নিরাপদ মাংস উৎপাদনে আধুনিক ও স্বাস্থসম্মত কসাইখানা নিশ্চিত করা জরুরি

Category: গবেষণা ফিচার Written by agrilife24

ড. সৈয়দ মোহাম্মদ এহসানুর রহমান:দৈনন্দিন জীবনে আমিষের চাহিদা পূরণে মাংসের অবদান অনস্বীকার্য। প্রতিদিন মাথাপিছু ১২০ গ্রাম মাংসের চাহিদা রয়ে সেখানে আমরা মাথাপিছু ১৪৭.৮৪ গ্রাম মাংস পাচ্ছি যা চাহিদার তুলনায় প্রতুল (DLS, ২০২১-২২)। বর্তমানে আমাদের দেশে মাংস উৎপাদনে স্বয়ংসর্ম্পূণ কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে মাংস উৎপাদন ও প্রক্রিয়াজাতকরণে আমরা অনেক পিছিয়ে আছি। ময়মনসিংহ শহরের বিভিন্ন কসাইখানা ঘুরলে এর বেহাল দশা লক্ষ করা যায়।

অতিপ্রিয় এই মাংস আমাদের জন্য কতখানি স্বাস্থ্যকর ও এ থেকে আমরা কতটুকু প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান গ্রহণ করতে পারছি এবং অস্বাস্থ্যকর মাংস আমাদের জন্য কতটুকু ক্ষতিকর আলোচ্য প্রতিবেদনে এ সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে।

ময়মনসিংহ শহরের গাঙ্গিনার পাড় বাণিজ্যিক এলাকায় একটি ছাগল-ভেড়ার কসাইকানা রয়েছে। বিভিন্ন জায়গা থেকে মানুষ এখানে ছাগল-ভেড়া জবাই করতে নিয়ে আসে। গড়ে ১০০ টি ছাগল-ভেড়া প্রতিদিন এখানে জবাই হয়। পৌরসভার এই কসাইখানার সাথে জেলা প্রাণিসম্পদ অফিসের সমন্বয়ের অভাব রয়েছে। অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে জবাই হচ্ছে ছাগল-ভেড়া। পর্যাপ্ত পানির ব্যবস্থা না থাকার কারণে জবাইয়ের সাথে সাথে বর্জ্য পদার্থ সরানো সম্ভব হচ্ছে না। এখানে জবাইকৃত পশুর রক্ত ও অন্যান্য উপজাত সংগ্রহের কোন ভাল ব্যবস্থা নেই। তাছাড়া অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা যেমন জবাইয়ের পূর্বে ছাগল-ভেড়া রাখার জায়গা, ড্রেন, পানির হাউজ ইত্যাদি থাকা সত্ত্বেও সচেতনতা এবং সংস্কারের অভাবে ব্যবহার করা সম্ভব হচ্ছে না। কোন ধরণের জীবানুনাশকও ব্যবহার করতে দেখা যায় নি এখানে। তাছাড়া ভগ্ন প্রায় এই কসাইখানার ছাদও নেই। এছাড়া কসাইরা অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের জন্য স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে থাকে।



কসাইরা জানিয়েছেন তাদের সদিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও সুযোগ সুবিধার অভাবে স্বাস্থ্যসম্মত মাংস উৎপাদন সম্ভব হচ্ছে না। পৌরসভার কসাইখানা পরিদর্শক আব্দুল মান্নানের সাথে কথা বলে জানা যায় তার দায়িত্বপালনে সীমাবদ্ধতা ও অপারগতার কথা; অকপটে তিনি স্বীকার করেন।নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত কসাইখানা ব্যবস্থাপনা, পশু জবাই ও মাংস উৎপাদনের প্রয়োজনীয় জ্ঞানের অভাব রয়েছে তার।

ছাগল-ভেড়ার একটি কসাইখানা ও মাংসের বাজার থাকলেও গরুর জন্য এর একটিও নেই। ময়মনসিংহ শহরের মাংসের চাহিদা পূরণ করার জন্য মরাখোলা, কাচিঝুলি এবং বিভিন্ন রাস্তার পাশে ও কসাইদের বাড়িতে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে জবাই হচ্ছে গরু। কসাইখানার প্রয়োজনীয়তা উপলদ্ধি করে সরকার Urban Governance and Infrastructure Improvement Project (UGIIP) প্রকল্পের মাধ্যমে সারা দেশে কসাইখানা নির্মাণ শুরু করেছিল কিন্তু তা আর আলোর মুখ দেখেনি।  উক্ত বিষয়ে পারদর্শী কোন পরামর্শক নিয়োগ করা হয়নি যার ফলশ্রুততিে কসাইখানা স্থাপনের পরিকল্পনাটি ক্রটিপূর্ণ রয়েছে এবং এখানে পৌরসভার সাথে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের সমন্বয়হীনতা সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

মাংস বিভিন্ন রোগসৃষ্টিকারী ভাইরাস ব্যাকটেরিয়ার জন্য অত্যন্ত অনুকূল মাধ্যম। আমাদের আশে-পাশের নালা-নর্দমা, রাস্তা, বাজার ইত্যাদি জায়গায় এসব রোগজীবাণু ছড়িয়ে আছে। এর মধ্যে এন্থ্রাক্স, ব্রুসলেসসি, টিউবারকিউলোসিস, টেনিয়াসিস ইত্যাদি গুরুত্বর্পূণ। যখন রাস্তার আশে-পাশে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে গরু ছাগল জবাই করা হয় এসব রোগজীবাণু মাংসের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে এবং মাংসের মাধ্যমে আমাদের দেহে প্রবেশ করে। অনেক সময় এগুলো আমাদের দেহে রোগের সৃষ্টি করে। তাই স্বাস্থ্যকর কসাইখানা আমাদের জন্য গুরুত্বর্পূণ।



জবাইয়ের পূর্বে পশু পর্যবেক্ষণ করা হয় না যা আইন পরিপন্থী। যার কারণে আমরা প্রতিনিয়তই রোগাক্রান্ত গরু ছাগলের মাংস খাওয়ার আশংকায় থাকি। তাছাড়া মাংসের পঁচন ও প্রক্রিয়াজাতকরণ সম্পর্কে কসাইদের এবং ক্রেতাদের ধারণা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। গবেষকদের মতে জবাই করার পর ২৪ ঘন্টা মাংস হিমাগারে রাখলে তা আমাদের খাওয়ার উপযোগী হয়। কারণ মাংসের ভিতরে বিভিন্ন ধরণের বিক্রিয়া যেমন, রিগরমরটিস, অক্সিডেশন রিডাকসন ইত্যাদি জবাইয়ের পরও চলতে থাকে। আমরা যদি জবাইয়ের পরপরই মাংস খাই তাতে প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান পাই না। আমাদের দেশে জবাই করার পর এ ধরণের কোন ব্যবস্থা নেয়া হয় না। উন্নতমানের কাইখানা থাকলে মাংসের পুষ্টিগত মান রক্ষা করা সম্ভব।

অপরদিকে মুক্তাগাছায় অবস্থিত কসাইখানাটির চিত্র আরও খারাপ। এখানে গড়ে প্রতিদিন ১০-১২ টি গরু জবাই হয়। এটি অস্বাস্থ্যকর ও নোংরা। এটি বসতবাড়ী সংলগ্ন এবং এর বর্জ্য নিষ্কাশনের কোন ব্যবস্থা নেই যার ফলে অত্র এলাকার লোকজন মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুকিতে রয়েছে।
আমরা সবাই জানি মাংস একটি অত্যন্ত পচনশীল খাদ্য। বেশী সময় খোলা রাখলে তার গুণগত ও পুষ্টিগত মান বিনষ্ট হয়। আমাদের দেশের কসাই, মাংস বিক্রেতা ও ক্রেতাদের এ সম্পর্কে ধারণা খুবই কম। ময়মনসিংহের মাংসের বাজারগুলো ঘুরে দেখা যায় যে, এখানে ২৪ ঘন্টা পর্যন্ত মাংস বাইরে খোলা বাজারে বিক্রি করা হয়, যার পুষ্টিগত মান থাকে না বললেই চলে। এছাড়াও বিভিন্ন জীবাণু দ্বারা সংক্রামিত হতে পারে।

বাজার ঘুরে মাংস ক্রেতাদের সাথে আলোচনা করে জানা গেল, তাদের এই মাংসের দোকানগুলোর উপরই নির্ভর করতে হয়। ভাল মাংসের চাহিদা থাকা সত্ত্বেও শুধুমাত্র সুযোগ সুবিধা ও প্রয়োজনীয় জ্ঞানের অভাবে আমরা ভাল মানের পুষ্টি সম্পন্ন মাংস খাওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছি। তাছাড়া মাংসের গ্রেডিং এর কোন ব্যবস্থা আমাদের নেই। ক্রেতাদের তুলনা করার কোন সুযোগ নেই। পৌর কর্তৃপক্ষের নামমাত্র সিলের উপর ভিত্তি করে মাংস কিনতে হয় ক্রেতাদের। ক্রেতা বিক্রেতা সবারই চাহিদা মাংসের গুণগত মান নিশ্চিত করা।

আমাদের দেশে চাহিদার তুলনায় মাংসের সরবরাহ অত্যন্ত অপ্রতুল। প্রায় ৮২% অভাব রয়েছে এই মাংস খাতে। যে পরিমাণ মাংস আমরা পাই আমাদের উচিত তার সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করা। এবং সেই সাথে আমাদের খাদ্য ও পরিবেশের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। আমাদের দেশে এই শিল্পের প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে। তাই আমাদের নিম্নে বর্ণিত পদক্ষেপগুলো নিতে হবে -
●  পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধা সম্পন্ন আধুনিক কসাইখানা গড়ে তোলা।
●  পথে ঘাটে গরু-ছাগল জবাইয়ের বরিুদ্ধে জনসচেতনতা গড়ে তোলা।
●  নিরাপদ মাংস উৎপাদন ও ভক্ষণের জন্য জনসচেতনতা তৈরি করা এবং এ লক্ষ্যে বিভিন্ন গবেষণা, সভা, সেমিনারের আয়োজন
    করা।
●  গ্রেডিং পদ্ধতিতে মাংসের বাজারের মান নিয়ন্ত্রণ করা।
●  কসাইদের নিজেদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা, স্বাস্থ্য সম্মত মাংস উৎপাদন ও বাজারজাতকরন সম্পর্কে ট্রেনিং প্রদান।
●  সর্বোপরি পশু জবাই আইন এর যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করা।

লেখক:প্রফেসর, পশু বিজ্ঞান বিভাগ, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়।