মাষকলাই: পুষ্টি গুণাগুণ, চাষাবাদ কলাকৌশল ও এর শারীরবৃত্তীয় গুরুত্ব

Category: গবেষণা ফিচার Written by agrilife24

মোঃ মোহাইমিনুল ইসলাম: মাষকলাই বাংলাদেশের ডাল জাতীয় ফসলগুলোর মধ্যে Fabacaeae গোত্রের অন্তর্ভুক্ত অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি ফসল। বাংলাদেশে প্রচলিত ডাল শস্যসমূহ মসুর, মুগ, খেসারি, ছোলার পাশাপাশি মাষকলাইও বেশ জনপ্রিয় একটি ডালশস্য। বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকা, নেপাল, ভূটান, ভিয়েতনাম, কানাডাসহ ইউরোপের অনেক দেশে এটি আমিষ জাতীয় খাদ্য হিসেবে গৃহীত হয়েছে। এছাড়াও এর উপকারী দিক ও খাদ্যাভ্যাস এটিকে মানুষের মাঝে জনপ্রিয় করে তুলেছে। আজকাল বিভিন্ন প্রক্রিয়াজাত খাদ্য প্রস্তুতিতেও এটি দেশে-বিদেশে ব্যবহৃত হচ্ছে।

মাষকলাই এর পুষ্টিগুণ: বাংলাদেশ ও ভারতের বিভিন্ন প্রদেশ ছাড়াও নেপাল ও ভিয়েতনামে মাষকলাই ডাল হিসেবে রান্না করা হয়; তবে সবজি ও মাংসের সাথেও এটি রান্না করা যায়। খিচুড়ী রান্নাতেও এটি বহুল ব্যবহৃত একটি ডাল। এছাড়া মাষকলাইয়ের আটার রুটিও বাংলাদেশের অনেক জেলায় প্রসিদ্ধ। পুষ্টিগুণ বিচারে প্রতি ১০০ গ্রাম ডালে রয়েছে ২০-২৫ গ্রাম আমিষ, ৩৫-৪০ মিলিগ্রাম সোডিয়াম, ১৩৫-১৪০ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম, ৯৫০-৯৮০ মিলিগ্রাম পটাশিয়াম এবং ৭.৫ মিলিগ্রাম আয়রন, এছাড়াও রয়েছে ভিটামিন বি ও শর্করা। শক্তির বিবেচনায় প্রতি শ’ গ্রাম ডালে প্রায় ৩৫০ ক্যালোরি শক্তি পাওয়া যায়।

চাষাবাদ কলাকৌশল: মাষকলাই দেশের চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলাসহ উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাসমূহে অধিক চাষ করা হয়ে থাকে। আগস্ট মাসের মাঝামাঝি থেকে সেপ্টেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত মাষকলাই এর বীজ বপন করা যায়। তবে বিলম্বে বীজ বপন না করাই ভালো। মাষকলাই চাষের জন্য সাধারণত সার প্রয়োগের প্রয়োজন হয় না; তবে জমি ভেদে ৬ কেজি ইউরিয়া, ১৬ কেজি টিএসপি ও ৮ কেজি এমওপি সার ব্যবহার করা যায়। বীজ ছিটিয়ে বা লাইনে সারি করে বপন করা যায় এবং সাধারণত একর প্রতি ৮ থেকে ৯ কেজি বীজ প্রয়োজন হয়।

মাষের প্রচলিত জাতগুলোর মধ্যে বিনামাষ-১, ২; বারিমাষ-১, ২, ৩ এবং স্থানীয় জাতের মধ্যে রাজশাহী ও সাধুহাটি কৃষকরা চাষ করে থাকেন। চারা গজানোর ২০ থেকে ২৫ দিন পর আগাছা পরিষ্কার করে দিতে হয় এবং সাধারণত সেঁচের প্রয়োজন পড়ে না। মাষকলাই চাষে সাধারণত রোগ-বালাই কম দেখা যায়। তবে হলুদ মোজাইক রোগ ও পাতা-পচা রোগ দেখা দিলে ছত্রাকনাশক ব্যবহার করতে হবে। এক্ষেত্রে ডায়াথেন এম-৪৫ বা অন্য ছত্রাকনাশক স্প্রে আকারে ব্যবহার করা যায়। পোকামাকড়ের উপদ্রব দেখা দিলে ম্যালাথিয়ন-৫৭ ইসি বা সিম্বুস ইত্যাদি কীটনাশক মাত্রানুযায়ী ব্যবহার করে সুফল পাওয়া যায়। ফল (পড) পরিপক্ক হলে দুই থেকে তিন ধাপে সংগ্রহ করতে হবে। কাঁছি দিয়ে গোঁড়া থেকে গাছ কেটে ফল সংগ্রহ করলে মাটিতে নাইট্রোজেন সংবন্ধন ভালো হয়। সংগৃহীত বীজ রোদে ভালোভাবে শুকিয়ে, পরিষ্কার ও ঠান্ডা করে মাটির পাত্রে মুখ বন্ধ করে অনেকদিন পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যায়। জাত ভেদে মাষকলাই এর ফলন হেক্টর প্রতি ১.৩-২ টন পর্যন্ত পাওয়া যায়।

মাষকলাইয়ের শারীরবৃত্তীয় গুরুত্ব: আমিষ, ভিটামিন বি ও পরিপাকযোগ্য আঁশের উৎস হচ্ছে এই ডাল। মাষকলাইয়ের ডাল শরীরের কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণ করতে ও রক্তে পটাশশিয়াম-সোডিয়াম এর ভারসাম্য বজায় রাখতে এবং ম্যাগনেসিয়াম এর মাধ্যমে রক্ত প্রবাহ স্বাভাবিক রেখে হৃদযন্ত্র ভালো রাখতে সাহায্য করে। পেশী গঠনে এই ডাল আমিষের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে ও হজম শক্তি বাড়িয়ে কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে এই ডালের গুরুত্ব অপরিসীম। এই ডালে উপস্থিত আয়রন শরীরের বল বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে। আয়ুর্বেদ শাস্ত্রমতে, মাষকলাইয়ের ডাল সাইনোভিয়াল জয়েন্ট এর ব্যথা, ডিমেনশিয়া, সিজোফ্রেনিয়া, হিস্টোরিয়ার মত সমস্যা সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এছাড়া ত্বক পরিষ্কারক, মুখের দাগ দূর করতে ও স্কালপ পরিষ্কার করে খুশকি সমস্যা সমাধানে সহায়তা করে বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে। শুধু তাই নয় মাষকলাই এর গাছ মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি, গবাদি পশুর খাদ্য ও জ্বালানি হিসেবে ও ব্যবহৃত হয়।

পরিশেষে বলা যায়, দেশের মোট উৎপাদিত ডালের প্রায় ১০ থেকে ১১ শতাংশ আসে এই মাষকলাইয়ের ডাল থেকে। পুষ্টিগুণ বিচারেও মাষকলাই আমিষের গুরুত্বপূর্ণ চাহিদা মিটিয়ে যাচ্ছে। তাই এর চাষাবাদ সম্প্রসারণে আরো উদ্যোগী হওয়া প্রয়োজন।
লেখক-বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, ফলিত গবেষণা ও সম্প্রসারণ বিভাগ, বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা)
বাকৃবি চত্বর, ময়মনসিংহ-২২০২