বাংলাদেশে সম্ভাবনাময় কফি চাষ

Category: গবেষণা ফিচার Written by agrilife24

মো: কবির হোসেন:কফি একটি জনপ্রিয় পানীয়। আজকের বিশ্বে মানুষ কোন সভা, আলোচনা অনুষ্ঠান ও বন্ধুমহলের আড্ডায় কফি কিংবা চা ছাড়া চিন্তাই করা যায়না। শরীর রিফ্রেশ বা স্বাদের জন্য অনেকেই কফি পান করেন। নরম পানীয় হিসেবে সর্বত্র ও সর্বমহলে চা ও কফি খুব জনপ্রিয়। চা বাংলাদেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানী করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করলে এখনো কফি চাষে আমরা পিছিয়ে আছি। যদিও বর্তমানে দেশের বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি, টাংগাইল, রংপুর ও নীলফামারীতে খুব স্বল্প পরিসরে কফির চাষ হচ্ছে ।

পার্বত্য অঞ্চলের তিন জেলার মধ্যে প্রায় ৯০% কফি উৎপন্ন হয় বান্দরবান জেলায়। ১৯৯০ সালের দিকে রাঙামাটি জেলার রাইখালী কৃষি গবেষণা কেন্দ্র এবং খাগড়াছড়ি পার্বত্য কৃষি গবেষণা কেন্দ্রে কফি এবং কাজুবাদামের গবেষণা শুরু হয়।
 
বর্তমানে বাংলাদেশের অন্যান্য এলাকায় ইতোমধ্যে এর চাষ শুরু হয়েছে। উত্তরাঞ্চলের নীলফামারী ও রংপুর জেলায় এবং টাঙ্গাইল জেলার মধুপুর এলাকায় কফির চাষ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। টাংগাইল জেলার মধুপুর উপজেলার মহিষমারা গ্রামের কৃষক  সানোয়ার হোসেন বছরব্যাপী ফল উৎপাদন প্রকল্পের সহযোগিতায় ২০১৬ সালে ২ বিঘা জমিতে রোভাষ্টা জাতের কফি চাষ করে ভাল ফলন পেয়েছেন এবং স্থানীয়ভাবে প্রক্রিয়াজাতকরণ করছেন।

২০২০ সালের ১৫ আগষ্ট ঢাকার আসাদগেট হর্টিকালচার সেন্টার মাননীয় কৃষি মন্ত্রী কৃষিবিদ ডঃ আব্দুর রাজ্জাক এমপি মহোদয় পরিদর্শন করেন। কফি গাছের ফলন দেখে মুগ্ধ হন এবং কফি চাষ সম্প্রসারণে দ্রুত কর্মসূচি গ্রহন করার জন্য কৃষি বিভাগকে নির্দেশনা প্রদান করেন। ২০১৪ সালে দেশের উত্তরাঞ্চলের জেলা নীলফামারীর কিশোরগঞ্জ উপজেলার মুন্সীবাড়ী গ্রামের কৃষক মো: আ: কুদ্দুস প্রথম কফি চাষ শুরু করেন। তিনি একটি কফির চারা উৎপাদনের নার্সারী করেন যার মাধ্যমে স্থানীয়ভাবে কফি চাষ সম্প্রসারিত হচ্ছে। ২০১৭ সালে রংপুর জেলার তারাগঞ্জ উপজেলার গোয়াজপুরের কৃষক মোখলেছুর রহমান এক বিঘা জমিতে কফির চারা রোপন করেন। ২০১৯ সালে জলঢাকা উপজেলার শৌলমারী সোনাঘর গ্রামের কৃষাণী খাদিজা আক্তার তার ৪০ শতক জমিতে কফির চারা রোপণ করেন। ২০২০ সালে নীলফামারী জেলার সদর উপজেলার নগর দারোয়ানী গ্রামের কৃষক মো: রোবেল মিয়ার ১ বিঘা জমিতে কফির চারা রোপণ করা হয়।

প্রাপ্ত তথ্য মতে এবং জমি পরিদর্শনে দেখা যায় গাছের বাড়-বাড়তি ভাল। পূর্বে রোপনকৃত গাছে সাফল্যজনক ফলন হচ্ছে। মৌলভীবাজার জেলার রাজনগর উপজেলার মাতিউরা চা বাগান কর্তৃপক্ষ পরীক্ষামূলকভাবে ৪৪ একর জমিতে  ১০,০০০ কফির চারা রোপণ করেন এবং ইতোমধ্যে গাছে ফল ধরা শুরু হয়েছে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে গতবছরে প্রায় ১১৯ হেক্টর জমিতে কফি চাষ হয় এবং মোট উৎপাদন প্রায় ৫৬ টন। বাংলাদেশে উৎপাদিত কফির প্রায় ৯০% হয় বান্দরবান জেলায়। বানদরবানের ৭ উপজেলার মধ্যে রুমা উপজেলায় এর চাষ বেশী। কফি হতে পারে বাংলাদেশের পাহাড়ী মানুষের বিকল্প আয়ের উৎস। বাংলাদেশে প্রায় ১৩ লাখ ৩০ হাজার হেক্টর পাহাড়ী জমি যার মধ্যে ৯ লাখ ৩০ হাজার হেক্টর জমি পাহাড়ী তিন জেলায়। পাহাড়ী জমির মধ্যে ৫ লাখ হেক্টর অনাবাদী। পাহাড়ী জমিতে পাহাড়ী কফি নামে খ্যাত এরাবিকা জাত সফলভাবে চাষ সম্ভব। শুধুমাত্র পাহাড়ে ১ লাখ হেক্টর জমিতে কফি চাষ করলে ফলন হবে ২ লাখ টন যার বাজারমূল্য প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা। দেশের অন্যান্য স্থানে রোবাস্টা জাত ভালভাবে চাষ সম্ভব। কফি চাষের সাথে আন্ত:ফসল হিসেবে পেঁপে, আনারস, গোলমরিচ অনায়াসে চাষ করা যায় ।

বাংলাদেশের আবহাওয়া কফি চাষের অনুকূল তবে ভালো ও উন্নত স্বাদের ও ঘ্রাণের কফি পেতে এর চাষ পাহাড়ী এলাকায় সম্প্রসারণ করা দরকার।

মাটি: হালকা ঝুরঝুরে বেলে-দোঁয়াশ সুনিষ্কাষিত জৈব পদার্থ ও হিউমাস সমৃদ্ধ, অম্ল মাটি  কফি চাষের উপযোগী।

জলবায়ুঃ উষ্ণ এবং আদ্র জলবায়ু ভাল। পরিপক্ক অবস্থায় শুষ্ক জলবায়ু। গড় তাপমাত্রা ১৮ হতে ২৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। বাষির্ ক গড় বৃষ্টিপাত ১০০০ হতে ২০০০ মিলিমিটার।

জাতঃ রোবাস্টা এবং এরাবিকা কফি বাংলাদেশের আবহাওয়ায় চাষ উপযোগী ।বাংলাদেশের পাহাড়ী এলাকা যেমন -পার্বত্য অঞ্চল ও টাংগাইল মধুপুরগড়সহ বৃহত্তর সিলেট ও অন্যান্য পাহাড়ি এলাকায় এরাবিকার উপযোগিতা বেশী। এ জাতকে পাহাড়ি জাত বলে। রোবাস্টা জাতকে সমতল ভূমির কফি বলা হয়। সারাদেশে এটির চাষ সম্ভব।

বছরব্যাপী ফল উৎপাদনের মাধ্যমে পুষ্টি উন্নয়ন প্রকল্প কফির উৎপাদন, সম্প্রসারণে কাজ করেছে। ২০২০-২০২১ সালে ১ লক্ষ ৪০ হাজার চারা-কলম রোপণের লক্ষমাত্রা রয়েছে। ইতোমধ্যে দেশের বাহির থেকে ২০ হাজার চারা সংগ্রহ করা হয়েছে। স্থানীয়ভাবে কৃষকের মাধ্যমে ৫০ হাজার চারা উৎপাদনের কাজ চলমান। সারা দেশে এক বিঘার ৭০০টি প্রদর্শণী বাস্তবায়ন চলমান। প্রদর্শণীর কৃষকদের কফি চাষ বিষয়ে প্রশিক্ষণসহ বিনামূল্যে চারা, সার ও অন্যান্য উপকরণ দেয়া হচ্ছে। ভিয়েতনাম থেকে  রোবাস্টা জাতের চারা সংগ্রহের কাজ প্রক্রিয়াধীন।

কফি এবং কাজুবাদামের নতুন প্রকল্পঃ
সরকারীভাবে ২০২০ সাল থেকে কফি ও কাজুবাদাম চাষ সম্প্রসারণের নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহন করা হয়। মাননীয় কৃষিমন্ত্রী মহোদয়ের নির্দেশে প্রকল্প প্রনয়ন করা হয়। ইতোমধ্যে একনেকে “ বাংলাদেশে কাজুবাদাম এবং কফি গবেষণা ও চাষ সম্প্রসারণ” শিরোনামে ২১১ কোটি টাকার প্রকল্প অনুমোদিত হয়েছে। প্রকল্পের মাধ্যমে কৃষক প্রশিক্ষণ, প্রদর্শনী স্থাপন, চারা-কলম বিতরণ, মাতৃবাগান তৈরি, উদ্যোক্তা সৃষ্টিসহ প্রক্রিয়াজাত কারখানায় সহযোগিতা সহ অন্যান্য কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হবে।