-মুরগি পালন, মাছচাষ, কৃষিকাজে নিয়োজিত নারীশ্রমিকের সংখ্যা ৩৭ লাখ থেকে বেড়ে প্রায় ৮০ লাখ হয়েছে। এ বৃদ্ধির হার ১শ’ ১৬ শতাংশ। যদিও এসব নারীশ্রমিকের ৭২ শতাংশই অবৈতনিক পারিবারিক নারীশ্রমিক। ৭৭ শতাংশ গ্রামীণ নারী কৃষিসংক্রান্ত কাজে নিয়োজিত থাকলেও তাদের স্বীকৃতি সেভাবে নেই। কৃষিতে কিষাণীর অবদানের রাষ্ট্রীয়ভাবে কৃষি মন্ত্রণালয়ের আওতায় স্বীকৃতি ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে। কৃষিখাতের ২১টি কাজের ধাপের মধ্যে নারীর অংশগ্রহণ ১৭টি ধাপে । কৃষি কাজে নারীর স্বীকৃতি মর্যদা সম্মান, জাতীয় কৃষক নীতি ও নারী কৃষক এবং নারী কৃষক সংগঠন তৈরি এখন সময়ের দাবি।

নারী কৃষি শ্রমিকদের নিবন্ধন ও পরিচয়পত্র প্রদান, একই ধরনের কাজে পুরুষের সমান মজুরি নিশ্চিত করা, বেশি কাজে বেশি সম্মান স্বীকৃতি, সরকারি কৃষি কর্মকাণ্ডে নারীদের অগ্রাধিকার দেয়া, কৃষিকাজে নারী শ্রমিকদের পেশাগত স্বাস্থ্য নিশ্চিত করা, প্রান্তিক সুবিধাদি ও সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে নারী কৃষিশ্রমিক তথা কৃষাণীদের অগ্রাধিকার দেয়াসহ আরো বেশ কিছু পদক্ষেপ নেয়ার সুপারিশ এখন নীতি নির্ধারকের হাতে।
লেখক: লিড-এগ্রিকালচারিস্ট, ঢাকা।