দেশী মুরগীর উৎপাদন দ্বিগুণ করার কৌশল: বাচ্চা পৃথকীকরণ,খাদ্য ও বাসস্থান ব্যবস্থাপনার গুরুত্ব

Category: গবেষণা ফিচার Written by agrilife24

ড. জগৎ চাঁদ মালাকার:বাংলাদেশের অধিকাংশ গ্রামের বাড়িতে দেশী মুরগী পালন করে থাকে এবং এটি প্রাণিজ প্রোটিনের সরবরাহ নিশ্চিত করে থাকে।। পারিবারিক পুষ্টি চাহিদা মিটানোর পাশাপাশি বাড়তি আয়ের ব্যবস্থা হয়। মহিলাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়। দেশী মুরগী পালনে খাবার কম লাগে,দেশী মুরগীর রোগ-ব্যাধি কম হয়। সহজেই পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়ানো যায়, খরচ কম হয়, বাজার মূল্য বেশী থাকে।

দেশী মুরগির সবচেয়ে বড় সুবিধা হল নিজেই তাপ দিয়ে বাচ্চা উৎপাদন করে। মুরগী ডিম ফোটার পর বাচ্চা সহ মুরগী প্রায় তিন মাস বাচ্চাসহ ঘুরবে এবং এই সময়ে মুরগী কোন ডিম দিবে না, অর্থাৎ এভাবে বছরে ৩ বার ডিম ও বাচ্চা দিবে অথচ যদি আমরা ডিম ফোটার ০৭-১৪ দিন বাচ্চাগুলোকে পৃথিকীকরণ করা যায় তাহলে এভাবে বছরে প্রায় ৬ বার ডিম ও বাচ্চা দিবে। মা হতে মুরগীর বাচ্চা আলাদা করলে কৃত্রিম পদ্ধতিতে তাপায়নের ব্যবস্থা করতে হবে। রাতের বেলা হ্যারিকেন অথবা বিদ্যুৎ বাল্ব দিয়ে তাপায়ন দিতে হবে। এক্ষেত্রে ৫০ টি মুরগীর বাচ্চার জন্য ১ টি হ্যারিকেন আর ১০০ টি বাচ্চার জন্য ১০০ ওয়ার্ডের ১টি বাল্ব ব্যবহার করতে হবে। এই সময় বাচ্চার টিকাকরন, সুষম খাদ্য ব্যবস্থাপনা ও বিশুদ্ধ পানি খেতে দিতে হবে।

নিম্নের ছকের মাধ্যমে মুরগীর উৎপাদন চক্র বিষয়টি আরও স্পস্ট করা হলো

প্রায় লক্ষ্য করা যায় যে, সঠিক পরিকল্পনার অভাবে কৃষক/কৃষাণীগণ ভাল উৎপাদন করেও বাজার মূল্যের কারনে তারা আর্থিকভাবে লাভবান হতে পারেন না বরং ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে থাকেন। উৎপাদন ব্যায়ের তুলনায় বাজার মূল্য কম হলে অনেক সময় উন্নত পদ্ধতিতে মুরগীর পালনে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার জন্য চাই সঠিক পরিকল্পনা।

একটি মুরগীর বাজার মূল্য বছরের সবসময় সমান থাকে না। কখনো বেশী বা কখনো কম থাকে। লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে বিভিন্ন কারনে হাঁস মুরগীর বাজারমূল্য উঠা নামা করে থাকে। বাজারে হাঁস মুরগীর এই দাম উঠা নামা করার কারনসমূহের মধ্যে যেমন; ঈদ, রমজান, পিকনিক বা অন্যান্য উৎসবকালীন সময় বা বাজারে হাঁস-মুরগীর সরবরাহ কমে যাওয়া বা বেশি হওয়া ইত্যাদি। বছরের কোন মাসে মুরগীর দাম কম বা বেশী থাকে তা জেনে যদি কৃষক উৎপাদন করাতে পারে বা করে তবে সে সহজেই আর্থিকভাবে লাভবান হতে পারেন। সুতরাং উৎপাদন পরিকল্পনা তৈরীর জন্য বাজার মূল্যের বিষয়টি স্পষ্টভাবে নির্ণয়পূর্বক কৃষকগণ জানা দরকার। এই জন্য বছরের কোন সময় হাঁস-মুরগীর দাম বেশি বা কম থাকে তা সঠিকভাবে নির্ণয় করা এবং সেই অনুযায়ী উৎপাদন শুরুকরা যাতে করে দাম বেশির সময় তার উৎপাদিত হাঁস-মুরগী বাজারজাত করতে পারে।

দাম বাড়ার কারণসমূহঃ সরবরাহ কম, চাহিদা বেশী, উৎপাদন কম, প্রাকৃতিক দূর্যোগ, বিভিন্ন উৎসব (ঈদ, রমজান)। দাম কমার কারণঃ সরবরাহ বেশী, চাহিদা কম, উৎপাদন বেশী হলে, রোগবালাই, অভাব।

দেশীয় মুরগীর বাসস্থান  
আমাদের দেশে দেশীয় মুরগী পালনের ক্ষেত্রে কঙ্খিত সুফল না পাওয়ার যে কয়টি কারন আছে তার মধ্যে অনুন্নত বাসস্থান ব্যবস্থাপনার জন্য অভাবে উৎপাদন অনেক কমে যাচ্ছে এবং কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে।

মুরগীর ঘর সব সময় পরিস্কার পরিচ্ছন্ন ও আলো বাতাস প্রবেশের ব্যবস্থা থাকতে হবে এবং মেঝেতে কাঠের গুড়ি দিলে ঠান্ডা কম লাগবে। শীতের দিন হলে চারিদিকে ছালার চট দিয়ে আটকিয়ে দিতে হবে যাতে বাতাস প্রবেশ করতে না পারে। একটি মুরগীর জন্য এক বর্গ হাত জায়গা লাগবে। এর চেয়ে কম হলে মুরগীর ঘরের পরিবেশ নষ্ট হবে এবং মুরগীর শ্বাস প্রশ্বাসে কষ্ট হবে ও অনেক সময় মুরগী বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হতে পারে। পূর্ব পশ্চিম দিক লম্বা করে দক্ষিণ দিকে মুখ করে মুরগীর ঘর স্থাপন করতে হবে যাতে আলো বাতাস সহজে ঢুকতে পারে।

উন্নত হাজল তৈরী
দেশীয় মুরগী উন্নত পদ্ধতিতে লালন পালনের জন্য হাজল ব্যবহার খুবই গুরুত্বপূর্ণ। হাজল ব্যবহার করলে মুরগীর বাচ্চা ফোটানোর হার অনেক বেশী হয় এবং মা মুরগীর ‘তা’ দেয়ার কারনে শরীরের ওজন হারায় না ফলে মা মুরগী দ্রুত আবার ডিমে আসে। এতে করে মুরগীর উৎপাদন চক্র সময় কমে যায় এবং ফলনের পরিমাণ বেড়ে যায়। তাই হাজল তৈরী করার কৌশল কৃষকরা  হাতে কলমে শেখা খুবই জরুরি।

আদর্শ হাজলের মাপঃ  একটি আদর্শ হাজল এর উপরের দিকে বেড় হবে ১৬ ইঞ্চি, নীচের দিকের বেড় হবে ১০ ইঞ্চি, খাড়া হবে ৭ ইঞ্চি এবং এতে খাদ্য ও পানি দেওয়ার ব্যবস্থা থাকবে।  



উন্নত হাজল ব্যবহারের উপকারিতাঃ
ডিম ফুটার হার বেশী বা উমে ডিম পঁচে কম। উন্নত হাজলে মা মুরগীর জন্য খাবার ও পানি রাখার ব্যবস্থা থাকে এবং সেস্থানে নিয়মিত খাবার ও পানি দিলে মা মুরগী তা প্রয়োজনমত খেতে পারে এতে করে ‘তা’ দেয়ার সময়ে মা মুরগীর শরীরের ওজন হারায় না ফলে পরবর্তীতে সে দ্রুত পুনরায় ডিমে আসে। এটি মাটির তৈরী এবং ভারি বলে কখনো মুরগী উঠা নামার সময় হেলে পড়ে না। এই হাজলে মুরগীর খাবার ও পনি পায় বলে সহজে ‘তা’ থেকে উঠে খাবার পানির জন্য বাহিরে যায় না যার কারনে ‘তা’ দেয়া ভাল হয় এবং ডিম নষ্ট হয় কম।

ডিম বসানোঃ
# ১ টি হাজালে একটি মুরগীর গায়ে ওজনের অর্ধেক পরিমান (একটি দেশী মুরগীর ডিমের ওজন ৩০-৩২ গ্রাম)বা ১৬-২০ টি ডিম দেওয়া যাবে
# বসানোর আগে হাজালে ছাই দিতে হবে ১ ইঞ্চি পরিমান
# তারপর খড়কুটা দেওয়া হয় প্রায় ৩ ইঞ্চি পরিমান
# খড়কুটার মধ্যে ন্যাপথালিন দিতে হবে
# সব কিছুর পরে মুরগী হাজালের সব কলাকৌশল ব্যবহার করার পর সন্ধ্যার সময় বসাতে হবে।

হাঁস-মুরগীর বাচ্চা পালন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। দেশীয় মুরগীর বাচ্চার পালন ব্যবস্থাপনার ক্রুটির জন্য আমাদের দেশে দেশীয় হাঁস-মুরগীর বাচ্চা মৃত্যুর হার অনেক বেশী। কৃষকরা অনেকেই হাঁস-মুরগীর বাচ্চা পালনের কৌশলসমূহ ভালভাবে জানেন না। সঠিকভাবে বাচ্চা পালন করলে হাঁস-মুরগীর উৎপাদন বহুলাংশে বৃদ্ধি করা সম্ভব।

বাচ্চা ফোটার পর বাচ্চার ব্যবস্থাপনা:
বাচ্চা ফোটার পর বাচ্চা এবং মাকে নীচে খড়কুটা দিয়ে তার উপর ছটের ছালা দিয়ে তার উপর রাখতে হবে যেন ঠান্ডা না লেগে যায় এবং পানি অতি সহজেই শুসে নিতে পারে। গরমের দিনে ৫-৭ দিন পর এবং শীতের দিনে ১৪ দিন পর মা মুরগী থেকে বাচ্চা আলাদা করে ফেলতে হবে। এ ক্ষেত্রে প্রতিটি বাচ্চার জন্য ০.৫ বর্গফুট জায়গা হিসাব করে বাচ্চার ঘর তৈরি করতে হবে। এ ক্ষেত্রে বাচ্চার পরিমান বেশী হলে অল্প জায়গায় বেশী বাচ্চা পালন করার জন্য তিনতলা করে ঘর তৈরী করা যেতে পারে এতে জায়গাও কম লাগে আবার ঘর তৈরীর খরচও কম হয়। ঘরের উপরের ছাউনী ছন অথবা খড় দিয়ে তৈরি করতে হব। দিনের বেলা বাচ্চাগুলো ঘরের ভিতর রাখতে হবে। রাতের বেলা বাঁশের ঢোলা অথবা মাছ ধরা খারই ভিতরে খড়কুটা দিয়ে বাচ্চা রাখতে হবে। উপরে পাতলা কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখতে হবে যাতে করে বাচ্চার ঠান্ডা লাগতে না পারে এবং দিনের বেলা বাচ্চা যখন বাচ্চার ঘরে রাখব তখন মেঝেতে শুকনা তুষ অথবা কাঠের গুড়া বিছাইয়া তার উপর চট বিছিয়ে দিতে হবে এবং ২-৩ দিন পর পর পরিস্কার করতে হবে।

মা হতে মুরগীর বাচ্চা আলাদা করলে কৃত্রিম পদ্ধতিতে তাপায়নের ব্যবস্থা করতে হবে। রাতের বেলা হ্যারিকেন অথবা বিদ্যুৎ বাল্ব দিয়ে তাপায়ন দিতে হবে। এক্ষেত্রে ৫০ টি মুরগীর বাচ্চার জন্য ১ টি হ্যারিকেন আর ১০০ টি বাচ্চার জন্য ১০০ ওয়ার্ডের ১টি বাল্ব ব্যবহার করতে হবে।

বাচ্চার অবস্থার উপর ভিত্তি করে তাপায়ন ব্যবস্থাপনাঃ

খাদ্যের উপাদান: খাদ্যের পুষ্টির উপাদানগুলোকে ৬ ভাগে ভাগ করা যায়।
১) শর্করা: শর্করা জাতীয় খাদ্য শরীরে তাপ শক্তি যোগায় যেসব খাবারে শর্করা আছে। ভূট্টা, গম, চালের খুদ, চালের কুড়া ইত্যাদিতে প্রচুর পরিমান শর্করা থাকে।
২) আমিষ: আমিষ দেহের ক্ষয় পূরণ, বৃদ্ধি সাধন এবং ডিম ও মাংস উৎপাদনে সহায়তা করে থাকে। বিভিন্ন ধরণের খৈল যেমন- তিলের খৈল, বাদামের খৈল, সূর্যমুখীর খৈল, সোয়াবিন মিল, ফিস মিল ইত্যাদি আমিষের উৎস।
৩) স্নেহ পদার্থ বা চর্বি: চর্বি শক্তি যোগায় দেহের তাপ সৃষ্টি করে। পালকগুলো চকচকে রাখে। এছাড়া চর্বি মাংসকে সুস্বাদু করে। এটি দেহের তাপ মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে।
৪) ভিটামিন: ভিটামিন রোগ প্রতিরোধ করে। ভিটামিন ২ প্রকার। (১) চর্বিতে দ্রবনীয় ভিটামিন যেমন-ভিটামিন এ, ডি, ই, ও, কে এবং (২) পানিতে দ্রবনীয় ভিটামিন যেমন- সি ও বি কমপ্লেক্স, বিভিন্ন প্রকার শাক-সব্জি, শস্যদানা ইত্যাদিতে ভিটামিন পাওয়া যায়।
৫) খনিজ পদার্থ: খনিজের কাজ- ক্যালসিয়ামের ঘাটতি পূরণ করে ডিমের খোসা তৈরি করে, শরীরের অস্থি কাঠামো তৈরি করে, হাড়ের গুড়া ডিমের খোসা, শামুক, ঝিনুকের গুড়া ইত্যাদি।
৬) পানি: পানির আর এক নাম জীবন। একদিন বয়সের বাচ্চার দেহে ৮৫% পানি থাকে। পুর্নবয়স্ক মুরগীর দেহে ৫৫% ভাগ পানি থাকে।

বাচ্চার খাদ্য ও পানির ব্যবস্থাপনা:
বাচ্চাকে হাজল থেকে বের করার পর সর্বপ্রথম পানি খাওয়াতে হয় তবে ১ লিটার পানির সাথে ১০  গ্রাম চিনি/ ৫০ গ্রাম গ্লুকোজ এবং সামান্য ভিটামিন সি দেওয়া গেলে মুরগীর বাচ্চা অতি সহজেই ধকল কাটিয়ে উঠতে পারে এই পানি ৩/৪ দিন পর্যন্ত খাওয়ালে ভালো ফলাফল পাওয়া যায়।

বাচ্চার প্রথম সপ্তাহের বয়স থেকেই মাথা পিছু ৮-১০ গ্রাম করে সুষম খাবার হিসেবে ব্রয়লার স্টার্টার খাবার সরবরাহ করতে হবে এবং প্রতি সপ্তাহে ৫ গ্রাম করে পর্যায়ক্রমে বদ্ধি করতে হবে। সাধারণত খাদ্য গ্রহনের দ্বিগুন পানি প্রয়োজন হয়। এজন্য প্রয়োজন মত পরিস্কার পানি বাচ্চার আশ পাশে রাখতে হবে।

দেশী মুরগীর বাচ্চার জন্য খাবার তৈরী:
১) ভূট্টা ভাঙ্গা/চাল ভাঙ্গা/ গম ভাঙ্গা-৫২.০০ %
২) চালের কুড়া-                      ১৫.০০ %
৩) তিলের খৈল-                      ১২.০০ %
৪) শুটকী মাছের গুড়া-              ১২.০০ %
৫) সয়াবিন ভাঙ্গা-                   ০৭.২৫ %
৬) ঝিনুকের গুড়া-                   ০১.০০ %
৭) লবন-                             ০০.৫০ %
৮) ভিটামিন-                        ০০.২৫ %
                                   মোট=১০০ %

উপসংহার: দেশী মুরগি পালনের মাধ্যমে পারিবারিক পুষ্টি চাহিদা মিটানোর পাশাপাশি বাড়তি আয়ের ব্যবস্থা হয়। মহিলাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়। দেশী মুরগী পালনে খাবার কম লাগে,দেশী মুরগীর রোগ-ব্যাধি কম হয়। সহজেই পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়ানো যায়, খরচ কম হয়, বাজার মূল্য বেশী থাকে। এভাবে গ্রামের বাড়িতে দেশিমুরগী পালন করলে প্রোটিনের সরবরাহ নিশ্চিত করার পাশাপাশি মুরগী উৎপাদন দ্বিগুন করা সম্ভব হবে এবং জীবন যাত্রার মান উন্নয়ন হবে।

তথ্যসূত্র: সমন্বিত খামার ব্যবস্থাপনা কম্পোনেন্ট-১ , কৃষক মাঠ স্কুল সহায়িকা