বিশ্ব তুলা দিবস ২০২১ ‘ভালোর জন্য তুলা’

Category: গবেষণা ফিচার Written by agrilife24

ড. মোঃ গাজী গোলাম মর্তুজা:জাতিসংঘ ঘোষণা করেছে যে, প্রতি বছর 7 অক্টোবরকে বিশ্ব তুলা দিবস হিসেবে অনুমোদন করেছে এবং এটি জাতিসংঘের স্থায়ী ক্যালেন্ডারে অন্তর্ভুক্ত করেছে। পৃথিবীর অন্যতম প্রাকৃতিক তন্তু তুলার গুরুত্ব বিবেচনা করে ০৭ অক্টোবর, ২০১৯ প্রথমবারের মত ওয়ার্ল্ড ট্রেড অর্গানাইজেশনের (WTO) জেনেভা সদর দফতরে বিশ্ব তুলা দিবস ২০২১৯ উৎযাপিত হয়। তুলা উৎপাদনকারী, ব্যবহারকারী দেশ থেকে প্রায় সাত শতাধিক ব্যক্তি অংশগ্রহণ করেছিল।

এই বছর, ২০২১ সালের ৭ অক্টোবর, তুলা বিশ্বব্যাপী গুরুত্ব তুলে ধরার জন্য বিশ্ব তুলা দিবস পালন করার উদ্যোগ গ্রহন করা হয়েছে। প্রাকৃতিক তন্তু হিসাবে বিশ্বজুড়ে তুলার উৎপাদনকারী, ব্যবসায়ী এবং ব্যবহারকারী কিভাবে  উপকৃত হবে, তা তুলে ধরা হবে। বিশ্ব তুলা দিবস তুলার উপর ইতিবাচক প্রভাব প্রদর্শন করার একটি বিরাট সুযোগ। এক টন তুলা আনুমানিক ৫ বা ৬ জন লোকের জন্য সারা বছরের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা  করে।

বিশ্ব তুলা দিবস খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কারণ- টি বিশ্বের কিছু স্বল্পোন্নত দেশে দারিদ্র্য বিমোচনকারী ফসল, যা সারা বিশ্বের মানুষকে টেকসই এবং উপযুক্ত কর্মসংস্থান প্রদান করে। তুলা কৃত্তিম তন্তুর সাথে তুলনা করলে দ্রুত পচনশীল, ইহা আমাদের জলপথে প্লাস্টিকের পরিমাণ হ্রাস করে এবং আমাদের মহাসাগরকে পরিষ্কার রাখতে সাহায্য করে। এটি একমাত্র কৃষি পণ্য যা বস্ত্র এবং খাদ্য উভয়ই সরবরাহ করে। তুলা ফসল শুষ্ক আবহাওয়ায় জন্মে, যা অন্য কোন ফসল পারে না।

বিশ্ব তুলা দিবস ২০২১ -এর প্রতিপাদ্য হচ্ছে 'ভালোর জন্য তুলা'। তুলা উৎপাদন দারিদ্র্য বিমোচনে সহায়তা করে, প্লাস্টিকের দূষণকে পরিবেশের বাইরে রাখে, নারীর ক্ষমতায়ন বৃদ্ধি করে এবং তুলার নেতিবাচক কার্বন পদচিহ্নের মতো সুবিধাগুলি উপস্থাপন করে।

বিশ্বে তুলা একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি অর্থকরী ফসল। প্রতি বছর ৩৩-৩৫ মিলিয়ন হেক্টর জমিতে বিশ্বের গ্রীষ্মমন্ডলীয় ও নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলের সত্তরটিরও বেশি দেশের তুলা চাষ করা হয়, যা সমস্ত পৃথিবীর আবাদকৃত জমির ২,৫ শতাংশ। ১০০ মিলিয়নেরও বেশি পরিবার সরাসরি তুলা উৎপাদনের সাথে জড়িত এবং ২৫-২৬ মিলিয়ন টন কাঁচা তুলা উৎপাদন করে, যেখানে প্রতি হেক্টরে গড়ে প্রায় ৮০০ কেজি আঁশতুলা উৎপাদিত হয়। কৃষি ফসলের মধ্যে তুলাই একমাত্র ফসল, যা থেকে খাদ্য ও বস্ত্র দুই ই পাওয়া যায়। বীজতুলা থেকে প্রথমত আমরা আঁশ পেয়ে থাকি, এছাড়া উপজাত হিসেবে বিশ্বে প্রতি বছর পাঁচ কোটি টনেরও বেশি তুলাবীজ উৎপাদিত হয়। তুলাবীজ থেকে আমরা ভোজ্য তেল ও খৈল পেয়ে থাকি। খৈল গবাদি পশু ও  মাছের খাদ্য হিসাবে ব্যবহৃত হয়।  

১০০ টিরও বেশি দেশ তুলা আমদানি ও রফতানি বাণিজ্যে জড়িত। তুলা উৎপাদন, জিনিং, টেক্সটাইল, গার্মেন্টস, ভোজ্যতেল এবং সাবান শিল্প ইত্যাদির মাধ্যমে লক্ষ লক্ষ লোকের জীবিকা নির্বাহ করে। তুলা বিশ্বের অন্যতম টেক্সটাইল তন্তু এবং তুলা অর্থনৈতিক ও সামাজিক কল্যাণে মুখ্য ভূমিকা পালন করে থাকে।

প্রাকৃতিক তন্তু তুলা ব্যবহার দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। এক সময় পঞ্চাশ ভাগের অধিক প্রকৃতিক তন্তু তুলার ব্যবহার ছিল, বর্তমানে তা ২৭ ভাগে নেমে এসেছে। এই কারণে, প্রকৃতিক তন্তুর গুরুত্ব বিবেচনা করে  ২০০৯ সালকে জাতিসংঘ আন্তর্জাতিক প্রাকৃতিক তন্তুবছর ঘোষণা করেছিল।

বিশ্ব তুলা দিবস ২০২১ এর উদ্দেশ্যগুলি হলো, তুলার ব্যবহার ও চাহিদা বৃদ্ধি করা এবং তুলার উপকারিতা এবং মূল্য সম্পর্কে জনগনকে অবহিত করা, বিশ্বজুড়ে তুলার জন্য ইতিবাচক মিডিয়া কভারেজ তৈরি করা, তুলার গুরুত্বপূর্ণ দেশগুলির সরকারী প্রতিনিধিদের কাছ থেকে সমর্থন পাওয়া, ডাব্লুটিও এবং ইউএনকে জড়িত করা ব্র্যান্ড এবং খুচরা বিক্রেতাদের তাদের স্টোরগুলিতে বা তাদের ওয়েবসাইটে তুলার ব্যাপক প্রচার করা।  

বিশ্ব তুলা দিবস ২০২১-এর মধ্য দিয়ে তুলা উৎপাদন, জিনিং, স্পিনিং, গার্মেন্টস, ব্র্যান্ড বা খুচরা বিক্রেতা, গ্রাহক, শিক্ষাবিদ, গবেষক, মিডিয়া কর্মী, এনজিও এবং সরকারী কর্তৃপক্ষের মতো প্রতিটি অংশীদারের কাছে পৌঁছে দিতে চাই। উৎপাদকরা তুলা উৎপাদন করে, জিনিং স্পিনিং ও গার্মেন্টসে তুলা ব্যবহার করে এবং তুলার পণ্য উৎপাদন করে, ব্র্যান্ড বা খুচরা বিক্রেতা তুলা পছন্দের সিদ্ধান্তে প্রভাবিত করে, সবশেষে গ্রাহক বা ব্যবহারকারী তুলা জন্য চাহিদা এবং পছন্দ বৃদ্ধি করে। শিক্ষাবিদরা ইতিবাচক ধারণা অর্জনের জন্য তুলা সম্পর্কে শিক্ষিত করেন, গবেষকরা তুলা শিল্পে ক্রমাগত উন্নতি এবং নতুনত্ব আনতে গবেষণার জন্য অর্থায়নকে উৎসাহিত করেন। মিডিয়া তুলা সম্পর্কে ইতিবাচক ধারনা তৈরীতে সহায়তা করে, এনজিওগুলি ইতিবাচক অংশীদারিত্ব করে  এবং সর্বশেষে তবে সরকারী কর্তৃপক্ষ তুলা উৎপাদন এবং বাণিজ্য নীতি তৈরীতে সহায়তা করেন।

তুলা বিশ্বজুড়ে উৎপাদিত হয় এবং এক টন তুলা গড়ে পাঁচ জনকে প্রায় বছরব্যাপী কর্মসংস্থান দেয়। বিশ্বের গ্রীষ্মমন্ডলীয় ও নাতিশীতোষ্ঞ অঞ্চলের জন্য তুলা ফসল পুরোপুরি উপযুক্ত। সামগ্রিকভাবে, তুলা বিশ্বের আবাদযোগ্য জমির মাত্র ২.৫ শতাংশ দখল করে এবং এখনও বিশ্বের টেক্সটাইল সেক্টরের ২৭ শতাংশ পূরণ করে।  

মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলো হলো খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা ও শিক্ষা। সভ্যতার দিক থেকে বিবেচনায় বস্ত্রই হচ্ছে আমাদের প্রথম মৌলিক চাহিদা। এই বস্ত্র শিল্পের মূল ও প্রধান উপাদান তুলা। এক সময় বাংলাদেশের মসলিন ছিল বিশ্ব বিখ্যাত। এদেশে তৈরি রাজকীয় শাড়ী “মসলিন” বিশ্ব বিখ্যাত ছিল। এই মসলিনের তুলা এ দেশেই উৎপাদিত হতো। ব্রিটিশ শাসনামলে সেই তুলা ও মসলিন কালের গর্ভে হারিয়ে যায়। বর্তমানে আবার বস্ত্র এবং গার্মেন্টস খাত বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি ও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী খাত। বাংলাদেশে বস্ত্র খাতের ৪৫০ টি সুতাকলের জন্য বছরে প্রায় ৭৫-৮০ লক্ষ বেল আঁশ তুলার প্রয়োজন হয়, যার সিংহভাগ বিদেশ থেকে আমদানী করে মেটানো হচ্ছে এবং এই চাহিদা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ পরিমান তুলা আমদানী করতে প্রতিবছর প্রায় ২০-২৫ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করতে হয়। বর্তমানে আমাদের দেশে মোট চাহিদার মাত্র তিন ভাগ পূরণ করতে পারে, বাকী ৯৭ ভাগ তুলা বিদেশ থেকে আমদানী করতে হয়। তাছাড়া আমাদের বৈদেশিক মূদ্রা আয়ের ৮৪ ভাগই আসে তৈরী পোশাক খাত থেকে। ৫০০০ গার্মেন্টস ও তৈরী পোশাকের অন্যান্য  খাতে প্রায় ৫০ লক্ষ লোক সরাসরি জড়িত। এসব বিবেচনায় বিশ্ব তুলা দিবস বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ লোক  তুলা থেকে উৎপাদিত পোশাক ব্যবহার করছে এবং আগামীতে তুলার চাহিদা উত্তরোত্তর বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে। এই চাহিদা বৃদ্ধির ফলে টেকসই তুলার প্রয়োজন বাড়বে। আমাদের পরিবেশকে ঠিক রেখে তুলা উৎপাদন করতে হবে। বিশ্বব্যাপী প্রচলিত তুলা উৎপাদনে কীটনাশক ব্যবহারের ফলে পরিবেশ দূষিত হয়। তাই টেকসই তুলা উৎপাদন এই সমস্যার সবচেয়ে ভালো সমাধান।  বিপজ্জনক রাসায়নিকের ব্যবহার হ্রাস করে ও কম পানি ব্যবহার করে টেকসই তুলা উৎপাদন করতে হবে। এতে কৃষকের আয় বৃদ্ধি পাবে ও দারিদ্র্য হ্রাস পাবে।
 
তুলা পৃথিবীর অনেক দেশের জাতীয় অর্থনীতিতে মূল ভূমিকা পালন করে যে কারণে এটিকে বিশ্বের অনেক দেশের কাছে হোয়াইট গোল্ড হিসেবে পরিচিত। সরকার এবং অন্যান্য নীতিনির্ধারকদের তুলা উৎপাদন বিকাশে ইতিবাচক হওয়া প্রয়োজন। বিশ্ব তুলা দিবস, ২০২১ হচ্ছে তুলার উপর ইতিবাচক প্রভাব প্রদর্শন করার একটি সুযোগ, যা ভবিষ্যতে অব্যাহত থাকবে এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে উদযাপনে যোগ দিতে রাজি করবে। সুতরাং, বিশ্ব তুলা দিবসের সমস্ত অংশীদারদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

লেখক:প্রকল্প পরিচালক
সম্প্রসারিত তুলাচাষ প্রকল্প, তুলা উন্নয়ন বোর্ড, ঢাকা
This email address is being protected from spambots. You need JavaScript enabled to view it.