দেশের সেচ ব্যবস্থার উন্নয়ন ও আধুনিকীকরণে বিএডিসি’র ভূমিকা

Category: গবেষণা ফিচার Written by agrilife24

ইমরুল কায়েস মির্জা কিরণ:কৃষি মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন (বিএডিসি) দেশের কৃষকদের নিকট কৃষি উপকরণের সহজপ্রাপ্যতা নিশ্চিতকল্পে এবং দেশের সেচ এলাকা সম্প্রসারণের কাজ ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে কাজ করে যাচ্ছে। ১৯৬১ সালে যাত্রা শুরু করা সুপ্রাচীন এ প্রতিষ্ঠানটি খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে উচ্চ ফলনশীল বিভিন্ন ফসলের বীজ উৎপাদন, সংরক্ষণ ও সরবরাহ বৃদ্ধি করা, সেচ প্রযুক্তি উন্নয়ন, ভূ-উপরিস্থ পানির সর্বোত্তম ব্যবহার, জলাবদ্ধতা দূরীকরণ, সেচ দক্ষতা ও সেচকৃত এলাকা বৃদ্ধি এবং কৃষক পর্যায়ে মানসম্পন্ন নন-নাইট্রোজেনাস সার সরবরাহ করে যাচ্ছে।

১৯৬০ এর দশকে মাত্র ১৫৫৫ টি শক্তিচালিত পাম্পের মাধ্যমে বিএডিসি কর্তৃক দেশে আধুনিক সেচ ও কৃষি যান্ত্রিকীকরণ ব্যবস্থার প্রচলন ঘটে।  স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু কৃষি বিপ্লবের উপর অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়েছিলেন। সেচের সম্প্রসারণ ও উন্নয়নে নিয়েছিলেন যুগান্তকারী পদক্ষেপ। তিনি নগদ ভর্তুকি ও সহজ শর্তে ঋণ দিয়ে কৃষকের মাঝে সেচযন্ত্র বিক্রির ব্যবস্থা করেন। জামার্নি থেকে জরুরী ভিত্তিতে পানির পাম্প এনেছিলেন। ১৯৭১-৭২ সাল থেকে ১৯৭৪-৭৫ সালে-এই ৩ বছরে অগভীর নলকূপের সংখ্যা ৬৮৫টি থেকে বেড়ে ৪০২৯টি, গভীর নলকূপের সংখ্যা ৯০৬টি থেকে ২৯০০টি এবং পাওয়ার পাম্পের সংখ্যা ২৪২৪৩টি থেকে ৪০০০০টি তে দাড়ায়।



পানির টেকসই ব্যবহার ও পানিসম্পদের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার জন্য ভূ-উপরিস্থ পানির ব্যবহার বাড়াতে সরকার অত্যন্ত গুরুত্ব দিচ্ছে। নদী-খাল খনন ও পুনঃখনন, রাবার ড্যাম নির্মাণ, জলাধার নির্মাণ, পানি সাশ্রয়ী পদ্ধতির ব্যবহারসহ অনেক উদ্যোগ বাস্তবায়ন করেছে। বিএডিসি বিভিন্ন প্রকল্প ও কর্মসূচির মাধ্যমে খাল পুনঃখননের মাধ্যমে একদিকে যেমন জলাবদ্ধতা দূর করে চাষযোগ্য জমির পরিমাণ বৃদ্ধি করছে তেমনি আধুনিক প্রযুক্তির যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমে সেচ ব্যবস্থার উন্নয়নের দ্বারা চর অঞ্চলকেও নিয়ে এসেছে চাষের আওতায়। ভ্রাম্যমান সোলার এল এল পি পাম্প ব্যবহারের মাধ্যমে দেশের উত্তর অঞ্চলের চর এলাকয় সবুজের সমারহ ঘটিয়েছে বিএডিসি। ফলে দেশের অর্থনীতিতে যোগ হযেছে নতুন মাত্রা।

এছাড়া পানি সাশ্রয়ী সেচ প্রযুক্তি এবং পরিবেশ বান্ধব পলিশেড নির্মাণের মাধ্যমে নিরাপদ ও রপ্তানীযোগ্য সবজি, ফুল ও ফল উৎপাদন বৃদ্ধিকরণে দক্ষতার সাথে কাজ করে যাচ্ছে বিএডিসি’র ক্ষুদ্রসেচ উইং।

উল্লেখ্য, ভূগর্ভস্থ পানির স্তর পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে পানির টেকসই ব্যবহার ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার জন্য ১৯৬৭-৬৮ সালে বিএডিসি প্রাথমিক পর্যায়ে কন্ট্রাক গ্যাজের মাধ্যমে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর পরিমাপ কার্যক্রম শুরু করে। সম্প্রতি ‘ক্ষুদ্রসেচ উন্নয়নে জরিপ ও পরিবীক্ষণ ডিজিটালাইজেশনকরণ প্রকল্প’ এর আওতায় প্রতিটি উপজেলায় ১ টি করে অর্থাৎ ৪৬টি ওয়াটার লেভেল ডাটা লগার স্থাপন করা হয়েছে। এর মাধ্যমে ভূগর্ভস্থ পানির অবস্থানচিত্র তৈরি এবং সময়ে সময়ে তা হালনাগাদ করা হচ্ছে। এছাড়াও স্পেস টেকনোলজি ও রিমোর্ট সেন্সিং এর মাধ্যমে নিয়মিত পর্যবেক্ষণ, তথ্য সংগ্রহ এবং জিআইএস এর মাধ্যমে বিশ্লেষণ করে পানির স্তরের হালনাগাদ তথ্য দেয়া হচ্ছে।

২০৩০ সাল নাগাদ এসডিজি (SDG) বাস্তবায়নের লক্ষ্যে বিএডিসি ক্ষুদ্রসেচ উইং এর ভিশন:

২০২০-২১ সেচ মৌসুমে সারাদেশে সেচকৃত জমির পরিমাণ ৫৬.৫৪ লক্ষ হেক্টর। ক্ষুদ্রসেচের মাধ্যমে গত বোরো মৌসুমে ৭২.৫% সেচযোগ্য জমিতে সেচ প্রদান করা হয়েছে। খাদ্য উৎপাদনে দেশে দুই ধরনের সেচ কার্যক্রম প্রচলিত আছে-বৃহৎ সেচ ও ক্ষুদ্র সেচ। রবি মৌসুমে ক্ষুদ্র সেচের মাধ্যমে ৯৫% এবং বৃহৎ সেচের মাধ্যমে ৫% জমিতে সেচ প্রদান করা হচ্ছে। এর মধ্যে সারা দেশে ভূ-উপরিস্থ পানির সাহায্যে ২৭.০১% এবং ভূগর্ভস্থ পানির সাহায্যে ৭২.৯% জমিতে সেচ প্রদান করা হচ্ছে।

বর্তমান কৃষিবান্ধব সরকারের নির্বাচনী ইশতেহার-২০১৮ অনুযায়ী পুষ্টিসম্মত ও নিরাপদ খাদ্যের নিশ্চয়তা ও কৃষি ব্যবস্থায় যান্ত্রিকীকরণের মাধ্যমে সুখী-সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে রূপকল্প-২০২১ সফলভাবে সম্পন্নকরণের মাধ্যমে মধ্যম আয়ের দেশ, ২০৩০ সালের মধ্যে এসডিজি (SDG) বাস্তবায়ন, ২০৪১ সালের মধ্যে একটি উন্নত ও সমৃদ্ধ দেশের মর্যাদা অর্জন এবং শতবর্ষী ব-দ্বীপ পরিকল্পনা (Delta Plan-২১০০) এর আলোকে বিএডিসি ক্ষুদ্রসেচ উইং খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য বহুমুখী সেচ সেবা গ্রহণ করেছে। ফসলের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি ও উৎপাদন খরচ কমানোর ক্ষেত্রে সেচ ব্যবস্থাপনার বিকল্প নাই। বর্তমানে বিএডিসি’র ক্ষুদ্রসেচ উইং সেচ ব্যবস্থাপনার আধুনিক কলা-কৌশল মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়ন করেছে।

খাল/নালা ও পুকুর খনন/পুনঃখনন/সংস্কার কার্যক্রমের মাধ্যমে ভূ-উপরিস্থ পানির যথাযথ ব্যবহারের মাধ্যমে সেচ সুবিধা বৃদ্ধি এবং জলাবদ্ধতা দূরীকরণের মাধ্যমে পতিত জমিকে চাষের আওতায় নিয়ে এসে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে অবদান রাখা, সেচযন্ত্রে স্মার্ট কার্ড বেইজ্ড প্রিপেইড মিটার স্থাপনের মাধ্যমে সেচ দক্ষতা ও সেচের পানির অপচয় রোধকরণ, নবায়নযোগ্য জ্বালানী যেমন সৌরশক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে এল এল পি এবং ডাগওয়েল স্থাপনের মাধ্যমে সেচ কার্যক্রম পরিচালনা, সেচ কাজে ভূ-উপরিস্থ পানি সম্পদের প্রাপ্যতা বৃদ্ধিও লক্ষ্যে লাগসই ও টেকসই প্রযুক্তি ব্যবহার, সম্প্রসারণ ও সুসংহত করার কার্যক্রম গ্রহণ  (যেমন- রাবার ড্যাম, হাইড্রোলিক এলিভেটেড ড্যাম নির্মাণ), পাহাড়ি এলাকায় আর্টেশিয়ান নলকূপ স্থাপনের মাধ্যমে কম খরচে সেচ সুবিধা সম্প্রসারণ, বারিড পাইপ ও পাকা সেচনালা নির্মাণ, ফিতা পাইপের ব্যবহার এবং ড্রিপ ও স্প্রিংকলার সেচ ব্যবস্থা স্থাপনের মাধ্যমে সেচ এলাকা সম্প্রসারণ, সেচের পানির অপচয় রোধ, সেচ খরচ হ্রাস, সেচের নিবিড়তা এবং সেচ দক্ষতা বৃদ্ধিকরণসহ বিভিন্ন কার্যক্রম দক্ষতার সাথে পরিচালনা করছে বিএডিসি’র ক্ষুদ্রসেচ উইং।

দেশব্যাপী ক্ষুদ্রসেচ ব্যবস্থার সম্প্রসারণে অগ্রণী ভূমিকা পালনকারী বিএডিসি’র সেচ উইং জনবলের তীব্র সংকট এবং প্রয়োজনীয় লজিস্টিক সাপোর্টের অভাবে সময়মত কৃষকের দোরগোড়ায় প্রয়োজনীয় সেবা শতভাগ সরবরাহ করতে হিমসিম খাচ্ছে। তাই কৃষিবান্ধব সরকারের উচিৎ কৃষি সেবায় অগ্রণী ভূমিকা পালনকারী এ প্রতিষ্ঠানটিকে সরকারী সুযোগ সুবিধার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দেওয়া। তবেই বাড়বে কৃষির উৎপাদন, সমৃদ্ধ হবে দেশ।

লেখক:সহকারী প্রকৌশলী
বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন (বিএডিসি) ও
সাবেক রিপোর্টার, দি ইন্ডিপেন্ডেন্ট