আমাদের সমাজ, নারীর ক্ষমতায়ন এবং খাদ্যবৈচিত্র্য

Category: গবেষণা ফিচার Written by agrilife24

ড. ছাদেকা হক এবং শারমিন সাইদ প্রিয়াংকা:হাফিজ ও সুমনা প্রতিদিন সন্ধ্যা ৭:০০ টায় বাড়ি ফেরে। সারাদিনের কর্মব্যস্ততা শেষে বাড়ি ফিরে কোন রকমে কাপড় বদলেই হাফিজ বিছানায় শরীর এলিয়ে দেয়। সুমনারও ইচ্ছে হয়, কিন্তু সে সুযোগ তার থাকে না। চাকরি করে সংসার সামলানোকে রীতিমতো একটা যুদ্ধ মনে হয় তার কাছে। বাসায় এসে নিজের রুমে না গিয়ে তার রান্নাঘরে ঢুকতে হয়, রাতের খাবার তৈরি করার জন্য। হাফিজটা যদি একটু তাকে সঙ্গ দিতো তাহলে হয়ত কাজগুলো তাড়াতাড়িই শেষ করা যেত। কিন্তু, হাফিজ একদমই ঘরের কাজে সাহায্য করতে চায় না, এমনকি নিজের কাজটাও সে নিজে করে না।

এই দৃশ্য আমাদের দেশের প্রায় প্রতিটি পরিবারের। অথচ, সাধারণ দৃষ্টিকোণ থেকে কারও কাছে যদি জানতে চাওয়া হয়, নারীর ক্ষমতায়ন বলতে কি বোঝায়’, বেশির ভাগ মানুষই উত্তর দিবেন ‘নারীর অর্থ উপার্জন ক্ষমতাকেই তার ক্ষমতায়ন বলে’। কিন্তু উপার্জনক্ষম সুমনা কি পাচ্ছেন বিশ্রাম বা অবসরের সুযোগ?

এবার আমাদের পাশের বাসার এক দম্পতির কথা বলি। স্বামী-স্ত্রী দুজনেই শিক্ষিত এবং কর্মজীবী। কিন্তু, স্বামী তার স্ত্রীর উপার্জিত আয় প্রতি মাসে বেতন হওয়া মাত্র নিজের কাছে নিয়ে নেন। নিজের উপার্জিত টাকা দিয়ে স্ত্রী কিছু করতে চাইলে কিংবা কাউকে দিতে চাইলে স্বামীর কাছে অনুমতি নিতে হয়।

গবেষণায় দেখা গেছে, নারীর ক্ষমতায়ন কেবল অর্থ উপার্জন নয়, বরং উপার্জিত অর্থ নিজের পছন্দমতো ব্যয় করার অধিকারও এ ক্ষমতায়নের একটি নির্দেশক। আবার অনেকেই বলেন, নারীকেই অর্থ উপার্জন করতে হবে বিষয়টা তা নয়। স্বামী কিংবা পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তির অর্থ নিজ প্রয়োজনমত খরচ করাও ক্ষমতায়ন। বাস্তবতা হলো, গ্রামে এমনকি শহরেও উপার্জনক্ষম নারীদের উপার্জিত অর্থ ব্যয় করার ক্ষেত্রে স্বামীদের উপর নির্ভর করতে হয়।

একজন কর্মজীবী পুরুষ কাজ থেকে বাড়িতে ফিরে বিশ্রাম নেয় কিন্তু কর্মজীবী নারী বাড়িতে ফিরে গৃহস্থালীর কাজ, সন্তানদের দেখাশোনা প্রভৃতি কাজ করে। এই কাজ যদি স্বামী-স্ত্রী দুজনে মিলে করে তাহলে দুজনেই অল্প সময় হলেও বিশ্রাম নিতে পারবে। প্রয়োজনমতো বিশ্রাম বা অবসরের সুযোগও ক্ষমতায়নের একটি নির্দেশক।

বাড়ির আসবাবপত্র ক্রয়, বাজার বা রান্না কী হবে, সন্তানদের স্কুলে পাঠানো, সন্তানদের বিয়ে সংক্রান্ত বিষয় ইত্যাদি সিদ্ধান্তের বেশিরভাগই পরিবারের কর্তা হিসেবে স্বামী নিয়ে থাকেন। স্ত্রীকে কখনও কখনও জানানো কিংবা তার সিদ্ধান্ত জানতে চাওয়া হলেও বাস্তবায়ন হয় স্বামীর সিদ্ধান্তই। পারিবারিক এসকল বিষয়ে সিদ্ধান্ত দিতে পারার অধিকারও নারীর ক্ষমতায়নের একটা মাপকাঠি।

গ্রামাঞ্চলে প্রায় সকল পরিবারের ক্ষেত্রেই দেখা যায় নির্দিষ্ট একটা সময় পর্যন্ত অ-আর্থিক এবং সাংসারিক বিষয়গুলোতে শাশুড়ি বাড়ির প্রধান হিসেবে ভূমিকা পালন করেন। কী বাজার হবে কিংবা কী রান্না হবে তা শাশুড়ি ঠিক করে থাকেন। শাশুড়ি খাবার পাতে বেড়ে দেন, বাড়ির বউ নিজের পছন্দমতো কোন খাবার খেতে পারেন না, কিংবা ভালো মাংস-মাছের টুকরা নিতে পারেন না। কিন্তু, এই পরিবারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ যদি যৌথভাবে ঘটতো তাহলে বাড়ির বউটিকে দিনের পর দিন তার পছন্দের খাবারটি না খেয়ে থাকতে হতো না। তিনি পছন্দমতো বাজার করতে পারতেন কিংবা তার সন্তানদের দৈহিক চাহিদামতো পুষ্টিগুণ বিবেচনা করে রান্না করতে এবং প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় বৈচিত্র্য আনতে পারতেন।

কৃষিকাজের সাথে জড়িত পরিবার সাধারণত উৎপাদিত ফসলের একটা অংশ নিজেদের প্রয়োজনে ব্যবহৃত হয়। ফসল উৎপাদন সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে নারীর সাথে আলোচনা করা হলে নারী তার পরিবারের কথা মাথায় রেখে উৎপাদিতব্য ফসলের ভিন্নতা আনার চেষ্টা করেন। নারী নিজে বাড়ির আশেপাশে সবজি কিংবা ফলের গাছ লাগানোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারলে নিজের তথা পরিবারের পুষ্টির চাহিদা মেটাতে পারবেন। খাবারের বৈচিত্র্য একটি পরিবারকে অপুষ্টি থেকে মুক্ত রাখতে পারে।

গত কয়েক মাস আগে গ্রামের বাড়িতে ঘুরতে যাওয়ার সুবাদে সেখানকার বেশ কিছু নারীর সাথে কথা হয়। তারা অনেকেই জানান গর্ভবতী অবস্থায় তাদের মিষ্টি, ফল কিংবা নানারকম খাবার খেতে ইচ্ছে করলেও অধিকাংশ সময়ই তারা তা খেতে পারেননি। কেননা, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় স্বামী কিংবা পরিবারের পুরুষ সদস্যদের এই বিষয়টি জানাই নেই যে, গর্ভবতী অবস্থায় হরমোন পরিবর্তনজনিত কারণে নারীদের এই সময় অনেক কিছু খেতে ইচ্ছে করে। যদি পরিবারের উপার্জিত অর্থ নারীর নিজ প্রয়োজনমতো খরচের অধিকার থাকতো এবং বাজারে যাওয়ার সুযোগ থাকতো কিংবা এসকল ক্ষেত্রে যৌথভাবে সিদ্ধান্ত গৃহীত হতো তাহলে তিনি তার পছন্দমতো খাবার গ্রহণ করতে পারতেন। কিন্তু, নারীকে অপরের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হয় এবং নানা সংকোচের কারণে হয়ত সে কাউকে বলতেও পারে না এরকম ছোট ছোট ইচ্ছে বা সাধের কথা। গর্ভধারণের মতো সংকটাপন্ন সময়েও খেতে বসার সময় মাছ-মাংসের ভালো টুকরা পরিবারের পুরুষ সদস্য বা ছেলে সন্তান পেয়ে থাকেন। যার ফলে দেখা যায়, আমাদের দেশের নারীরা অপুষ্টিসহ আয়রনের ঘাটতিজনিত সমস্যায় ভোগেন সারা বছর এবং তাদের নবজাতক পরবর্তীতে পুষ্টিহীনতায় ভোগে।

‘ইউএসএইড’-এর ‘ফিড দ্যা ফিউচার’ প্রকল্পের অধীনে কিছু পরিবারকে নারীর সিদ্ধান্ত গ্রহণের আওতায় আনা হয় এবং তাদের সাথে যারা এই প্রকল্পের অধীনে নেই তাদেরকে তুলনা করা হয়। দেখা যায়, প্রকল্প বহির্ভূতদের চেয়ে প্রকল্পের অধীনে যে সকল নারীরা আছেন তাদের এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের খাবারে অধিক বৈচিত্র্য রয়েছে।

পুরুষতান্ত্রিক সমাজে, একজন নারীকে ছোটবেলা হতেই এই শিক্ষা দেয়া হয় যে ভালো খাবার খাওয়ার অধিকার তার ভাইয়ের, বাবার কিংবা পরবর্তীতে তার স্বামীর। সংসারের বিভিন্ন কাজ যেমন সন্তান জন্ম দেওয়া থেকে শুরু করে লালন-পালন এই সব দায়িত্বই তার। পরিবারের আয় কিভাবে, কোথায় বা কি পরিমাণে ব্যয় হবে এসব বড় বড় সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকার বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তার নেই।

একটি কন্যাশিশু পরিণত বয়সে নারী, বিয়ের পর কারও স্ত্রী বা কারও মা হয়ে ওঠেন। তার উপরেই নির্ভর করে ভবিষ্যত প্রজন্ম। তার সঠিক সিদ্ধান্তে তার সন্তান স্কুলে যাবে, পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করবে, উপযুক্ত সময়ে তাদের বিয়ে হবে। তাই, সুন্দর আগামী প্রজন্মের জন্য নারীর সিদ্ধান্ত গ্রহণকে প্রাধান্য দেয়ার বিকল্প নেই।

লেখক:
ড. ছাদেকা হক: প্রফেসর, কৃষি অর্থনীতি বিভাগ, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও
শারমিন সাইদ প্রিয়াংকা: স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী, কৃষি অর্থনীতি বিভাগ, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়