ছাত্র রাজনীতির আদর্শ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান

Category: গবেষণা ফিচার Written by agrilife24

ড. চয়ন গোস্বামী:একটি দেশের ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব তৈরির সঠিক সময় ছাত্রজীবন। আজকের ছাত্র তার দেশপ্রেম ও সাহসী নেতৃত্বের মাধ্যমে শুধু নিজেকে বিকশিত করে না বরং আগামী দিনে দেশ ও জাতিকে সঠিক নেতৃত্ব দিতে নিজেকে প্রস্তুত করেন। নিজেকে সাধারনের সাথে মিশিয়ে দিয়ে তাদের সুবিধা-অসুবিধা সম্পর্কে জানা এবং তাদেরকে অধিকার সচেতন করে তোলা ও অধিকার আদায়ে সক্রিয় করাই ছাত্রনেতৃত্বের প্রধান লক্ষ্য। একজন আদর্শ ছাত্রনেতা বা রাজনৈতিক ছাত্রকর্মী কেমন হতে পারেন, তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

বঙ্গবন্ধুর সারা জীবনের রাজনীতি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৈশোরকাল থেকেই বৈশিষ্ট্যগতভাবেই সমাজসেবী ও পরোপকারী ছিলেন। সহকর্মী বান্ধব শেখ মুজিবুর রহমান তার জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ন্যায্য অধিকার আদায়ের জন্য নেতৃত্ব গুণাবলীর প্রমান রেখে গিয়েছেন। তিনি যখন কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে পড়াশুনা করতে যান তখন নিজের আদর্শ ও চারিত্রিক গুণাবলীর মাধ্যমে সকলের প্রিয় নেতা হয়ে উঠেছিলেন। ছাত্রদের সাথে ভাতৃত্ব সুলভ আচরণ, তাদের সমস্যার কথা জানা এবং সঠিক পন্থা অবলম্বনের মাধ্যমে সমস্যা সমাধান করে বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠেন সকলের আস্থার ঠিকানা। এইসব গুণাবলী পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধুকে বাঙালির মুক্তির দূত হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ গঠনের জাতীয় নেতৃত্বের আসনে অধিষ্ঠিত করে।

বঙ্গবন্ধুর জীবনের বিভিন্ন ঘটনাবলী থেকে তাঁর নেতৃত্ব গুণাবলীর পরিচয় পাওয়া যায়। কিশোর বয়সের একটি ঘটনাসহ এমন আরও কয়েকটি ঘটনার কথা এখানে উল্লেখ করতে চাই। অধিকার সচেতন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের যৌক্তিক আন্দোলনের মাধ্যমে দাবি আদায়ের যে গুণাবলী তার প্রকাশ ঘটে কৈশোরকালেই। ১৯৩৯ সালে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী শের-এ-বাংলা এ কে ফজলুল হক যখন গোপালগঞ্জ মাথুরানাথ ইনস্টিটিউট মিশন স্কুল পরিদর্শনে আসেন তখন শেখ মুজিবুর ছিলেন স্কুলের অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র। প্রধান শিক্ষকের পূর্ব নির্দেশমত স্কুলের শ্রেণীকক্ষ, বারান্দাসহ আঙ্গিনা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকলেও স্কুলের ছাদের ত্রুটির কথা মুখ্যমন্ত্রীর সামনে তুলে ধরতে শেখ মুজিবুর রহমান ভূমিকা রাখেন। ন্যায়ের পক্ষে দৃঢ়চিত্ত কিশোর শেখ মুজিব স্কুলের অন্যান্য ছাত্রদের সাথে নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর পথ আগলে দাঁড়ান এবং সকলের প্রতিনিধি হিসেবে শেখ মুজিব মুখ্যমন্ত্রীকে ছাদের দূরবস্থার কথা জানান। মন্ত্রী মহোদয়কে দাবী জানান যে সামান্য বৃষ্টি হলেই ছাদের ফাটল দিয়ে পানি পড়ে এবং বই খাতা ভিজে যায়। ফলে ক্লাস করতে অসুবিধে হয়। স্কুল কর্তৃপক্ষের উদাসীনতার কথা উল্লেখ করে মন্ত্রী মহোদয়কে ছাদ সংস্কারের জন্য তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা না নিলে পথ ছাড়া হবে না বলেও জানিয়ে দেন। এমন ঘটনায় আশেপাশের সকলেই ভড়কে গেলেও মন্ত্রী মহোদয় সাহসী কিশোর শেখ মুজিবুর রহমানের যৌক্তিক দাবির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ছাদ মেরামত করতে কত টাকা খরচ পরবে তা জিজ্ঞেস করেন। ছাদ সারানোর জন্য ১২০০ টাকার কথা জানতে পেরে মুখ্যমন্ত্রী সংস্কারের জন্য ব্যবস্থা নিতে জেলা প্রশাসককে নির্দেশ দেন এবং নিজের তহবিল থেকে এ টাকার ব্যবস্থা করে দেন। কিশোর বয়সেই যৌক্তিক দাবি আদায়সহ সাধারন ছাত্রদের সমস্যা ও প্রতিকূলতায় সকলের প্রতিনিধি হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করার স্বভাবজাত ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ছিল কিশোর শেখ মুজিবুর রহমানের।

পরবর্তীতে কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে পড়াশোনা করতে গেলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান উপমহাদেশের বিশিষ্ট রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের সংস্পর্শে আসেন এবং ন্যায় ও অধিকার আদায়ে আরও সচেষ্ট হন। সেসময়ে ছাত্র অধিকার সচেতন ও সমাজসেবক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার জনপ্রিয়তার ব্যাপারেও আত্মবিশ্বাসী ছিলেন। তিনি আত্মজীবনীতে ১৯৪৩ সালের ইসলামিয়া কলেজ ছাত্র ইউনিয়নে নির্বাচনের কথা উল্লেখ করতে গিয়ে ছাত্রদের মাঝে উনার জনপ্রিয়তার কথা বলেছেন। বঙ্গবন্ধুর মনোনীত প্রার্থীর বিপুল বিজয় উনাকে যেমন আত্মবিশ্বাসী করেছেন তেমনি উৎসাহ যুগিয়েছে পরবর্তী সময়ে জাতীয় রাজনীতিতে সক্রিয় ভূমিকা রাখার। ত্যাগী ও নির্লোভ নেতা সকলের কাছে জনপ্রিয় হয়ে থাকেন।

ছাত্র ইউনিয়নের নির্বাচনে সহকর্মী জহির উদ্দিনের কথা বলতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু উনাকে একজন নিঃস্বার্থ কর্মী হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন, যিনি পরবর্তীতে ছাত্রদের আস্থা অর্জন করেছিলেন এবং ছাত্র প্রতিনিধিত্ব নির্বাচনে প্রভাব ফেলেছিলেন। ছাত্রদের বিপদের সময় পাশে থাকার মানসিকতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। যে কোন ছাত্রের আপদে-বিপদে বঙ্গবন্ধু পাশে দাঁড়াতেন। শুধু তাই নয় সহপাঠীদের ভরসাস্থল হয়ে উঠেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। যেমন বন্ধুদের কোন অসুবিধা, ছাত্র হোস্টেলে সিট পাওয়া, এমনকি ফ্রি সিট দেয়ার ক্ষেত্রেও বঙ্গবন্ধু প্রিন্সিপাল স্যারের সাথে কথা বলতেন। তবে তিনি কখনো অন্যায় আবদার করতেন না। ফলে শিক্ষকরাও তার যৌক্তিক দাবির প্রতি সমর্থন দিতেন। শিক্ষকদের সহযোগিতায় ছাত্রদের ভালবাসা অর্জনের ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু ছাত্র জীবনের ঘটনাপ্রবাহ সকলের জন্য অনুসরণযোগ্য।

বঙ্গবন্ধু কতটা ত্যাগী ও নিষ্ঠাবান কর্মী ছিলেন ছাত্রজীবনের বিভিন্ন ঘটনা থেকে তার দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। বিভিন্ন জেলার ছাত্রনেতাদের রাখার ব্যবস্থা করার ক্ষেত্রে তিনি নিজের সিট ছেড়ে দিতেন, এমনকি সিট না হওয়া পর্যন্ত নিজের রুমই তাদের জন্য ফ্রি থাকার ব্যবস্থা করে দিতেন। ভোগ বিলাসিতা পরিহার করে নিজের রুম ছেড়ে দিয়ে রোগগ্রস্ত ছাত্রদের জন্য বরাদ্দকৃত রুমে থাকার মত মানসিক দৃঢ়তা ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের। তৎকালীন সময়ে গরীব ছাত্রদের জন্য বেকার হোস্টেলে কিছু ফ্রি রুম ছিল তা কেবল প্রকৃত গরিব ছাত্ররাই পেত এবং ইসলামিয়া কলেজে গরিব ছেলেদের সাহায্য করার জন্য একটা ফান্ড ছিল। ছাত্রদের জন্য কল্যাণকর বিভিন্ন উদ্যোগের ফলে বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠেন সকলের প্রিয় শেখ মুজিব। প্রয়োজনে নিজের বইপত্র অন্য সহপাঠীদের দেয়ার ঘটনাও বঙ্গবন্ধু অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে উল্লেখ করেছেন।

ছাত্রবান্ধব বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ইসলামিয়া কলেজে ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন।
রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সময় মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ যখন ঢাকায় উর্দু পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে বলে ঘোষণা দেন তখন কয়েকজন সেটা মেনে নিলেও বঙ্গবন্ধু অভ্রান্তচিত্তে বলেন “কোন নেতা যদি অন্যায় কাজ করতে বলেন, তার প্রতিবাদ করা এবং তাকে বুঝিয়ে বলার অধিকার জনগণের আছে।” সাধারণ ছাত্ররাও বঙ্গবন্ধুকে সমর্থন করেন। তিনি বলেন- বাংলা শতকরা ছাপ্পানজন লোকের মাতৃভাষা, পাকিস্তান গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র সংখ্যাগুরুদের দাবি মানতে হবে। রাষ্ট্রভাষা বাংলা না হওয়া পর্যন্ত আমরা সংগ্রাম চালিয়ে যাবো, তাতে যাই হোক না কেন আমরা প্রস্তুত আছি। এই যে যুক্তি উপস্থাপনের মাধ্যমে ন্যায় সঙ্গত অধিকার আদায়ের পথে প্রাথমিক পর্যায়ে আলোচনা এবং ক্রমান্বয়ে ধারাবাহিক আন্দোলনের যে মন্ত্র পুথিত ছিল বঙ্গবন্ধুর হৃদয়ে তা পরবর্তীতে স্বাধীন বাংলাদেশ অর্জনের প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করেছে।

ছাত্রনেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধু শুধু সহপাঠীদের অধিকার নিয়ে সোচ্চার ছিলেন এমনটি নয় তিনি বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের অন্যান্যদের ন্যায্য দাবি দাওয়া আদায়েও সক্রিয় ছিলেন। এখানে উল্লেখ্য যে, ১৯৪৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মচারীদের দীর্ঘক্ষণ ডিউটি, বাসস্থানের অপ্রতুলতা, চাকরির অনিশ্চয়তাসহ বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে যে আন্দোলন শুরু হয় তা পরবর্তীতে ধর্মঘটে রূপ নেয়। ছাত্ররা নিম্ন বেতন ভোগী কর্মচারীদের প্রতি সহমর্মিতা জানিয়ে ধর্মঘটে অংশগ্রহণ করে। ধর্মঘটে অংশগ্রহণকারী কর্মচারীদের বরখাস্ত করা হয় এবং পরবর্তীতে কর্মচারীদের আন্দোলনে নৈতিক সমর্থন প্রদান ও সম্পৃক্ততার ফলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবসহ আরো কয়েকজন ছাত্রকেও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়। যদিও পড়ে বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করা হয় তবুও বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের সদস্যের বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়ার মানসিকতা ছাত্রজীবনে বিকশিত হওয়ার মত দৃষ্টান্ত বঙ্গবন্ধুর জীবনীতে আমরা দেখতে পাই।

আমাদের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে এগিয়ে গিয়েছেন এবং নিজেকে কৈশোর কাল থেকেই প্রস্তুত করেছেন দেশ ও জাতির নেতৃত্ব প্রদানের জন্য। এভাবেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তুখোড় ছাত্রনেতা থেকে জাতির মহানায়কে পরিণত হয়ে ছাত্ররাজনীতির জন্য শাশ্বত এক দৃষ্টান্ত রেখে গিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর বর্নিল ঘটনাপ্রবাহ সমৃদ্ধ ছাত্রজীবন বর্তমান সময়ে যারা ছাত্র রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত তাদের জন্য বিশেষভাবে অনুকরণীয় এবং অনুসরণযোগ্য। দল-মত নির্বিশেষে সকল রাজনৈতিক দলের ছাত্রদের জন্য বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী পাঠ অপরিহার্য। আজকের ছাত্র আগামী দিনে দেশের নেতৃত্বের আসনে অধিষ্ঠিত হবে। অধিকার সচেতন, পরোপকারী, নিঃস্বার্থ ও মানবিক গুণাবলী সম্পন্ন ছাত্রনেতা বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে বুকে ধারণ ও লালন করে সুখী-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গঠনে মুখ্য ভূমিকা পালন করবে, এই আমাদের প্রত্যাশা।

লেখক পরিচিতিঃ প্রফেসর ও বিভাগীয় প্রধান, প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগ, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়।