পাহাড়ে কাজুবাদাম চাষ সম্ভাবনার এক নতুন দিগন্ত

Category: গবেষণা ফিচার Written by agrilife24

ড. আমিনা খাতুন এবং লিপিয়ারা খাতুন:বাংলাদেশের বানিজ্যিক কৃষির সম্ভাবনাময় ফসল কাজুবাদাম। কাজুবাদাম অত্যন্ত সুস্বাদু একটি নাট বা বাদাম জাতীয় বিদেশী ফসল। বৃক্ষজাতীয় ফসলের আর্ন্তজাতিক বাণিজ্যে কাজুবাদামের স্থান তৃতীয়। দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশের ব্রাজিল কাজুবাদামের আদি জন্মস্থান। বর্তমানে উষ্ণমন্ডলীয় দেশ ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ভারত, কেনিয়া, মোজাম্বিক, তানজানিয়া, মাদাগাস্কার প্রভৃতি দেশে প্রধানত কাজুবাদাম উৎপাদিত হয়ে থাকে। দেশের তিন পার্বত্য জেলা বান্দরবান, রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়ি সহ চট্টগ্রাম, ফেণী, কুমিল্লা, ব্রাহ্মনবাড়ীয়া, বৃহত্তর সিলেট, টাঙ্গাইল, শেরপুরের পাহাড় ও টিলা এলাকায় এর প্রচুর চাষ উপযোগীতা রয়েছে।

আমাদের দেশে একটি অর্থকারী ফসল হিসেবে কাজুবাদাম চাষের উজ্জল সম্ভাবনা রয়েছে। শুধু বাদাম হিসেবেই নয়, কাজু ফলের খোসারও অর্থনৈতিক গুরুত্ব রয়েছে। এ থেকে উৎপাদিত তেল দিয়ে উৎকৃস্ট মানের জৈব বালাইনাশক তৈরী করা সম্ভব যা নিরাপদ ফসল ও খাদ্যোৎপাদনে অত্যন্ত জরূরী। কাজু ফলের জুসও বেশ জনপ্রিয়। ফলের রস সংগ্রহের পর অবশিষ্ট মন্ড বা ছোবরা দিয়ে জৈবসার উৎপাদন করা যায়। ফলে সবদিক থেকেই কাজুবাদাম একটি লাভজনক কৃষিপণ্য।

খাদ্যমানের দিক দিয়ে কাজুবাদাম অতি পুষ্টিকর ফল। প্রতি ১০০ গ্রাম খাবারের উপযোগী কাজুবাদামে রয়েছে ৩০ গ্রাম শর্করা, ১৮ গ্রাম আমিষ, ৪৪ গ্রাম চর্বি। এছাড়া ভিটামিন এ, সি, বি১, বি২, বি৩, বি৫, বি৬, বি৯, বি১২ প্রভৃতি ভিটামিন, লৌহ, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, ফসফরাস, পটাশিয়াম, জিংক, প্রভৃতি উপাদান রয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে কাজুবাদামে রয়েছে প্রচুর পরিমানে এন্টিঅক্সিডেন্ট যা ক্যান্সার সেলের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলে। এটি হৃদপিন্ডের শক্তিদায়ক হিসেবে কাজ করে। ফলে হৃদপিন্ড নানাবিধ রোগ থেকে নিরাপদ থাকে। কাজুবাদামে রয়েছে ওলিসিক নামে এক ধরনের মনো-অ্যানস্যাচুরেটেড ফ্যাটি এসিড। এটি দেহে ক্ষতিকর কোলেস্টরলের মাত্রা কমাতে সক্রিয়ভাবে কাজ করে। ফলে নিয়মিত এটি খেলে কোলেস্টরল নিয়ন্ত্রনে চলে আসে। কাজুবাদামে কপার খনিজ পদার্থ রয়েছে যা চুলের উজ্জ্বল্য বাড়ানোর পাশাপাশি চুলের গোড়াকে শক্তপোক্ত করতে বিশেষ ভূমিকা রাখে। প্রোটিন এবং ফাইবার সমৃদ্ধ এ খাবারটি নিয়মিত খেলে রক্তে সুগারের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে থাকে। সেই সঙ্গে অবসাদ দূর করাসহ শরীরের কর্মক্ষমতাও বৃদ্ধি পায়।

একাধিক গবেষণায় দেখা গেছে নিয়মিত কাজুবাদাম খেলে শরীরে নানা পুষ্টি উপাদানের ঘাটতি পূরণ হয় এবং সেই সাথে রক্তশূন্যতা দূর হয়। বর্তমানে দামী হোটেলে ও রেস্তোরাঁয় খাবারের স্বাদ বাড়াতে কাজুবাদাম এখন বেশ জনপ্রিয়। অতি সম্প্রতি কাজুবাদামের সুস্বাদু আচার জনপ্রিয় হয়ে ওঠছে। পুষ্টিগুণের বিবেচনায় চিকিৎসকগণ প্রতিদিন একমুঠো করে কাজুবাদাম খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন।

বর্তমান কৃষিবান্ধব সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আগামী দিনের কৃষিকে খোরপোষের কৃষি থেকে বানিজ্যিক কৃষিতে পরিনত করার জন্য সদা সচেস্ট। বাংলাদেশে বানিজ্যিক কৃষির যে সম্ভাবনা তৈরী হয়েছে তার অন্যতম ধারক বাহক সম্ভাবনাময় ফসল কাজুবাদাম। এর বৈজ্ঞানিক নাম Anacardium occidentate; প্রতিশব্দ Anacardium Curatefolium। এটি সপুস্পক অ্যানাকার্ডিয়েসি পরিবারের বৃক্ষ। কাজুবাদাম চিরসবুজ গ্রীষ্মমন্ডলীয় খরা সহনশীল উদ্ভিদ। ২০-৩০ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রা, বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাত ১০০০ হতে ২০০০ মিলিমিটার, সমুদ্রপৃষ্ঠ হতে গড়ে ৭০০ মিটার উচ্চতায় কাজুবাদাম ভালো জন্মে। মাটির উপযুক্ত অম্লমান ৫ থেকে ৬.৫। বাংলাদেশের সুনিস্কাশিত বেলে দোঁআশ মাটিতে বিশেষ করে পাহাড়ি অঞ্চলের লাল মাটিতে কাজুবাদাম চাষের অপার সম্ভাবনা রয়েছে।

কাজুবাদাম চাষ খুব সহজ। বীজ এবং কলম উভয় পদ্ধতিতেই কাজুবাদামের বংশবিস্তার করা যায়। কলমের মধ্যে জোড়াকলম, গুটিকলম, চোখকলম ইত্যাদি প্রধান। বীজ থেকে পলিব্যাগে চারা তৈরী করে কিংবা কলম প্রস্তুত করে জমিতে রোপন করা হয়। চারা রোপনের ২ থেকে ৩ বছরের মধ্যে ফল ধরা শুরু করে। ১০ থেকে ১২ বছরের ১ টি গাছ থেকে বছরে গড়ে ১০ থেকে ১২ কেজি কাঁচা কাজুবাদাম পাওয়া যায়। কাজুবাদাম গাছ ৬০-৭০ বছর পর্যণÍ বাঁচে এবং ৫০-৬০ বছর পর্যন্ত ফলন পাওয়া যায়। চারা রোপনের আগে ৭-৮ মিটার দূরত্ব বজায় রেখে ১ ঘনমিটার আয়তনের গর্ত তৈরী করে গর্তে সবুজ সার এবং পরিমানমত ইউরিয়া ও টিএসপি সার মাটির সংগে ভালোভাবে মিশিয়ে ১৫ দিন পর চারা লাগাতে হয়। পাহাড়ে, পাহাড়ের ঢালে এবং সমতলভূমিতে হেক্টরে ১৫০ থেকে ১৮০ টি চারা রোপন যথেষ্ট।

নভেম্বর থেকে জানুয়ারী ফুল ফোটার সময়। এপ্রিল থেকে জুনমাস কাজুবাদাম সংগ্রহের সময়। গাছ থেকে সুস্থ ফল সংগ্রহ করে খোসা ছাড়িয়ে বাদাম সংগ্রহ করে তারপর ভালোভাবে রোদে শুকিয়ে ভেজে প্যাকেটজাত করা হয়। ১ কেজি ফল প্রক্রিয়াজাত করে তা থেকে গড়ে ২৫০ গ্রাম কাজুবাদাম পাওয়া যায়। অধিক বৃষ্টিপাত ও মেঘাচ্ছন্ন আবহাওয়া ফলনের ওপর বিরুপ প্রভাব বিস্তার করে। এই গাছ ছায়া সহ্য করতে পারেনা, এজন্য পর্যাপ্ত সূর্যালোক প্রয়োজন হয়। কাজুবাদাম অনেকটা কিডনি আকৃতির, দৈর্ঘ্য ৪-৫ সে.মি এবং এর ওজন ৫-২০ গ্রাম হয়ে থাকে। সবচেয়ে সুবিধা হলো কাঁচাবাদাম রোদে শুকিয়ে বস্তাবন্দি করে ৭ থেকে ৮ মাস ঘরে রেখে পরবর্তী সময়ে সুযোগমতো বিক্রি করা যায়। বর্তমাানে ৬০ থেকে ৭০ টাকা কেজি দরে কাঁচাবাদাম বিক্রি হয়। সেমতে, ১ হেক্টর জমি থেকে বছরে প্রায় দেড় লাখ টাকা আয় হয়। প্রথম বছরের চারার দাম, সার, বালাইনাশক, অন্যান্য পরিচর্যা, শ্রমিক খরচ বাবদ গড় হিসেবে বছরে হেক্টর প্রতি ৩৫ থেকে ৪০ হাজার টাকা উৎপাদন খরচ হয়।

কাজুবাদাম পাহাড়ী আদিবাসিদের অন্যতম পছন্দের খাবার। পাহাড়ী এলাকায় দিনদিন বন উজাড়ের কারনে প্রতিবেশের চরম ক্ষতি হচ্ছে এবং ফলশ্রƒতিতে পাহাড়ী জনগণ প্রতিনিয়ত ভূমিক্ষয় এবং ভূমিধস সহ নানা বিপর্যয়ের সম্মুখীন হচ্ছে। সেই সাথে বন্য পশুপাখির খাবার ও আবাস সংকটের কারণে এদের সংখ্যা দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। কাজুবাদাম বানর জাতীয় প্রাণীদের প্রিয় খাবার। তাছাড়া অনেক বন্যপাখি কাজুবাদাম খেয়ে বাঁচে এবং এর গাছে বাসা বানিয়ে বংশবিস্তার করে। সুতরাং কাজুবাদাম চাষ করে পাহাড়ের জীববৈচিত্র ফিরিয়ে আনা সম্ভব। বাংলাদেশে প্রায় ১৩ লাখ ৩০ হাজার হেক্টর পাহাড়ি জমি যার প্রায় ৭০ শতাংশ তিন পার্বত্য জেলায়। পাহাড়ী এলাকায় বেকারত্ব প্রকট ও অধিকাংশ জনগণ দারিদ্রসীমার নীচে বাস করে।  

বাংলাদেশে কাজুবাদাম ও কফি চাষের সম্ভাবনাকে পুরোপুরি কাজে লাগাতে বর্তমান কৃষিবান্ধব সরকারের কৃষি মন্ত্রণালয় ইতিমধ্যে কাজুবাদাম ও কফি ফসলের উচ্চফলনশীল ও উন্নত জাত উদ্ভাবন এবং সম্প্রসারণ এর লক্ষ্যে “কাজুবাদাম ও কফি গবেষণা, উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ” শীর্ষক প্রকল্প বাস্তবায়ন করছেন। রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান জেলা অন্তত: পাঁচ লাখ হেক্টর অনাবাদি জমি পড়ে আছে। এর মধ্যে দুই লাখ হেক্টর জমিতে কাজুবাদাম চাষ করলে বছরে ১০০ কোটি ডলার বা বাংলাদেশী মুদ্রায় প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকা আয় করা সম্ভব। বর্তমানে দেশে দেড় হাজার টন কাজুবাদাম উৎপাদন হচ্ছে।

সরকার ২০২৪ সালের মধ্যে এক বিলিয়ন ডলার রফতানির জন্য চার লাখ ৪৪ হাজার টন কাজুবাদাম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা স্থির করেছেন। বর্তমান বিশ্বে কাজুবাদাম উৎপাদন হয় মোট ৩৫ লাখ মেট্রিক টন। এর মধ্যে বাংলাদেশে আবাদকৃত প্রায় ১৬ হাজার হেক্টর জমি থেকে দেড় হাজার টন কাজুবাদাম উৎপাদন হচ্ছে। কাজুবাদাম চাষ সম্প্রসারণ এবং কারখানা প্রতিষ্ঠা হলে নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টিসহ শ্রমিক নিয়েগের ফলে বেকার সমস্যা দূরীকরণে বিরাট ভূমিকা রাখবে।

লেখকদ্বয় পরিচিতি:
ড. আমিনা খাতুন
প্রিন্সিপাল সাইন্টিফিক অফিসার, রাইস ফার্মিং সিস্টেমস বিভাগ, এবং সভাপতি, ব্রি বিজ্ঞানী সমিতি, ব্রি, গাজীপুর

লিপিয়ারা খাতুন
সাইন্টিফিক অফিসার, রাইস ফার্মিং সিস্টেমস বিভাগ, ব্রি, গাজীপুর