পাঁচ দশকে বাংলাদেশের কৃষি

Category: গবেষণা ফিচার Written by agrilife24

কৃষিবিদ ড. এম. এ. আউয়াল ও কৃষিবিদ ড. এম. মনির উদ্দিন:সম্রাট আওরঙ্গজেবের শাসনামলে (১৬৫৮-১৭০৭) ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীকে কলকাতায় তাদের ভিত্তি স্থাপনের অনুমতি দেয়া হয়। এরপর ১৭৫৭ সালে ব্রিটিশরা নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার বাহিনীর সাথে পলাশীর যুদ্ধে জয়ী হয়ে এই অঞ্চলে তাদের শাসন গড়ে তোলে। এরপর ব্রিটিশরা এই অঞ্চলে প্রভাবশালী হিন্দুদের মাধ্যমে জমিদার প্রথার শাসন শুরু করে।

ভারতবর্ষে ব্রিটিশ সম্প্রসারনের ভিত্তি ছিল বাংলা। ১৮৫৪ সালে ভারত সরকার বাংলা থেকে পৃথক হয়ে যায়, যদিও কলকাতা ১৯২১ সাল পর্যন্ত ভারতের রাজধানী ছিল। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসনের অবসানের পর পশ্চিমবঙ্গ, বিহার এবং উড়িষ্যা ভারত প্রজাতন্ত্রের অংশে পরিনত হয়। ১৮৭৪ সালে ব্রিটিশ শাসক আসামকে পৃথক করে কিন্তু তারপরও বঙ্গদেশ প্রদেশটি পরিচালনা করা প্রায় অসম্ভব ছিল। ১৯০৫ সালে ব্রিটিশ শাসক ভৌগলিক ভিত্তিতে দুটি নুতন প্রদেশ তৈরী করে, যার একটি বিহার ও উড়িষ্যাসহ পুর্ববাংলা এবং আরেকটি পুর্ববাংলা ও আসাম। ১৯০৬ সালে নবাব সলিমুল্লাহর পৃষ্ঠপোষকতায় ভারতীয় মুসলিম নেতারা ঢাকায় জড়ো হয়ে সর্বভারতীয় মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা করে। সে সময় ১৯০৯ সালে সাংবিধানিক সংস্কারের মাধ্যমে মুসলমানদের জন্য পৃথক নির্বাচনী এলাকা করা হয়, তবে তারা এই বিভাজনকে ধরে রাখতে পারেনি। পরবর্তীতে ১৯১২ সালে দেশভাগ বাতিল হয়ে যায়। বিহার ও উড়িষ্যা একটি নুতন প্রদেশে রুপ নেয় আর আসাম তার পৃথক মর্যাদায় ফিরে আসে। এভাবেই বাংলায় বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে ব্রিটিশরা তাদের স্বার্থে শাসন কর্তৃত্ব চালাতে থাকে। ইতমধ্যে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বাংলার সুর্য় সন্তানেরা প্রতিবাদী হয়ে উঠে।

এমনই এক প্রেক্ষাপটে ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ গোপালগঞ্জ মহুকুমার টুঙ্গিপাড়া গ্রামে বাংলার আলোর দিশারী হয়ে জন্মগ্রহন করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৩৮ সালে শেরেবাংলা বাংলার প্রধানমন্ত্রী এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী শ্রমমন্ত্রী। বঙ্গবন্ধু অল্প বয়সেই বাংলার এই দুই নেতার সংস্পর্শে আসেন এবং রাজনীতির সাথে জড়িত হন। ১৯৪১ সালে বঙ্গবন্ধু ম্যাট্রিক পাশ করে কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হন এবং বেকার হোস্টেলে উঠেন। এখান থেকেই শুরু হয় বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবন। ১৯৪৩ সালের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের সময় বঙ্গবন্ধু সোহরাওয়ার্দী সাহেবের সাথে বুভুক্ষুদের খাবার যোগাড়ে নিয়োজিত হন। পড়াশোনা বাদ দিয়ে বঙ্গবন্ধু লঙ্গরখানা খুলে অনাহারী মানুষদের সেবায় ব্রত হন।

১৯৪৭ সালের জুন মাসে ইংরেজ বড়লাট মাউন্টব্যাটেন দেশভাগের ঘোষনা দেয়। এ সময় বঙ্গবন্ধু বয়স কম হলেও রাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত পরিপক্ক হয়ে উঠেন এবং বাংলার নির্যাতিত মানুষের মুক্তির পথ খুঁজতে থাকেন। বঙ্গবন্ধু ১৯৪৭ সালে স্বপ্ন দেখতেন, শেরেবাংলার ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে বাংলা ও আসাম নিয়ে একটি সার্বভৌম স্বাধীন রাস্ট্র হবে। কিন্তু সেদিন পশ্চিমা শাসকরা তৎকালীন কংগ্রেস এবং ইংরেজদের সাথে গোপন বৈঠক করে বাংলার দিকে না তাকিয়ে শুধু তাদের স্বার্থ হাসিল করেই চুক্তি করে ফেলে এবং আসাম, কলকাতাকে বাদ দিয়েই ভারত ও পাকিস্তান নামক দুটি দেশ ভাগ হয়।

এরপর বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠেন পুর্ব পাকিস্তানের অবিসংবাদিত নেতা। বঙ্গবন্ধু দেশভাগের পর থেকেই আবার নুতন করে বাংলার মানুষের মুক্তির পথ খুজঁতে থাকেন। বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাংলার মুক্তিকামী মানুষ বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হয় এবং বঙ্গবন্ধুর ডাকে ১৯৭১ সালের নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময়ে বিশ্বের মানচিত্রে জায়গা করে নেয় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু তার দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের পথ পরিক্রমায় অর্জিত অভিজ্ঞতা দিয়ে পরিস্কারভাবে বুঝেছিলেন যে, একমাত্র কৃষিই হতে পারে বাংলাদেশের উন্নয়নের হাতিয়ার। আর, তাই বঙ্গবন্ধু সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইন্সটিটিউট প্রতিষ্ঠা থেকে শুরু করে কৃষির সকল গবেষণা এবং সম্প্রসারন প্রতিষ্ঠানগুলোকে ঢেলে সাজান।           
    
পশ্চিমা শাসকরা দীঘদিন এই ভুখন্ডকে শুধু শোষনই করেছে। ফলে অনাহার, দুর্ভিক্ষ অনেকটাই নিয়মিত ব্যাপার ছিল এই বাংলাদেশ ভুখন্ডের বাঙালী জাতির। ১৯৭০ সালে পুর্ব পাকিস্তানের মোট দানাজাতীয় ফসল উৎপাদনের পরিমান ছিল মাত্র ১ কোটি ১১ লাখ টন যা তৎসময়ে পুর্ব পাকিস্তানের জনসংখ্যার হিসাবে ছিল খুবই অপ্রতুল। এরপর ১৯৭১ এর স্বাধীনতা যুদ্ধে স্বাভাবিক কারনেই দেশে খাদ্য উৎপাদন কমে যায় এবং এর পরিমান দাড়ায় ৯৯ লাখ ৩৬ হাজার টনে। পরের বছর অর্থ্যাৎ ১৯৭২ সালে দেশে খাদ্য উৎপাদন বেড়ে ১ কোটি ১০ লাখ টনে দাড়ায়, যদিও এই পরিমান খাদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের সাড়ে ৭ কোটি মানুষের জন্য মোটেই পর্যাপ্ত ছিল না। এ কারনে স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে সাময়িকভাবে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ খাদ্য ঘাটতিতে পড়ে।

এ সময় আর্ন্তজাতিক সংস্থাগুলো বিশেষ করে অক্সফাম, বিশ্বব্যাংক, ইউএসএআইডি, জাতিসংঘসহ বিশেষজ্ঞগন বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষ দেখা দেওয়ার আশংকা করেছিলেন এবং তারা অনুমান করেছিলেন যে, দুর্ভিক্ষের কারনে বাংলাদেশে ৫০ লাখ মানুষ মারা যেতে পারে। বঙ্গবন্ধু দেশের কৃষি ব্যবস্থাকে পুনঃগঠিত করে কৃষির উৎপাদন বাড়ানোর জন্য সে সময় সবুজ বিপ্লবের ডাক দেন এবং বিভিন্ন মেয়াদী কর্মসুচী গ্রহন করেন। পাশাপাশি দেশের মানুষের খাদ্য নিরাপত্তার জন্য বন্ধুপ্রতিম বিভিন্ন দেশের সাথে যোগাযোগ অব্যাহত রাখেন এবং ৩০ লাখ টন খাদ্য আমদানী করেন দেশের খাদ্য ঘাটতি মেটানোর জন্য। বর্ষীয়ান নেতা জনাব তোফায়েল আহমেদ স্যারের লেখায় জানা যায়, ১৯৭৩-১৯৭৪ এর দিনগুলোতে বঙ্গবন্ধু সারাদিন কর্মব্যস্ত সময় পার করেছেন আর ৩২ নম্বর এর অরক্ষিত বাসায় অনেক রাত্রি বিনিদ্র কাটিয়েছেন এবং কেঁদেছেন এই বাঙালী জাতির জন্য। কিভাবে দেশের মানুষের জন্য দুবেলা খাবার জোগাড় করা যায় এটিই ছিল তার ভাবনায়। বঙ্গবন্ধুর নেয়া বিভিন্ন কৃষি উন্নয়নমুখী কর্মকান্ডের মাধ্যমে ইতিমধ্যে দেশের খাদ্য উৎপাদনে গতি ফিরে আসে।

এমনই সময় বঙ্গবন্ধুর স্বাধীন বাংলাদেশে বাঙালী জাতির গৌরবোজ্জল ইতিহাসের পাতায় স্বাধীনতার বিরোধী চক্র ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট তৈরী করে এক কালো অধ্যায়ের। সপরিবারে হত্যা করা হয় জাতির জনক, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। বিদেশে থাকার কারনে বেঁচে যান বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। এরপর প্রায় ২৬ বছর স্বাধীন বাংলাদেশ যেন অনেকটা পরাধীনতার শিকলে বাধা পড়ে এবং স্বাধীনতার পরাজিত শক্তির হাতে দেশ শাসিত হয়। এরই সাথে চাপা পড়ে থাকে বঙ্গবন্ধুর দেশ উন্নয়নের সকল পরিকল্পনা। দেশের কৃষিখাত হয়ে পড়ে অবহেলিত, স্বাধীনতা বিরোধী মতিউর রহমান নিজামী হয় বাংলাদেশের কৃষিমন্ত্রী, গুলিতে মরে অনেক কৃষক।

আবার বাঙালী জাতির জন্য আশির্বাদ হয়ে আসেন বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা। প্রতি কদমে যেন মৃত্যুফাদ, এমনি সব বিপদ মাথায় নিয়ে বর্তমান সময় পর্যন্ত চারবার নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন এবং প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকেই বঙ্গবন্ধুর কৃষির স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করার কাজে নিয়োজিত হন। তার সুদুরপ্রসারী নের্তৃত্বের কারনে দেশের কৃষিতে বিগত কয়েক বছর ধরে অভুতপুর্ব সাফল্যের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রয়েছে।   

বাংলাদেশ কৃষি প্রধান দেশ। এদেশের অর্থনীতি এখনও কৃষি নির্ভর। কৃষিই দেশের মুল চালিকা শক্তি। কৃষি প্রধান বাংলাদেশের ৮৭,২২৩টি গ্রামে বাস করে দেশের মোট জনসংখ্যার ৭০ শতাংশ অর্থ্যাৎ ১১ কোটি মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কৃষির সাথে সংশ্লিষ্ট। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কৃষিবান্ধব সরকার কৃষিকে অগ্রাধিকার দিয়ে স্বল্পমেয়াদী, মধ্যমেয়াদী এবং দীর্ঘমেয়াদী পকিল্পনা গ্রহন করে, যার ফলে কৃষি আজ দেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করেছে। করোনাকালীন বিশ্বে যখন সকল দেশের অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়েছে, অনেক দেশে যখন চলছে খাদ্যাভাব, তখন বাংলাদেশ তার অর্থনীতিকে সচল রেখেছে কৃষিকে ঘিরেই।

দেশে অনেক আগে থেকেই জলবায়ুর নেতিবাচক প্রভাব শুরু হয়েছে। এটিকে মোকাবেলা করেই বাংলাদেশের কৃষি এগিয়ে চলছে। দেশে ১৯৭০ সাল থেকে ২০২১ সালের ইয়াসসহ মোট ২৭টি ঘুর্নিঝড় আঘাত হেনেছে। ১৯৫৩ থেকে ২০২০ পর্যন্ত মোট ৪৭ বার বন্যা হয়েছে এই ভুখন্ডে। এভাবেই বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ এই ভুখন্ডে বিভিন্ন সময় হানা দিয়েছে। এর মধ্য দিয়েই কৃষিবান্ধব সরকারের প্রচেষ্টায় দেশের কৃষির উন্নয়নের ধারা অব্যাহত আছে।

১৯৭১ থেকে ২০২০ পর্যন্ত ৫০ বছরে দেশের ধান চাষের জমি কমেছে ২০ শতাংশ, তবে বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইন্সটিটিউটের দেয়া উচ্চফলনশীল জাতের বদৌলতে আজ বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পুর্ন এবং বিশ্বে বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে বিবেচিত।

দীর্ঘদিন বাংলাদেশ বিশ্বের মধ্যে ধান উৎপাদনে চতুর্থ অবস্থানে ছিল। কৃষিবান্ধব সরকারের নেয়া উন্নয়ন পরিকল্পনার ফলে, বাংলাদেশ ইন্দোনেশিয়াকে পিছনে ফেলে বিশ্বে ধান উৎপাদনে তৃতীয় অবস্থানে এসেছে। ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরে দেশে চাল উৎপাদিত হয়েছে ৩৩২.৭৯ লাখ মেট্রিক টন, ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে ৩৭৩.৬৪ লাখ মেট্রিক টন এবং ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে ৩৮৬.৯৫ লাখ মেট্রিক টন। ২০১৮-২০১৯ সালে দেশে মোট আলুর উৎপাদন হয়েছে ১০৯ লাখ মেট্রিক টন এবং ২০১৯-২০২০ বছরে আলুর উৎপাদন ১১০ লাখ মেট্রিক টন। আমাদের দেশে বাৎসরিক আলুর চাহিদা প্রায় ৭০ লাখ মেট্রিক টন। অর্থ্যাৎ ৪০ লাখ মেট্রিক টন আলু বর্তমানে দেশের উদ্ধৃত্ত যা বিদেশে রপ্তানী করার সুযোগ তৈরী হয়েছে। ১৯৭০ সালে এই ভুখন্ডে ভুট্টার উৎপাদন ছিল মাত্র ৩০০০ টন এবং ১৯৭১ সালে এর উৎপাদন দাড়ায় ২০০০ টনে। ২০১৯-২০২০ বছরে দেশে ভুট্টার উৎপাদন দাড়িয়েছে ৫৪ লাখ মেট্রিক টন। মাননীয় কৃষিমন্ত্রী ভুট্টার উৎপাদন ১ কোটি মেট্রিক টনে উন্নীত করার জন্য নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন।


বাংলাদেশের শিশু ও মহিলাসহ সকল জনগোষ্ঠী একসময় শাকসব্জি কম খাওয়ায় অপুষ্টিতে ভুগতো। সেই বাংলাদেশ আজ বিশ্বের মধ্যে শাকসব্জি উৎপাদনে ৩য় অবস্থানে। ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে দেশে শাকসব্জি উৎপাদিত হয়েছে ১৭২ লাখ ৪৭ হাজার মেট্রিক টন। দেশের চাহিদা মিটিয়ে আজ শাকসব্জি বিদেশে রপ্তানী হচ্ছে এবং আগামীদিনে বাংলাদেশ থেকে আরো বিপুল পরিমান সব্জি রপ্তানী করার সুযোগ তৈরী হচ্ছে।

দেশের কৃষির আরেকটি গুরুত্বপুর্ন সাব-সেক্টর হচ্ছে মৎস্যসম্পদ। দেশের জিডিপি’তে মৎস্য খাতের অবদান ৩.৬১ শতাংশ এবং কৃষিজ জিডিপি’র ২৫.৩০ শতাংশ। বর্তমানে দেশের ১২ শতাংশ মানুষ মৎস্য সেক্টরের বিভিন্ন কর্মকান্ডের সাথে যুক্ত হয়ে জীবিকা নির্বাহ করছে। ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরে দেশে মৎস্য উৎপাদন হয়েছে ৪২.৭৭ লাখ মেট্রিক টন, ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে ৪৩.৮৪ লাখ মেট্রিক টন এবং ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে মৎস্য উৎপাদনের তথ্য না পাওয়া গেলেও এর পরিমান ৪৪.৫০ লাখ মেট্রিক টনের কম নয়। সেইসাথে মৎস্য ও প্রানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের মতে, উৎপাদনের ধারা অব্যাহত থাকলে ২০২০-২০২১ অর্থবছরে দেশের মৎস্য উৎপাদনের পরিমান দাড়াবে ৪৫.৫২ লাখ মেট্রিক টন অর্থ্যাৎ দেশের মৎস্য উৎপাদন প্রতি বছর ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলেছে। দেশে বাৎসরিক মাছের চাহিদা ৪২ লাখ ৩৮ হাজার মেট্রিক টন এবং মাথাপিছু দৈনিক মাছ গ্রহনের পরিমান ৬২.৫৮ গ্রাম যা প্রয়োজনের চেয়ে ২.৫৮ গ্রাম বেশী। অথচ ১৯৮৩-১৯৮৪ অর্থবছরে মৎস্য উৎপাদন ছিল মাত্র ৭.৫৪ লাখ মেট্রিক টন এবং ২০০৮-২০০৯ অর্থবছরে উৎপাদন ছিল ২৭.০১ লাখ মেট্রিক টন। গতবছর দেশে ইলিশের উৎপাদন বেড়ে দাড়িয়েছে ৫,১৭,১৯৮ মেট্রিক টন যার উৎপাদন ২০০৮-২০০৯ অর্থবছরে ছিল মাত্র ২.৯৯ লাখ মেট্রিক টন। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (FAO) এর তথ্যানুসারে, বাংলাদেশ আভ্যন্তরীন মুক্ত জলাশয়ে মাছ উৎপাদনে বিশ্বের মধ্যে ৩য় অবস্থানে এবং বদ্ধ জলাশয়ে মাছ উৎপাদনে ৫ম অবস্থানে।  

পুকুর, বিল, হাওড়, বাওড়, খাল, নদী ও সমুদ্র নিয়ে দেশের বিশাল জলরাশি যার হৃদপিন্ড হচ্ছে বঙ্গোপসাগর। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালেই সামুদ্রিক মৎস্য আহরণের জন্য জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান উদ্দ্যোগ গ্রহন করেন এবং ঘোষনা করেন ”মাছ হবে দেশের দ্ধিতীয় প্রধান বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী সম্পদ”। তার এই উদ্দ্যোগে সহযোগীতায় এগিয়ে আসে তৎসময়ের সোভিয়েট ইউনিয়ন এবং বঙ্গবন্ধুকে উপহার দেন ১০টি মাছ ধরার সামুদ্রিক ট্রলার এবং আহরণ শুরু হয় মাছের। আজ বঙ্গবন্ধুর যোগ্য উত্তরসুরী মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আর্ন্তজাতিক ট্রাইবুনালের রায়ে বিশাল সমুদ্র এলাকা জয় করেন এবং বর্তমানে আমাদের সমুদ্রসীমার আয়তন দাড়িয়েছে ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গ কিলোমিটার যেখান থেকে মৎস্য সম্পদ আহরণ দিন দিন বেড়ে চলেছে।

বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউট (বিএফআরআই) ২৩টি বিপন্ন প্রজাতির মাছের কৃত্রিম প্রজনন ও চাষাবাদ কৌশল উদ্ভাবন করেছে। দেশী এ সমস্ত মাছের পোনা উৎপাদনের জন্য দেশে ৪০০ টির বেশী হ্যাচারী গড়ে উঠেছে। শুধু ময়মনসিংহ অঞ্চলে বছরে ২০০ কোটি পাবদা ও গুলশা মাছের পোনা উৎপাদিত হয়। এভাবেই বিশ্বে মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ চতুর্থ অবস্থানে এসেছে। বিএফআরআই অদ্যাবধি ৬১টি মৎস্যচাষ ও ব্যবস্থাপনা বিষয়ক প্রযুক্তি ছাড় করেছে। দেশে কাঁকড়া ও কুচিয়া চাষ এবং এর রপ্তানী দিন দিন বাড়ছে। ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে ৭৩,১৭১.৩২ মেট্রিক টন মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্য রপ্তানী করে ৪,২৫০.৩১ কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা দেশে এসেছে। ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে দেশ থেকে ৭০,৯৪৫.৩৯ মেট্রিক টন মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্য রপ্তানী হয়েছে, যার বিপরীতে বৈদেশিক মুদ্রা এসেছে ৩,৯৮৫.১৫ কোটি টাকা। এভাবেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নের্তৃত্বে এগিয়ে চলছে মৎস্যখাতের অগ্রযাত্রা।

কৃষির অন্যান্য সাব সেক্টরের পাশাপাশি প্রানিসম্পদ অধিদপ্তর দেশের মানুষের প্রয়োজনীয় প্রোটিনের চাহিদা পুরনের জন্য নিষ্ঠার সাথে কাজ করে চলেছে। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৩ সালে দেশের গরুর জাত উন্নয়নের জন্য প্রথম কৃত্রিম প্রজননের ব্যবস্থা করেন, যা আজ স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও অব্যাহত আছে। অধিদপ্তরটির তথ্য মতে, ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরে দেশে তরল দুধ উৎপাদিত হয়েছে ৯৪.০৬ লাখ মেট্রিক টন, মাংস-৭২.৬০ লাখ মেট্রিক টন, ডিম-১৫৫২ কোটি। ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে উৎপাদিত হয়েছে তরল দুধ-৯৯.২৩ লাখ মেট্রিক টন, মাংস-৭৫.১৪ লাখ মেট্রিক টন এবং ডিম-১৭১১ কোটি। ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে দেশের তরল দুধের উৎপাদন ১০৬.৮০ লক্ষ মেট্রিক টন, মাংস উৎপাদন ৭৬.৭৪ লক্ষ মেট্রিক টন, ডিমের উৎপাদন ১৭৩৬ কোটি, কৃত্রিম প্রজননকৃত গাভীর সংখ্যা ৪৪.৪১ লক্ষ, কৃত্রিম প্রজননকৃত গাভী থেকে সংকর জাতের বাছুর উৎপাদন ১৪.১৮ লক্ষ, গরুর সংখ্যা ২৪.৪০ মিলিয়ন, ছাগল ২৬.৪৪ মিলিয়ন, ভেড়া ৩.৬১ মিলিয়ন, মুরগী ২৯৬.৬০ মিলিয়ন, হাঁস ৫৯.৭২ মিলিয়ন। অধিদপ্তরের বিগত বছরগুলোর তথ্য উপাত্ত পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, দেশে ডিম, দুধ, মাংসের উৎপাদন ধারাবাহিকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ইতিমধ্যে ডিম, দুধ ও মাংস উৎপাদনে আমরা শুধু স্বয়ংসম্পুর্নই হইনি বরং দেশ থেকে প্রচুর পরিমানে প্রানিজ উৎপাদন রপ্তানী করার সুযোগ তৈরী হচ্ছে।

কৃষি সম্প্রসারন অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী ২০২১ সালের বোরোতে চাষ হয়েছে মোট ৪৮ লাখ ৮৩ হাজার ৭৬০ হেক্টর জমিতে যার মধ্যে হাইব্রিড জাতের চাষ হয়েছে ১২ লাখ ১৩ হাজার হেক্টর জমিতে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত কৃষিমন্ত্রী আর্ন্তজাতিক খ্যাতিসম্পন্ন কৃষিবিজ্ঞানী ড. আব্দুর রাজ্জাক করোনাকালীন সময়ে তার সুদক্ষ টিম নিয়ে হাওড় এলাকাসহ কৃষকের মাঠে মাঠে ঘুরছেন এবং বিভিন্ন প্রনোদনা প্যাকেজ দিয়ে কৃষকদের উৎসাহিত করছেন দেশের খাদ্য উৎপাদন বাড়ানোর জন্য, যার ফলে চলতি বোরো মৌসুমে বিগত কয়েক বছরের মধ্যে দেশের সর্বত্র বাম্পার ফলন হয়েছে। এবারের বোরোর ফলন সর্ম্পকে কৃষকদের মুখের কথা এই রকম যে, এবার দেশে ধানের বছর। ধারনা করা যায়, এবার বোরো থেকে ২১৫ লাখ মেট্রিক টন চাল পাওয়া যাবে।   

আইএমএফ এর তথ্যানুযায়ী, ২০১৯ সালে বিশ্বের সব দেশের মধ্যে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ছিল তৃতীয় সর্বোচ্চ ৭.৮ শতাংশ। ২০২১ সালের মে পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের ইতিহাস গড়া রিজার্ভ দাড়িয়েছে ৪৪ বিলিয়ন ডলার। ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে দেশের মাথাপিছ আয় ছিল ২০৬৪ ডলার যা ২০২০-২০২১ অর্থবছরে বেড়ে ২২২৭ ডলার হয়েছে।

কৃষিবান্ধব সরকারের শ্লোগান ”আমার গ্রাম আমার শহর” বিবেচনায় রেখে কৃষি এগিয়ে যাচ্ছে। কৃষিতে ইতিমধ্যে সরকারের বিশেষ প্রনোদনায় যান্ত্রিকীকরণ শুরু হয়েছে এবং এতে কৃষি আরো বেগবান হচ্ছে। আগামীদিনে ধানের উৎপাদনের বৃদ্ধির ধারা অব্যাহতভাবে ধরে রাখার জন্য কৃষি মন্ত্রণালয় দেশীয় অধিক তাপমাত্রা সহনশীল ধানের জাতসহ হাওড় অঞ্চলের ধান আগাম তোলার জন্য হাইব্রিড জাতের সম্পসারনের উদ্দ্যোগ নিয়েছে। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইন্সটিটিউটসহ অন্যান্য গবেষণা প্রতিষ্ঠান অদ্যাবধি ১২৮টি উচ্চফলনশীল ধানের জাত উদ্ভাবন করেছে, যা দেশের ধানের উৎপাদন বৃদ্ধিকে দিন দিন এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।      

স্বাধীনতার ৫০ বছরে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার কৃষিবান্ধব সরকার বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নকে বাস্তবে রুপ দিয়েছেন। আজ দেশের মানুষ তিন বেলা পেট ভরে ভাত খেতে পারছে। মানুষের পুষ্টি নিরাপত্তার জন্য দেশ আজ শাকসব্জি, মাছ, মাংস, ডিম, দুধ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পুর্ন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সঠিক নির্দেশনায় কৃষি মন্ত্রণালয়ের কার্যকর পদক্ষেপের ফলে আজ কৃষির অপ্রতিরোধ্য অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ। মাননীয় কৃষিমন্ত্রী কৃষিবিদ ড. আব্দুর রাজ্জাক কৃষি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে দেশের কৃষিতে নুতন গতির সঞ্চার হয়েছে।

স্বাধীনতার ৫০ বছরের মধ্যে ২৬ বছর চলে গেছে দেশ বিরোধী লুটেরা শক্তির শাসনে। বাকী ২৪ বছরের মধ্যে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু দেশের মানুষের সামাজিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য সমস্ত পরিকল্পনা করে গিয়েছেন, যা এই সময়ের মধ্যে বাস্তবায়ন করে চলেছেন বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা। তার দক্ষ নের্তৃত্বে বাংলাদেশ অনুন্নত দেশের তালিকা থেকে বেরিয়ে উন্নয়নশীল দেশে পরিনত হয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ২০৪১ সালে দেশকে উন্নয়নশীল দেশের তালিকা থেকে উন্নত দেশের তালিকয় নিয়ে যাওয়ার জন্য বদ্ধ পরিকর। দেশের কৃষি এবং অন্যান্য সেক্টর যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে, তাতে বাংলাদেশ অবশ্যই আগামীতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশিত পথে উন্নত দেশের তালিকায় নাম লেখাবে।         

লেখকদ্বয় পরিচিতি:কৃষিবিদ ড. এম. এ. আউয়াল, সদস্য পরিচালক
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল, ফার্মগেট, ঢাকা
              ও
কৃষিবিদ ড. এম. মনির উদ্দিন
এগ্রোনোমিস্ট, কলামিষ্ট ও উন্নয়ন কর্মী