‘বসতবাড়ির আশে পাশে ভরে দে ভাই সবজি, মসলা ও ফল চাষে’-এর মডেল

Category: গবেষণা ফিচার Written by agrilife24

ড. জগৎ চাঁদ মালাকার:আমাদের দেশের মাটি বিভিন্ন মসলা যেমন আদা, হলুদ, সবজি ও ফল চাষের জন্য উপযোগী।প্রতি বছর বিদেশ থেকে বিভিন্ন ধরনের মসলা ও ফল আমদানি করতে এতে দেশের অনেক টাকা ব্যয় করতে হয়, তাই আদা, হলুদ, সবজি ও ফল চাষে উদ্ধুদ্ধ করতে অথবা দেশ প্রেম থেকে আক্ষেপ করে অনেকে বলে থাকেন ‘আদা কিনে খায় গাধা-হলুদ কিনে খায় বলদ’ প্রচলিত আছে প্রবাদ আছে যে, ‘বসতবাড়ির আশে পাশে ভরে দে ভাই সবজি, মসলা ও ফল চাষে’ তাই বলতে ইচ্ছে করে ‘দয়াল বাবা কলা খাবা গাছ লাগাইয়া খাও’

নিরাপদ খাদ্যকে সমধিক গুরুত্ব দিয়ে বিভিন্ন দেশ কীটনাশকের অবশিষ্টাংশ, দূষণকারী বস্তু, অণুজীব, রোগ ও পোকা ইত্যাদির পাশাপাশি পরিচ্ছন্নতার বিষয়ে কঠোর বিধি নিষেধ আরোপ করছে। বিধায় আমাদের গ্রামের বেশির ভাগ বাড়িতে লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে, অপরিকল্পিতভাবে নানা গাছ-গাছড়া দিয়ে ভরে রাখা হয়েছে। এতে করে বাড়িতে তেমন আলো বাতাস পড়ে না আবার কোথায় কোথায় ফাঁকা পতিত পড়ে আছে যেখানটা সহজেই আবাদের আওতায় আনা যায়। এতে করে আমাদের বসতবাড়ির উৎপাদন ভীষণভাবে ব্যাহত হয়। এই অসুবিধা দূর করে বসতবাড়ির বিভিন্ন স্থানসমূহের সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে সহজেই উৎপাদন বৃদ্ধি করা সম্ভব।

বসতবাড়িতে সবজি উৎপাদন আমাদের গ্রামগুলোতে যুগ যুগ ধরে চলে আসছে কিন্তু সাম্প্রতিক কালে মানুষের জীবযাত্রায় আধুনিকতার ছোঁয়া লাগায় অনেকেই বসতবাড়িতে আগের মত সবজি আবাদ করছে না। সবজির ব্যাপক চাহিদার কারনে বাজারে এখন সবজির উচ্চমূল্য যা অনেক সময় সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাহিরে চলে যায় বলে বেশির ভাগ মানুষ সবজি বাজার থেকে কিনে খেতে পারে না। এই সমস্যা থেকে বের হয়ে গ্রামের মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য আমাদের কৃষাণীদেরকে নিরাপদ সবজি চাষে উদ্বুদ্ধ করতে হবে।

আমাদের দেশের আবহাওয়া ও মাটি ফল চাষের জন্য বেশ উপযোগী। এদেশে প্রায় ১৩০ প্রজাতির ফল উৎপাদিত হয়ে থাকে তার মধ্যে প্রায় ০৯টি প্রধান। দেশের মোট আবাদি জমির প্রায় ২.৫% বর্তমানে ফল আবাদের আওতাধীন। দেশের মোট ফল উৎপাদনের প্রায় ৫২% উৎপাদিত হয় বৈশাখ থেকে শ্রাবন মাসে। বাকী ৪৮% ফল আবাদ হয় বছরের অবশিষ্ট ০৮ মাসে এবং শীত মৌসুমে দেশে ফলের আবাদ সবচেয়ে কম। অথচ আমাদের দেশে এখনো বসতবাড়ীতে পরিকল্পিত ভাবে নিরাপদ ফল আবাদ করে বার মাসই আমরা নিজেদের ফলের চাহিদা মিটানোর পাশাপাশি  আর্থিকভাবে লাভবান হতে পারি।

জীবনধারনের জন্য আমরা যা কিছু খাই সে সবই হল খাদ্য।  প্রতিদিন খাদ্য খেয়ে মানুষ সুস্থ, সবল এবং কর্মক্ষম থাকে। কিন্তু স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য দৈনিক আমাদের বিভিন্ন ধরণের খাবার যে দরকার সে বিষয়ে অনেকেরই তেমন কোন ধরণা নেই। অনেকেই খাবার বলতে ভাত, মাছ, মাংস, ডিম, দুধ ইত্যাদিকে কে বুঝে থাকলেও কোনটি আমাদের শরীরের কি কাজ করে সে সম্পর্কে তেমন কিছু জানেন না। এতে করে দেহের প্রয়োজনানুসারে খাবার সরবারহ নিশ্চিত হয় না এবং আমরা অপুষ্টিতে ভুগতে থাকি। এই অপুষ্টির জন্য আমাদের দারিদ্রতার চেয়ে বেশি দায়ী আমাদের খাবার সম্পর্কিত জ্ঞানের স্বল্পতা।

মানুষের সামাজিক মর্যাদা নিয়ে সুষ্ঠু সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার জন্য অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, বাসস্থান ও চিকিৎসা এই পাঁচটি উপাদান একান্তই দরকার। সামগ্রিকভাবে একটি দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নির্ভর করে সে দেশের মোট খাদ্যর প্রাপ্যতা, জনগণের খাদ্য ক্রয়- ক্ষমতা এবং খাবার গ্রহণের উপর (সুষম বন্টন)। বর্তমান উৎপাদন পরিস্থিতিতে ধান বাদে অন্যান্য ফসল গম, আলু, তেলবীজ, ডাল ও শাকসবজি উৎপাদন আমাদের চাহিদার তুলনায় যথেষ্ট নয়। চাহিদা তুলনায় মাছ, মাংস, ডিম, দুধ ইত্যাদি উৎপাদনেও যথেষ্ট নয়। তা ছাড়া প্রাপ্যতা থাকলেও ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে না থাকলে জনগণ কিনতে পারবে না।

আমাদের দৈনন্দিন খাদ্য চাহিদার ৫৩% আমরা পাই দানাদার খাদ্যশস্য থেকে যা দৈনিক ২১২২ কিলো-ক্যালোরীর ৭৫% ভাগ। বাকি ২৫ ভাগ কিলো-ক্যালোরী আসে ফলমূল, শাকসবজি, ডাল ও তেল থেকে। আমাদের প্রতিদিন ৮৫ গ্রাম ফল এবং আলুসহ অন্যান্য শাকসবজি খাওয়া উচিত ২৫০ গ্রামের বেশী। আমরা খেয়ে থাকি পাতা জাতীয় ২৩ গ্রাম, পাতা জাতীয় ছাড়া ৮৯ গ্রাম এবং আলুসহ শাকসবজি ১১০ গ্রামের মত যার মধ্যে প্রায় ৭০ গ্রাম আলু, ফল ১৪ গ্রাম । আমাদের খাদ্য তালিকায় ফল ও শাক সবজি খুবই কম থাকে।

আমাদের মাটি ও পরিবেশ ফল ও শাক সবজি উৎপাদনের সহায়ক। বসতবাড়ির আঙ্গিনায় হতে পারে সুন্দর সবজি বাগান। সেখানে চাষ করা যায় লালশাক, ঢেড়স, ডাটাশাক ইত্যাদি। ঘরের চালে, বেড়ায়, মাচায় করা যায় লাউ, সিম, বরবটি, কাঁকরোল, করল্লার ইত্যাদি চাষ। প্রতিটি বাড়িতে ২-৩ টি পেঁপে গাছ, লেবু, আম, কাঁঠাল, পেয়ারা, আমলকি ইত্যাদি লাগানো যেতে পারবে। ফল ও সবজি চাষ করলে নিশ্চিত হবে সুস্থ সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার নিয়ামক পুষ্টি সমৃদ্ধ খাবার।

বসতবাড়িতে সবজি ও ফল চাষের গুরুত্বঃ
১. স্বাস্থ্য ঠিক রাখার জন্য প্রতিদিন মাথাপিছিু ২৫০ গ্রামেরও বেশি সবজি খাওয়া প্রয়োজন।
২. সারা বৎসর টাটকা সবজি প্রাপ্তি নিশ্চিত করা ও পারিবারিক পুষ্টি চাহিদা পূরণ করা সম্ভব ।
৩. শাকসবজি থেকে প্রাপ্ত পর্যাপ্ত ভিটামিন ও খনিজ লবণ পাওয়া যায়।
৪. গ্রামীন জনগোষ্ঠির সবচেয়ে বেশি অভাব হচ্ছে ভিটামিন-এ, ভিটামিন-সি, লৌহ, ক্যালসিয়াম, প্রোটিন।
৫. বাংলাদেশে শতকরা ৪২ ভাগ শিশু অপুষ্টিতে ভূগছে। অপুষ্টিজানিত কারণে রক্তশূন্যতা, মুখের ঘা, দাঁতের গোড়া থেকে রক্ত পড়া, বেরিবেরি, গলগন্ড ইত্যাদি রোগ হয়।
৬. ভিটামিন এ’র অভাবে শিশুর রাত কানা রোগ হয় এবং শিশু অন্ধ হয়ে যেতে পারে।
৭. বাজার থেকে সংগৃহিত বেশিরভাগ সবজিতে লুকায়িত কীটনাশকের বিষক্রিয়া মানব স্বাস্থের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
৮. বাড়ির আশে পাশে পড়ে থাকা পতিত/অব্যবহৃত জমিতে পরিবারের সদস্যদের অবসর সময়কে কাজে লাগিয়ে পারিবারিক সবজি বাগান করা সম্ভব। নিজের পছন্দ মত এবং টাটকা সবজি পাওয়া সম্ভব । আমাদের দেশে বসতবাড়ি আছে ১ কোটি ১৮ লক্ষ। শাক সবজি ও ফলের চাষ করে বসত বাড়িকে পরিনত করতে হবে একটি সুন্দর স্বাবলম্বি বাড়িতে। কারণ উক্ত বাড়ি হতে পারে আমাদের সুষম খাদ্য ভান্ডার।পারিবারিক আয় বিশেষ করে মহিলাদের আয়ের সুযোগ তৈরী হয়।
৯. অবসর সময়ে কাজ করার সুযোগ তৈরী হয়।নিজের উৎপাদিত সবজি খেয়ে আতœতৃপ্তি পাওয়া যায়। প্রতিবেশিকে সবজি বিতরনের মাধ্যমে পারিবারিক সম্পর্ক সুদৃঢ় হয়।

আমাদের গ্রামের বেশির ভাগ বাড়িতে লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে, অপরিকল্পিতভাবে নানান গাছ গাছড়া দিয়ে ভরে রাখা হয়েছে। এতে করে বাড়িতে তেমন আলোবাতাস পড়েনা আবার কোথায় কোথায় ফাঁকা পতিত পড়ে আছে যেখানটা সহজেই আবাদের আওতায় আনা যায়। এতে করে আমাদের বসতবাড়ির উৎপাদন ভীষণভাবে ব্যাহত হয়। এই অসুবিধা দূর করে বসতবাড়ির বিভিন্ন স্থানসমূহের সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে সহজেই উৎপাদন বৃদ্ধি করা সম্ভব।

সবজি সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা:
সবজি সবসময় টাটকা খেতে হবে। সবজি কাটার পর ধোয়া যাবে না। কাটার পূর্বে সবজি ধুয়ে নিতে হবে। সবজি কাটার পর ধুয়ে নিলে পাণিতে দ্রবণীয় ভিটামিন-বি ও সি এবং খনিজ লবণ চলে যাবে। সবজিতে অবস্থিত ভিটামিন এ, ডি, ই, কে আমাদের শরীরের জন্য গ্রহণোপযোগী করতে হলে সবজি কে তেল দিয়ে রান্না করে খেতে হবে। রঙ্গিন সবজিতে উক্ত ভিটামিনগুলো প্রচুর পরিমাণে থাকে।

ভিটামিন গুলোর কিছু উপকারী দিক:
ভিটামিন বি-২এর অভাবে ঠোঁটের কিনারায় ঘা হয় এবং বি-এর অভাবে শারিরিক দুর্বলতা হয় এবং মাংস পেশী চাবায়। ভিটামিন-সি’র অভাবে দাঁতের গোড়া দিয়ে রক্ত পড়ে। বিভিন্ন চর্মরোগ হতে পারে এবং স্কার্ভি রোগ হয়।
ভিটামিন-এ এর অভাবে রাতকানা রোগ হয়। দীর্ঘদিন রাতকানা থাকলে শিশু অন্ধ হয়ে যায়।
ভিটামিন-ডি’র অভাবে শিশুর হাড়গোড় শক্ত হয় না, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকে। শিশুর রিকেট রোগ হয়। শিশুকে রোর্দ্রে রাখলে এর অভাব পূরণ হয়।
ভিটামিন-ই’র অভাবে মানুষের যৌন ক্ষমতা হ্রাস পায় এবং সন্তান ধারন এবং জন্ম দিতে পারে না। ভিটামিন-ই ত্বক ও চুল সুন্দর করে থাকে।
ভিটামিন-কে - এর অভাবে শরীলে কেটে গেলে সহজে রক্ত জমাট বাধবে না।
 
বসতবাড়িতে মসলা,সবজি ও ফল চাষের বিবরণঃ

রৌদ্রজ্জ্বল স্থান/ খোলা জায়গাঃ বিভিন্ন প্রকার পাতা জাতীয় সবজি(পুঁই শাক, লাল শাক, পালং শাক, কলমিশাক,  বাটি শাক), বেগুন, টমেটু ইত্যাদির বেড করে আবাদ করা সম্ভব।
ছায়াযুক্ত/অর্ধছায়াযুক্ত স্থান/মাচার নীচেঃ আদা, হলুদ, বিলাতী ধনিয়া
স্যাঁতস্যাতে স্থানঃ বিভিন্ন প্রকার কচু।
মাচায়/পুকুর পাড়ে মাচায়ঃ বিভিন্ন প্রকার কুমড়া জাতীয় সবজি, পুঁই শাক, শীম, বরবটি ইত্যাদি।
ঘরের চালেঃ চাল কুমড়া, মিষ্টি কুমড়া, লাউ, দেশী সিম, পুঁইশাক ইত্যাদি।
বেড়া/প্রাচীরঃ প্রকার কুমড়া জাতীয় সবজি, পুঁই শাক, শীম, বরবটি ইত্যাদি।
ঘরের পীড়ায়ঃ পেয়ারা, ডালিম, সজিনা, পেঁপে, বেগুন, বারমাসী মরিচ, মান কচু, ফেন কচু, দুধ কচু ইত্যাদি।
বাড়ির সীমানায়ঃ সজিনা, পেঁপে ইত্যাদি।
গর্তে নীচু জায়গায়ঃ পানি কচু, হেলেঞ্চা
অফলা গাছেঃ মেটে আলু, মৌসীম, চুুই,ধন্ধুল, গাছ আলু
পতিত জায়গাঃ লেবু, কুল
পুকুর পাড়েঃ লেবু,পেয়ারা

উপসংহারঃ
রাসায়নিক কৃষি উপকরণের এলোপাথারি ব্যবহারের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ায় জলে, স্থলে,অন্তরীক্ষে বাড়ছে দূষণের মাত্রা। জনস্বাস্থ্য হচ্ছে মারাত্বক হুমকির সম্মুখীন। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য পরিকল্পিত ভাবে নিরাপদ শাক সবজি,মসলা ও ফল আবাদ করে বার মাসই আমরা নিজেদের ফলের চাহিদা মিটানোর পাশাপাশি  আর্থিকভাবে লাভবান হতে পারি। এই ফসল খেতে সুস্বাদু, বিষমুক্ত এবং বাজার মুল্য ভাল পাওয়া যায়। এতে করে বিষমুক্ত নিরাপদ সবজি,মসলা ও ফল পাওয়া সহ খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে। উত্তম কৃষি পদ্ধতি সামগ্রিক কৃষি কার্যক্রম যা অনুসরণে নিরাপদ এবং মান সম্পন্ন খাদ্য ও খাদ্য বর্হিভূত কৃষিজাত পন্য সহজলভ্য, পরিবেশ সুরক্ষা, অর্থনীতি এবং সমাজ সুসংহত হবে।

আহবান জানাচ্ছি সকলকে, নিরাপদ খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা ফুড সিস্টেম কে নিরাপদ করতে হলে আমাদের দেশে এখনো বসতবাড়িতে পরিকল্পিত ভাবে নিরাপদ মসলা, শাক সবজি ও ফল আবাদ করে বার মাসই আমরা নিজেদের মসলা, শাক সবজি ও ফলের চাহিদা মিটানোর পাশাপাশি  আর্থিকভাবে লাভবান হতে পারি। তাই বলতে ইচ্ছে করে ‘বসতবাড়ির আশে পাশে ভরে দে ভাই সবজি, মসলা ও ফল চাষে’ অথবা  ‘দয়াল বাবা কলা খাবা গাছ লাগাইয়া খাও’

লেখক:উপপরিচালক (এল.আর),সংযুক্ত
উদ্ভিদ সংগনরিোধ উইং, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, খামারবাড়ি, ঢাকা।
ইমেইল: This email address is being protected from spambots. You need JavaScript enabled to view it.